ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঝাঁজের পেঁয়াজে পচন ॥ লাভের আশায় গুড়েবালি

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১৯ নভেম্বর ২০২০

ঝাঁজের পেঁয়াজে পচন ॥ লাভের আশায় গুড়েবালি

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার মাত্রাতিরিক্ত। লাভের আশায় গুড়েবালি। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ ডলারে কেনা টনে টনে আসা আমদানির পেঁয়াজে পচন ধরেছে। বন্দরে, আড়তে শত শত বস্তায় পচা পেঁয়াজ। ঝাঁজ নেই, মিলছে দুর্গন্ধ। পাইকারি বাজারে দরপতন হয়েছে ব্যাপক। এখন পচা পেঁয়াজ ফেলে দেয়া হচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমদানির পেঁয়াজ পচে যাওয়ায় এ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ৮০ কোটি টাকারও বেশি বলে ধারণা পাওয়া গেছে। এ হিসাব দেশের একক বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের। প্রসঙ্গত, গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেশী দেশ ভারত সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যায়। প্রতিদিন দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজের মূল্য সর্বোচ্চ ১৩০ টাকায়ও বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। ওই সময়ে এককেজি আপেলের মূল্যের চেয়েও বেশিতে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতিকেজি পেঁয়াজের মূল্য। এ অবস্থায় সরকার পক্ষে পেঁয়াজ আমদানির আহ্বান জানানো হয়। বাজার পরিস্থিতি সহনশীল পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে সরকার টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ে আমদানিকারকদের মধ্যে পেঁয়াজ আনার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়ে যায়। কেউ ব্যবসা বুঝে আর কেউ না বুঝে পেঁয়াজ আমদানির জন্য ব্যাংকে এলসি খুলে বসে। প্রতিটন ৫শ’ ডলারের ওপরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পেঁয়াজের বুকিং হয়ে যায়। সে পেঁয়াজ আসার পথে যে সময় নেয় এবং পরবর্তীতে আড়তে পর্যন্ত পৌঁছানোর পর তাতে পচন ধরে যায়। খাতুনগঞ্জের পাইকারি আড়তে পেঁয়াজের এখন ঝাঁজ নেই। মিলছে পচা গন্ধ। খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ মার্কেটের পাইকারি আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির নেতা মোঃ ইদ্রিস বুধবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানান, প্রতিদিন পচা পেঁয়াজ সিটি কর্পোরেশনের গাড়িযোগে তুলে নেয়া হচ্ছে। ফেলে দেয়া হচ্ছে কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়ে। কেন এমন হলো- এমন প্রশ্নের উত্তরে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অতি মুনাফার লোভে পেঁয়াজ সঙ্কটকে পুঁজি করে অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরাও পেঁয়াজ আমদানিতে ঝুঁকে পড়ে। এতে মানের দিকটি যেমন বিবেচনায় আনা হয়নি, তেমনি বুকিং রেট নিয়ে হিসাব কষা হয়নি। ফলে রেফার কন্টেনার বোঝাই হয়ে পেঁয়াজ যখন বন্দরে খালাস হয়েছে তখনই অধিকাংশে গ্যাজ উঠেছে। বস্তা বোঝাই হয়ে আসা এসব পেঁয়াজের কিছু পরিমাণ পচে রস পড়ার বিষয়টিও লক্ষণীয়। এভাবে ট্রাক বোঝাই হয়ে যখন পেঁয়াজের চালান আড়তে পৌঁছেছে তখন কিছু বস্তা পুরোপুরিভাবে এবং কিছু বস্তা অর্ধ পচা অবস্থায় খুলতে হয়েছে। শনিবার বাজার চিত্রে দেখা যায়, চীন, মিসর, মিয়ানমার, তুরস্ক, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ইরান এবং হল্যান্ড থেকে আসা পেঁয়াজের চালানের একই অবস্থা। ৫শ’ ডলারের উপরে প্রতিটন কেনা পেঁয়াজ কখনও অর্ধেক, কখনও অর্ধেকের কমে বিক্রির ক্রেতা মিলছে না। দিন যতই গড়াচ্ছে পচন প্রক্রিয়া ততই বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তুরস্ক, মিসর, হল্যান্ড, ইরান, নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ পৌঁছতে কমপক্ষে ত্রিশ দিন, পাকিস্তান-চীন, মিয়ানমার থেকে আমদানি প্রক্রিয়াসহ পণ্য পৌঁছাতে সময় নেয় বিশ দিন। পেঁয়াজ যেহেতু পচনশীল পণ্য সেক্ষেত্রে রেফার কন্টেনারযোগে আমদানি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কিছু ব্যবসায়ী তড়িঘড়ি করেও পেঁয়াজ নিয়ে এসেছে। বিপরীতে দেশ থেকে চলে গেছে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ ডলার। বুধবারের বাজার চিত্রে দেখা যায়, খাতুনগঞ্জের আড়তে প্রতিকেজি পাকিস্তানী পেঁয়াজ ২০ থেকে ২৫, মিসর, তুরস্ক ২৫ থেকে ৩০, মিয়ানমার ২০ থেকে ২২, চীনের ১৫ থেকে ২০ এবং ইরানী পেঁয়াজ ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর যেসব পেঁয়াজে পচন ধরেছে সেসব পেঁয়াজ প্রতিবস্তা ৫ থেকে ১০ টাকায় আগ্রহী ক্রেতাদের দেয়া হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে মানসম্পন্ন পেঁয়াজের মূল্য কেজিপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত নেমে এসেছে। ব্যবসায়ী নেতাদের সূত্রে আরও জানানো হয়েছে, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কোন ধারণা নেই, চাহিদা নিয়ে কোন অভিজ্ঞতা নেই-এমন ব্যবসায়ীরা যেনতেনভাবে এলসি খুলে পেঁয়াজ আনার পর এমন ঘটনা ঘটল। খাতুনগঞ্জের প্রতিটি আড়তের সামনে শত শত পচা পেঁয়াজের বস্তা লক্ষণীয়। ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক ধারণা ইতোমধ্যে কমপক্ষে ৮০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। লাভ তো দূরের কথা, আসল উঠানোর সুযোগ নেই।
×