ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিপুল সংগ্রহ কোভিডকালে

প্রদর্শনী বন্ধ থাকলেও ঘরে বসে দেদার ছবি আঁকছেন শিল্পীরা

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ১৯ নভেম্বর ২০২০

প্রদর্শনী বন্ধ থাকলেও ঘরে বসে দেদার ছবি আঁকছেন শিল্পীরা

মোরসালিন মিজান ॥ কোভিডের কাল। সবই এলোমেলো হয়ে গেছে। আরও অনেক কিছুর মতো বন্ধ রয়েছে প্রদর্শনী। তবে ছবি আঁকা থেমে নেই। বরং দেদার ছবি আঁকছেন শিল্পীরা। করোনার এই সময় ছবি আঁকার জন্য খুব অনুকূল হয়েছে, না, এমন নয়। সবাই সমানভাবে আঁকতেও পারছেন না। তবে মন শান্ত করার জন্য রং তুলিকে বেছে নিয়েছেন বহু শিল্পী। যাদের নিজস্ব স্টুডিও আছে তারা সেখানেই দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছেন। বাকিরা নিজের বাসার চেয়ার টেবিল ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। সেখানেই চলছে ছবি আঁকার কাজ। বিশেষ করে যারা ছবি আঁকার সময় বের করতে পারতেন না, তারা শুরু করার পর নেশায় পড়ে গেছেন। ঢাকার স্বানামধন্য শিল্পী ও অপেক্ষাকৃত নবীনদের সঙ্গে কথা বলেই জানা গেছে এইসব তথ্য। গত মার্চে দেশে প্রথম করোনা হানা দেয়। তার পর থেকেই ঘরে ঢুকতে শুরু করে সচেতন মানুষ। সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করে সরকার। বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। ঠিক তখন শুরু হয়েছিল করোনাকালের ছবি আঁকা। অল্প অল্প করেই শুরু। ক্রমে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে ছবি আঁকার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রবণতা। খ্যাতিমান শিল্পী মনিরুর ইসলামের কথাই যদি বলি, সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই ধানমণ্ডির বাসায় খিল দিয়েছেন তিনি। তার পর শুধু ছবি আঁকা। বিভিন্ন সিনেম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা, সাময়িকী, বই ইত্যাদির পাতায় পাতায় ছবি এঁকে চলেছেন শিল্পী। এভাবে ১০ হাজার পাতা ভর্তি করতে চান। সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন এখন। সাম্প্রতিককালে আঁকা ছবিতেও বিমূর্ত তিনি। অবশ্য মূর্ত বিমূর্ত কিছু স্বীকার করতে নারাজ। বরং বলেন, আমি গোলাপ নয়, গোলাপের ঘ্রাণটাকে আঁকি। ছবিতে করোনার প্রভাব কতটা পড়ছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনা ছবিতে সেভাবে আসছে না। নেই। আমি চাই আমার ছবি আমাকে সারপ্রাইজড করুক। তবেই সেটা ছবি। সেই ছবি আঁকার চেষ্টা করছি এখন। আরেক খ্যাতিমান শিল্পী মাহমুদুল হকের বেলায়ও বাধা হতে পারেনি বৈরী সময়। সহসাই ছবি আঁকার কাজে মনোযোগী হন তিনি। ‘করোনা ডায়রি’ শিরোনামে নিয়মিত এঁকে যান। শতাধিক ছবি এরই মাঝে আঁকা হয়ে গেছে। দেদার ছবি আঁকছেন শিলল্পী রনজিৎ দাসও। করোনাকালের আগে থেকে আঁকছিলেন। এখনও অব্যাহত। বর্তমানে ছবির সংখ্যা যা দাঁড়িয়েছে তা শিল্পীর হিসাবে, ৩০০ থেকে ৪০০ হয়ে যাবে! সরাসরি করোনাকে ক্যানভাসে স্থান দেননি তিনি। তবে এই সময়ের মনস্তত্ত্ব বিভিন্ন ভাব ও ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তার বেশ কিছু ক্যানভাসে কথা বলছে ওয়াটার কালার ল্যান্ডস্কেপ। এই মাধ্যমে ঘরে বসেই অপরূপ গ্রামবাংলাকে এঁকেছেন শিল্পী। আছে অনবদ্য কিছু ফিগারেটিভ কাজ। দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। শিল্পীর ভাষায়: এখন ছবি আঁকারই সময়। সময়টা কাজে লাগানো উচিত। ছবি এঁকে নিজেকে ভাল রাখার চেষ্টা করছি আমি। শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুসের উত্তরার বাসায় নিজস্ব স্টুডিও। সেখানেই ছবি আঁকছেন তিনি। কী ওঠে আসছে আপনার ছবিতে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যরকম একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। তবে হতাশার এই সময়কে আমি ক্যানভাসে আর ধরে রাখতে চাইছি না। আঁকায় কোন চেঞ্জ আনছি না। আশা ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্রাইট ছবি আঁকছেন বলে জানান তিনি। প্রচুর ছবি আঁকছেন শিল্পী মোস্তাফিজুল হকও। কাকরাইলের নিজের ফ্ল্যাটের একটিতে শিল্পী বসবাস করেন। অন্যটি স্টুডিও। স্টুডিওতে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে ছবি আঁকছেন তিনি। এরই মধ্যে কয়েক শ’ ছবি আঁকা হয়ে গেছে। তার মানে সময়টা ছবি আঁকার পক্ষে আছে? এমন প্রশ্নে শিল্পী বলেন, আমি ডিপ্রেশনে চলে যেতে চাই না। এ কারণেই ছবি আঁকায় বেশি মনোযোগ দিয়েছেন বলে জানান তিনি। অপেক্ষাকৃত নবীনদের নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ছুটতে হয় জীবীকার টানে। এ অবস্থায় অনেকে আঁকি আঁকি করছিলেন বটে। কিন্তু শুরুটাই হচ্ছিল না। শেষতক অঘোষিত লকডাউন বিশেষ সুযোগ করে দেয়। ছবি আঁকা শুরু করেন তারা। এখন বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এই দলেরই একজন শিল্পী প্রদ্যোত কুমার দাস। তার সরকারী চাকরি। শিল্পকলা একাডেমির ইনস্ট্রাক্টর। ৯-৫টা অফিস। কিন্তু যখন অফিস ছিল না তখন নিয়মিত হয়েছিলেন ছবি আঁকার কাজে। আর কে থামায়? এখন অফিস করেও প্রচুর ছবি আঁকছেন। তিন শ’র মতো ছবি আঁকা হয়ে গেছে। সাম্প্রতিককালে নারীর ছবিই বেশি আঁকতে দেখা যাচ্ছে তাকে। কেন? জানতে চাইলে শিল্পী বলেন, আমাদের নারীরা ভাল নেই। ধর্ষণসহ ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমার শিল্পী মনে বিষয়টি ভীষণ নাড়া দিয়েছে। তাই যত্নে ভালবাসায় শ্রদ্ধায় নারীকে আঁকছি। শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনেও হঠাৎ এক বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে জানা যায়। প্রিয়তমা স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মন মাঝে মাঝেই বিষন্ন হয়ে ওঠে। শিল্পী বলেন, ছবি এঁকে সেই বিষন্নতাও দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি। এভাবে করোনার মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির জায়গা থেকে ছবি আঁকছেন শিল্পীরা। সঠিক হিসাব করা মুশকিলের কাজ হবে। তবে শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে অনুমান করা যায়, এই সময়ের মধ্যে হাজার হাজার ছবি আঁকা হয়েছে। হচ্ছে এখনও। এত ছবি রাখার এমনকি জায়গা পাচ্ছেন না অনেকে। তাই অপেক্ষা করে আছেন কোভিডকাল শেষ হওয়ার। শেষ হলেই প্রদর্শনীতে যেতে চান তারা। আপাত অপেক্ষা। সুদিনের জন্য অপেক্ষা করে আছেন শিল্পীরা।
×