ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

বাঙালীর প্রিয় নায়ক

প্রকাশিত: ২১:৫৮, ১৯ নভেম্বর ২০২০

বাঙালীর প্রিয় নায়ক

হয়ত কেউ ভাবেননি হেমন্তের এই নীল কুয়াশায় তাঁকে হারাতে হবে। তাও আবার অতিমারীর এই চোড়া স্রোতে। যদিও বা তাঁকে আমরা শরীরে হারিয়েছে, কিন্তু তাঁর সত্তা! সে তো অমলিন, নশ^র! মহাকাল কোন ভাবেই তাকে গ্রাস করতে পারবে না। আমাদের কাছে সৌমিত্র অমর, তার মৃত্যু নেই! তিনি আছেন, ছিলেন এবং থাকবেন! একজন সীমাহীন সৃষ্টিশীল মানুষ হয়ে। আমাদেরই অসংখ্য চরিত্রের মঝে। সত্যজিৎ রায়ের তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’-এর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। সাল ১৯৫৮, কম যুগ আগের কথা নয়! এই চলচ্চিত্রের গল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড়। কারণ সিনেমা শুরুর কিছু পর আমরা দেখতে পাই গল্পের মোড় ঘোরে খুলনার রূপসা নদীর বাঁকে এসে! এক পিতার লগ্ন ভ্রষ্টা কন্যা এবং বন্ধুর বোনকে তাৎক্ষণিক বিয়ে করে একজন ত্রাণ কর্তার চরিত্রে অপু আমাদের হৃদয় জয় করেন। যাত্রার সেই শুরু থেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অপু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)-কে আমরা একজন নিরাকার সৃজনশীল মানুষ হিসেবে পেয়েছি। হয়ত তাই-ই থেকে যাবেন অনন্তকাল। সিনেমায় অভিষেকের পূর্বে তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত নাট্যকর্মী। মঞ্চনাটকে হৃদয়ের প্রশান্তি অনুভব করতেন। এ পথে যাত্রা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলা থিয়েটারের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ভাদুড়ির সংস্পর্শে আসাটা আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়’ এই শিশির কুমার ভাদুড়ি যে কিনা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এমন একজন বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন সৌমিত্রের যাত্রাসঙ্গী। পরবর্তীতে মঞ্চ থেকে সিনেমায় অভিনয় প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি একজন পেশাদার অভিনেতা আর সারা জীবন তাই হতে চেয়েছি।’ সত্যিই তাই সৌমিত্র মনেপ্রাণে তাই চেয়েছেন এবং করেছেনও বটে! তথাকথিত স্টারডাম কখনও তাকে স্পর্শ করেনি। প্রতিদান হিসেবে পেয়েছেন সীমাহীন শ্রদ্ধা-ভালবাসা এবং স্বীকৃতি। যার মধ্যে সত্যিই কোন খাদ নেই। শুধু কি অভিনয় করেছেন? সমানতালে কবিতা লিখেছেন, আবৃত্তি করেছেন, ছবি এঁকেছেন, পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, নাট্যমঞ্চ থেকে যাত্রার প্যান্ডেল কোথায়- ছিলেন না তিনি। রাজনীতিতেও কম যাননি! এত কিছুর প্রগাড় আবেগ কোথা থেকে এলো? উত্তর তাঁর মতোই সরল, ‘ছোটবেলা থেকে সৃজনশীল কাজের প্রতি দুর্নিবার এক আকর্ষণ কাজ করত আমার মধ্যে ।’ স্থির লক্ষ্যে ছিয়াশিটি বছর তিনি চলেছেন, কখনও ব্যালেন্স বা কম্প্রমাইজ করেননি। সত্যজিতের ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে তার অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা আড়াই শ’ ছাড়িয়েছে। সত্যজিৎ ছাড়া তপন সিনহ্া, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকদের সঙ্গে যেমন কাজ করেছে তেমনি অনিক দত্ত, অতনু ঘোষ, নন্দিতা রায়, সৃজিত মুখার্জি থেকে একেবারে বর্তমান প্রজন্মের সুজয় ঘোষের স্বল্প দৈর্ঘ্যওে অভিনয় করেছেন। বলতে পারেন তাঁর জীবনের ৭০ ভাগ সময় কেটেছে ক্যামেরার সামনে! সহশিল্পীদের কারও কারও কাছে তিনি ছিলেন এক রকম ‘পাথেয়’ এই যেমন মহানায়ক উত্তম কুমার আর তাঁর সম্পর্কের কথাই বলা যাক। দু’জনে একে অপরের প্রতি ছিলেন ভীষণ নির্ভরশীল। পেশাগত ঝামেলা কিংবা পারিবারিক অশান্তি দুজনই দুজনার কাছে শেয়ার করতেন। রোজকার সন্ধ্যার আড্ডায় কেউ কাউকে ছাড়তেন না। অথচ সাধারণের কি সাধারণ ধারণা এদের নিয়ে। সব সময় দুজনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাতেন। অথচ তাঁদের মধ্যে বিনয়, একে অপরের প্রতি সম্মান ছিল অবিচল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং উত্তম কুমারকে নিয়ে আলাদা আলাদা অভিব্যক্তি ভক্ত এবং বোদ্ধাদের মধ্যে। একজনকে বলা হতো, ‘মেধাবী অভিনেতা’ অপরজনকে ‘পপ আইকন’ এই ধরনের জোলো প্রসঙ্গে সৌমিত্রের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি সরাসরি বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং পরিষ্কার জবাবে বলে দেন, এসব উপাধি একদম পছন্দ করি না আমি। একজন ভাল অভিনেতা অবশ্যই মেধাবী হবেন, তার পা মাটিতেই থাকবে। আর মেধাবী না হলে কেউ এত সহজে জনপ্রিয়তা পায় না। হৃদয়ের ভেতরটা অন্তরীক্ষের মতো অসীম না হলে সহকর্মী সমন্ধে এই ধরনের উদার মন্তব্য করা যায় না। যা কেবল তাঁরাই পক্ষে সম্ভব! সৌমিত্রের সমসাময়িক অনেক অভিনেতা বম্বে (বর্তমান মুম্বাই) অভিনয়ের জন্য মরিয়া হলেও তাঁকে কখন দেখা যায়নি ওই রঙিন দরজায় গিয়ে কড়া নারতে। কেন? জবাবে বলেছিলেন, আমি জানি না কেন। আজকের দিনে হলে আমি হয়ত ওই ছবিগুলোতে কাজ করতে মানা করতাম না। তখন বয়স কম ছিল, বুদ্ধিশুদ্ধি কম ছিল, টাকার দরকারটাও সেভাবে বুঝিনি। সত্যি বলতে, হিন্দী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বাকিদের কাজ করতে দেখে নিজে কখনও উৎসাহ পাইনি। ওখানে গিয়ে কাজ করলে আমি কবিতা লিখতে পারতাম? মঞ্চে কাজ করতে পারতাম? হ্যাঁ, হিন্দী সিনেমায় কাজ করলে আমার নাম-যশ-খ্যাতি অনেকটাই বেড়ে যেত। কিন্তু আমি তো সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে অসংখ্য কাজ করেছি, আন্তর্জাতিকভাবে সেগুলো স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাকে লোভ দেখানোর আর কী-ই বা থাকতে পারে? এতটাই নির্মোহ ছিলেন আমাদের অপু, ফেলুদা, সুখেন্দু, অমল, অসীম, ডাঃ অশেক গুপ্ত কিংবা উদয়ন পণ্ডিতসহ অসংখ্য রূপের এই বর্ণচোরা! সৌমিত্রের এই অমরত্বের যাত্রা হয়ত অদৃষ্টের লিখন। এক জীবনে কোন চেষ্টাই কারও পক্ষে হয়ত সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ মানুষের আইকন তিনি। যেমন হলিউড-বলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা নাসির উদ্দিন শাহ্ তাঁর ভক্ত এবং অনুসারী। যদিও এমন অনেকে। একবার এক স্মৃতি কথায় বলেছিলেন, বার্লিনে আকিরা কুরোসাওয়ার একটি ফিল্ম দেখতে যাই আমরা। সিনেমা চলার সময় তিনি (নাসির উদ্দিন শাহ্ ) আসেননি। পরদিন সকালে জিজ্ঞেস করলাম আসোনি কেন। উত্তর দিল, ‘দাদা, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম জুতার ফিতাগুলো ঠিকমতো বাঁধার। কিন্তু তখনই শুনতে পেলাম টেলিভিশনে নাকি ‘অশনি সঙ্কেত’ দেখাবে। সত্যজিৎ রায়ের এই একটি সিনেমা আমি দেখিনি। কুরোসাওয়ার সিনেমা না হয় ভারতে গিয়ে দেখে নেয়া যাবে, কিন্তু ভিনদেশে বসে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখার মজা আমি কোথায় পাব?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাসির, সিনেমাটি তোমার কেমন লেগেছে? আমার কাজ ভাল লেগেছে?’ সে বলল, ‘দাদা, অভিনেতা হিসেবে নিজেকে তখনই সার্থক মনে করব যখন আপনি যেভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, আমিও কাউকে সেভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারব।’ এমনি করে অনন্তকাল তিনি অনুপ্রাণিত করবেন বাঙালী সংস্কৃতির সেবকদের। তাঁর রেখে যাওয়া সীমাহীন সৃষ্টির ভেতর থেকে, বাঙালীর প্রিয় নায়ক হয়ে।
×