ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুশান্ত মজুমদার

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রশান্তর উচ্চারণসৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রশান্তর উচ্চারণ

প্রকাশিত: ২১:৫৭, ১৯ নভেম্বর ২০২০

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রশান্তর উচ্চারণসৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রশান্তর উচ্চারণ

বেশি অসুস্থ হওয়ার চল্লিশটা দিন মিডিয়া খুঁজে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থার খবর জানার চেষ্টা করেছি। পনেরো নবেম্বর দুপুরে সর্বশেষ টিভির স্ক্রলে দেখি, লাইফ সাপোর্টেও তিনি আর সাড়া দিচ্ছেন না। বুঝলাম, বেলভিউ ক্লিনিকের চিকিৎসকদের শেষ বলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। মন খারাপ করে অফিস থেকে বেরিয়ে ভাবি-রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সময় কাটিয়ে দিই। কয়েক মিনিট পরে আমার ভাগ্নে সব্যসাচী জনকণ্ঠ অফিস থেকে ফোন করে জানায়-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই। আনন্দবাজার জানিয়েছে। স্থির দাঁড়িয়ে পড়ি। ভেতর থেকে অবাধ্য কান্না উথলে উঠছে। চল্লিশটা দিনই এত অসাধারণ চরিত্রের অভিনয় ছাপিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রশান্ত চরিত্রের ‘বাবা’ ডাক বার বার চোখের সামনে ভেসে এসেছে। সত্যজিৎ রায়ের সময়জয়ী চৌদ্দটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের চলচ্চিত্র আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় বোধের প্রতিটি ভগ্নাংশ ব্যবহার করে অন্যদের মতো আমিও দেখিছি। সত্যজিৎ নির্মিত বিভিন্ন চরিত্রে তাঁর স্মরণীয় অভিনয় থাকা সত্ত্বেও কেন জানি ‘শাখা-প্রশাখা’ সিনেমায় প্রশান্ত চরিত্রের অভিনয় কিছুতেই ভুলতে পারি না। বার বার অনুভূতি-উপলব্ধি-জাগরণ-চৈতন্য যা কিছু ধারণার অংশ সব তছনছ করে দিয়েছে। সত্যজিৎ রায় অসুস্থ হলে আউটডোরে যাওয়ার শারীরিক অক্ষমতারের জন্য ‘গণশত্রু’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’ ইনডোর ছবির সৃষ্টি করেছিলেন। এক বয়োবৃদ্ধ চাকরিজীবনে সততার পরিচয় দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। টেবিলের নিচ দিয়ে কখনও তিনি হাত বাড়িয়ে দেননি। আঙ্গুল ফুলানোর চেষ্টাই করেননি। তাঁর চার ছেলের মধ্যে মেজ ছেলে প্রশান্ত ছিল মেধাবী। বিদেশে লেখাপড়া শিখতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর শিক্ষা-জীবন অসমাপ্ত থেকে যায়। অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় তাঁর বাবার সংসারে দিন কাটে। সে মিউজিক শোনে। মৃত্যুপথযাত্রী অসুস্থ ঠাকুরদাদাও উপরের একটা রুমে বাকি আয়ু যাপন করেন। বাকি তিন ছেলে থাকে কলকাতায়। বড় ছেলে অফিসের উপরের সাহেব। তাঁর সচ্ছল সংসার। সেজ ছেলে জুয়া খেলে অর্থ ধ্বংস করে। স্ত্রীর গয়নাও খরচ করেছে সে। তাঁর সংসারে এক ছেলে। ছোট ভাই চাকরি করতে গিয়ে ঘুষ লেনদেন দেখে কাজ ছেড়ে দিয়ে শেষাবধি নাটকে অভিনয় করতে মনস্থ করে। তাঁর প্রেমিকা বিয়ের জন্য অপেক্ষায় আছে। হঠাৎ অসুখে আক্রান্ত হলে বাবাকে দেখার জন্য কলকাতার তিন ছেলে মফস্বলে এসে হাজির। বাবার জীবনাবসান হলে তাঁর সম্পত্তির ভাগ পেতে বড় ও সেজ ছেলে মনে মনে আকাক্সক্ষা করে। কিন্তু এই আশা তাঁদের পূরণ হয় না যখন ডাক্তার জানান-তাঁঁদের বাবা ক্রমশ আরোগ্য লাভ করছেন। খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে বড় ভাইয়ের দুর্নীতির প্রসঙ্গ তোলে সেজ ভাই। এলোমেলো মাথার চুল, মুখময় দাড়ি, গায়ে একটা চাদর জড়ানো মেজ ছেলে প্রশান্ত বলে, ‘বাবা ভাল হয়ে উঠবেন।’ গোটা সিনেমায় এই প্রথম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ডায়ালগ বললেন। হাঁটা-চলা, মৌন মুখাবয়ব দিয়ে অসাধারণ সব অনুচ্চারিত কথা প্রকাশ করা যায় তা রুপালি পর্দায় এই নক্ষত্র ছাড়া আর কে পারে! নিদ্রাশূন্য ছোট ছেলে বাড়ির উপরের রুমে গিয়ে ঠাকুরদাদাকে পেয়ে তাঁর থেকে রেহাই খুঁজতে ঢুকে পড়ে মেজ ভাইয়ের রুমে। আলো-অন্ধকারের নিষ্প্রভ রুমে প্রশান্ত চরিত্রের সৌমিত্র সোফার হাতলে আঙ্গুলের টোকা দিয়ে দিয়ে চোখ বুজে গভীর মনোযোগে মিউজিক শুনছিল। ছোট ভাই নিঃশব্দে গিয়ে বসে। কথা বলে। সত্যজিতের সিনেমায় কখনই কোন চরিত্র বেশি ডায়ালগ বলে না। উচ্চৈঃস্বরের কথা থাকে না। ‘কাজের মানুষ এখানে কেন’-দ্বিতীয় উচ্চারণ শোনা গেল প্রশান্তর মুখে। দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বুঝি প্রাণ ভরে উঠেছিল প্রশান্তর। প্রগাঢ় স্বরের শব্দে মিউজিক, আলো-অন্ধকারের রুম, গোটা বাড়ি, বাইরের চরাচর যেন মুখ বাড়িয়ে বুঝতে চাইল সৌমিত্রের কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি। একা প্রশান্ত ছাড়া বিশ্ব-জগত, ঘুমন্ত মানুষ, নিঃস্তব্ধ প্রকৃতি, নির্জন রাত সব সব স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সিনেমার শেষে কলকাতাবাসী তিন ছেলে, দুই ছেলে বউ, এক নাতি সুস্থ হয়ে ওঠা বাবার কাছ থেকে বিদায় নিতে যায়। রুমে আগে ঢোকে নাতি। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে দাদু জানতে পারেন ছেলেদের দুর্নীতির প্রসঙ্গ। নাতি বলে, সে এক নম্বরি, দুই নম্বরি সব জানে। বাবা ছেলের নীতিবিরুদ্ধ উপার্জন সম্পর্কে জ্ঞাত হন। আরেক ছেলের অসদাচরণ। বড় শহরের ছেলেরা চলে গেলে ‘এ আমি কি শুনলাম’ কপাল চাপড়ানো বাবার রুমের দরজার কাছে এসে প্রশান্ত ডাক দেয়Ñ‘বাবা’। সৌমিত্রের এই উচ্চারণ বিশ্লেষণের জন্য কোন শব্দ দিয়ে ধরা যাবে না। এক বাবার জন্য হৃদয় মন্থন করা চৈতন্যময় সত্তার এমন অকৃত্রিম স্বর কেবল সৌমিত্র সৃষ্টি করতে পারেন। বাক্যহারা হয়ে যাই। ‘ও প্রশান্ত, আয়। তুই তো আমার সব।’ বাবার কাছে প্রশান্ত চাদরের নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে দেয়। সৌমিত্রের ওই বাড়িয়ে দেয়া হাত দেখে সিনেমা কান্নায় ডুবে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে এলে স্পষ্ট বুঝি-প্রশান্ত চরিত্রটি মাত্র সৌমিত্র ছাড়া কেউই করতে পারবেন না। অভিনয় শিল্পের কালজয়ী কীর্তিমান এই পুরুষ স্মরণের আলোয় দূর ভবিষ্যতেও সর্বক্ষণ জীবিত থাকবেন।
×