ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

আবারও করোনার থাবা বাংলাদেশ ও বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ১৮ নভেম্বর ২০২০

আবারও করোনার থাবা বাংলাদেশ ও বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে

মরণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্ব থমকে গিয়েছিল। সবকিছুতেই বিরাজ করছিল স্থবিরতা। এর প্রভাবে নির্মল বিনোদনের মাধ্যম ক্রীড়াঙ্গনও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। গত মার্চে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল সবধরনের খেলাধুলা। বাংলাদেশেও সব ধরনের খেলা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে আবারও মাঠে ফিরেছে প্রায় সব ধরনের খেলাধুলা। কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে বাংলাদেশ ও বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে আবারও আঘাত হেনেছে ঘাতক করোনাভাইরাস। কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ আরও মারাত্মক হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে লোমত মিলতে শুরু করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপে আরও দ্রুত করোনা ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থাও একই। প্রথম ধাপের চেয়ে এখন প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যার রেকর্ড হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়ানক রূপ নিতে পারে! ইতোমধ্যে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ভালভাবেই জেঁকে বসেছে ছোঁয়াছে এই ভাইরাস। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও নেপাল জাতীয় ফুটবল দলের মধ্যে দুই ম্যাচের আন্তর্জাতিক ফুটবল সিরিজ শেষ হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে হওয়া এই আসরেও হানা দিয়েছে করোনা। বাংলাদেশ দলের ব্রিটিশ কোচ জেমি ডে করোনা পজিটিভ হওয়ায় দ্বিতীয় ম্যাচে লাল-সবুজের দলের ডাগআউটে থাকতে পারেননি। কয়েকজন ফুটবলার করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তাদেরকে ছাড়াই ঢাকা আসে হিমালয়কন্যারা। কিন্তু বাংলাদেশে আসার পরও দলটির ফুটবলার আক্রান্ত হয়েছেন। সফলভাবে সিরিজ শেষ হলেও এখন বাংলাদেশ দলের ফুটবলার ও কর্মকর্তারা অনেকটাই শঙ্কার মধ্যে আছেন। অনেকেই শঙ্কা করছেন, ফুটবলারদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। শঙ্কা সত্যি হলে, আগামী ৪ ডিসেম্বর কাতারের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ বাছাই ফুটবল খেলা কঠিন হয়ে পড়বে বাংলাদেশের। নেপালের বিরুদ্ধে সিরিজের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে করোনা পরবর্তী প্রথম কোন আন্তর্জাতিক খেলা হয়েছে। এই পথ ধরে ক্রিকেটও স্বপ্ন বুনছে আন্তর্জাতিক আসরে ফেরার। এরই প্রস্তুতি হিসেবে আগামী ২৪ নবেম্বর থেকে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে হবে বঙ্গবন্ধু টি২০ লীগ। কিন্তু যে হারে করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে তাতে শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টটি সফলভাবে আয়োজন সম্ভব হবে কিনা এটা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন আগে মারা গেছেন রেফারি আব্দুল আজিজ। আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বাংলাদেশ বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন। বাংলাদেশ টেস্ট দলের অধিনায়ক মুমিনুল হক ও আরেক তারকা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও ছোঁয়াছে এ ভাইরাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজাও আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ্য হয়েছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে চলছে ইউরো ও উয়েফা নেশ্ন্স কাপের বাছাইপর্ব। দক্ষিণ আমেরিকায় চলছে বিশ্বকাপ বাছাইযজ্ঞ। সবখানেই হানা দিয়েছে করোনা। ইতালির কোচ রবার্টো ম্যানচিনি আক্রান্ত হওয়ায় তাকে ছাড়াই খেলতে হচ্ছে চারচারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। ইউরোপের অন্যান্য দলেও করোনা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। লিভারপুলের মিশরীয় তারকা মোহাম্মদ সালাহ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। ব্রাজিলের কয়েকজন ফুটবলারও একই কারণে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। শেষ মুহূর্তে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন উরুগুয়ের তারকা ফুটবলার লুইস সুয়ারেজ। যে কারণে আজ সকালে হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপ বাছাই ফুটবলে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলতে পারেননি তিনি। অস্ট্রিয়ায় আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া জাতীয় ফুটবল দলের ছয়জন খেলোয়াড়সহ একজন কোচিং স্টাফ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তারকা স্ট্রাইকার সন মিনকে নিয়ে তাই মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছে তাঁর ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার। করোনা আক্রান্ত হওয়া তারকা ফুটবলারদের মধ্যে আরও আছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, নেইমার, জ¬াতান ইব্রাহিমোভিচসহ অনেকে। এসব ফুটবলার সুস্থ হলেও আবারও সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ ও বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন আবারও করোনার কারণে হুমকির মধ্যে আছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আবারও হয়ত সব ধরনের খেলা স্থগিত করা লাগতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। ক্রীড়াঙ্গনের তারকারাও এর বাইরে নন। বাংলাদেশের ক্রিকেট সুপারস্টার মাশরাফি বিন মুর্ত্তজা, সাকিব আল হাসান থেকে শুরু করে সবাই এ যজ্ঞে শামিল আছেন। তেমনি বর্তমানে বিশ্ব ফুটবলের সেরা দুই তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিওনেল মেসি থেকে শুরু করে সবাই সোচ্চার হয়েছেন। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে গত মার্চে সকলকে একটি ‘দল’ হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এ জন্য ‘দ্য সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন’ নামক দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়েছেন তারকা এ ক্রিকেটার। এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড পেজে এক ভিডিও বার্তায় সাকিব লিখেছিলেন, ‘নিজেদের প্রথম প্রজেক্ট হিসেবে ‘দ্য সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন’ সম্পৃক্ত হয়েছে ‘মিশন সেভ বাংলাদেশ’র সঙ্গে। করোনাভাইরাসের মতো একটি মহামারী চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের গরিব দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এই যৌথ উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য।‘ বার্তায় সাকিব বলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। আশা করি দেশ ও দেশের বাইরে সবাই সুস্থ ও নিরাপদ আছেন। করোনাভাইরাসের কারণে পুরো পৃথিবী একটি বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আমাদের দেশে অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ রয়েছে। এ মুহূর্তে তাদের সাহায্যের খুবই প্রয়োজন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের সকলের একাত্মতা, আমরা যদি একটা দল হিসেবে কাজ করতে পারিÑতাহলেই কেবল এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ অথবা মুক্তি পেতে পারবো।’ সাকিব ছাড়াও মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, মোসাদ্দেকসহ প্রায় সবাই করোনার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন; এই দুঃসময়ে গরিব দুখীদের সহায়তা করছেন। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ৫১ কোটি টাকার আর্থিক অনুদান দিচ্ছে সৌরভ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) বিবৃতিতে বিসিসিআই জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রাণ তহবিলে ৫১ কোটি টাকা দান করার সিদ্বান্ত নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলী, সচিব জয় শাহ ও বোর্ডের বাকি সদস্যরা। দেশের জরুরী পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও করোনা সংক্রান্ত গবেষণায় সহায়তা করাই প্রধান উদ্দেশ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন ভারতের মাস্টার ব্লাস্টার শচীন টেন্ডুলকার। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সাহায্য হিসেবে ৫০ লাখ রুপি দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বর। টেন্ডুলকার ছাড়াও তাঁর সাবেক সতীর্থ, বর্তমানের বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলী করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। তিনি তাঁর রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সরকারী স্কুলগুলোর দরিদ্র শিশুদের জন্য ৫০ লাখ রুপির সমপরিমাণ চাল সরবরাহের কথা ঘোষণা দিয়েছেন। এগিয়ে এসেছেন বাংলার তারকা ক্রিকেটার লক্ষ্মী রতন শুক্লাও। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ লক্ষ্মী তাঁর তিন মাসের বেতন ও পেনশন দান করে দিয়েছেন। এছাড়াও ইরফান পাঠান ও ইউসুফ পাঠান বারোদা পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতরকে চার হাজার মাস্ক দিয়েছেন। ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি পুনের এক এনজিওর মাধ্যমে এক লাখ টাকা দান করেছেন। করোনার থাবায় খেলা বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো। যে কারণে খেলোয়াড় ও স্টাফদের নিয়মিত বেতনও হুমকির মুখে পড়েছে। এমন অবস্থায় অনেকগুলো ক্লাব বেতন কম দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতোমধ্যে স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সিলোনা লিওনেল মেসি-লুইস সুয়ারেজদের ৩০ শতাংশ বেতন কেটে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ইতালিয়ান পরাশক্তি জুভেন্টাসও এই পথ অবলম্বন করে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো-পাওলো দিবালাদের সঙ্গে আলাপ করে তুরিনের ওল্ডলেডিরা করোনাআক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা গেছে, চার মাসের বেতন নিবেন না রোনাল্ডোরা। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকারও বেশি। এর আগে ব্যক্তিগত তহবিল থেকেও রোনাল্ডো দিয়েছেন ৯ কোটিরও বেশি টাকা। মেসিও সমপরিমাণ টাকা দিয়েছেন। ব্যক্তি খাত থেকে দেয়ার পর এবার রোনাল্ডো-মেসিরা নিজেদের বেতনের টাকা দিয়ে মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন।
×