ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবাসস্থলে যাতায়াতে প্রতিদিন ১৫ লিটার তেল

সিএমপির জ্বালানি ব্যবহারে লুটপাট

প্রকাশিত: ২১:১১, ১৮ নভেম্বর ২০২০

সিএমপির জ্বালানি ব্যবহারে লুটপাট

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সরকারী গাড়িতে জ্বালানি তেলে বরাদ্দ নিয়ে অর্থ লুটপাট চলছে পুলিশ বিভাগে। পুলিশের এ ধরনের ব্যাপক পরিমাণ জ্বালানি তেল ব্যবহার হয় না এমন তথ্য পাওয়া গেছে চালকদের পক্ষ থেকে। প্রতিমাসে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) এক তথ্যে জ্বালানি তেলের ব্যবহার বরাদ্দ পাওয়া গেছে সাড়ে ৪ হাজার লিটার যার বাজার মূল্য ৪ লাখ তিন হাজার টাকা। সেপ্টেম্বরের আগে ছিল পৌনে ৬ হাজার লিটার। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এ ধরনের সরকারী তেল লুটপাটের পরিসংখ্যান ও অভিযোগ পাওয়া গেছে থানা পর্যায়ে কর্মরত এসআই ও কনস্টেবলদের কাছ থেকে। প্রশ্ন্ উঠেছে, একজন ডিসি মাসে ৪৫০ লিটার বা ৪০ হাজার টাকার জ্বালানি তেল কিভাবে ব্যবহার করেন চার চাকার গাড়িতে। আবার একজন কনস্টেবল প্রতিদিন মাত্র দেড় লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহার করার নির্দেশনা ছিল এক আদেশে। কিন্তু থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ও ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টের সারাদিনে মাত্র দুই লিটার করে অকটেন বা পেট্রোল ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। ফলে কর্মক্ষেত্র ঢিলেঢালা ও মামলার তদন্ত দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সরকারী সাপোর্ট না পাওয়ায়। এদিকে, সরকারী বরাদ্দকৃত জ্বালানি তেল ব্যবহারের মাধ্যমে পুলিশের সার্জেন্ট ও এসআইদের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয় এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, ডিসি থেকে শুরু করে সহকারী কমিশনার পর্যন্ত সিএমপিতে কর্মরত কর্তাদ্বয় প্রত্যেকে কিভাবে প্রতিদিন ১৫ লিটার তথা মাসে সাড়ে ৪শ’ লিটার বা ৩৬ হাজার টাকার জ্বালানি তেল ব্যবহার করছেন। এ ব্যাপারে সিএমপির এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, মূলত সিএমপি কমিশনার থেকে শুরু করে সহকারী কমিশনার পর্যন্ত কর্মকর্তাদের গাড়িগুলো অলস বসে থাকে। বলতে গেলে এসব গাড়ি প্রতিদিন ১০/১৫ কিলোমিটারও চালানো হয় না। এক্ষেত্রে চালকদের তথ্য সঠিক। আবার থানার অফিসার ইনচার্জরা দাফতরিক কাজে সিএমপির সদর দফতরে না গেলে শুধুমাত্র থানা থেকে তার আবাসস্থলেই যাতায়াত করে। এক্ষেত্রেও মাসে ৫৪০ লিটার তথা গড়ে প্রতিদিন ২০ লিটার তেলের প্রয়োজন নেই। চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশ কমিশনারের পক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) আমেনা বেগম যে আদেশে স্বাক্ষর করেছেন সে অনুযায়ীও পুলিশের ডিসি থেকে ওসি পর্যন্ত তেল বরাদ্দের প্রয়োজন পড়ে না। তবে ইন্সপেক্টর থেকে শুরু করে এএসআই পর্যন্ত সরকারী মোটরসাইকেলগুলো প্রতিদিন দেড় লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহারের যে অনুমতি দেয়া হয়েছে তাতে মামলা তদন্ত করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি আসামি ধরতে অভিযান চালানোও সম্ভব নয়। জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৭ মে সিএমপির অফিস স্মারক নং-১৪৭৬(৫০)বি/সিএমপি এক অফিস আদেশে ডিসিদের জন্য সরকারী গাড়িতে শুধু সরকারী কাজে ব্যবহারের নিমিত্তে সাড়ে ৪শ’ লিটার তেল দেয়া হয় একমাসের ব্যবহারের জন্য। যা প্রতিদিন গড়ে ১৫ লিটার। অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার মাসে ৪শ’ লিটার, সহকারী পুলিশ কমিশনার (জোনাল/ট্রাফিক) ৫৪০ লিটার, অন্যান্য সহকারী পুলিশ কমিশনার মাসে ৪শ’ লিটার, অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাসে ৫৪০ লিটার বা প্রায় ৪৯ হাজার টাকার তেল ব্যবহার করে আসছিলেন ২০০৯ সালের ৭ মে থেকে চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ২০১৪ সালের পর থেকে থানাকেন্দ্রিক মোবাইল ডিউটির জন্য মাসে ৬শ’ লিটার বা ৫৪ হাজার টাকার তেল বরাদ্দ পেয়েছিল। ২০১৪ সালের পূর্বেও মোবাইল ডিউটির জন্য মাসে ৬শ’ লিটার তেল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সারাদিন অলস বসে থাকা এ্যাম্বুলেন্সের জন্য মাসে ৫২৭ লিটার প্রায় ৪৭ হাজার টাকার জ্বালানি তেল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ডাবল ও সিঙ্গেল কেবিনের পিকআপের জন্য মাসে ৪৩৮ লিটার বা প্রায় ৪০ হাজার টাকার, সিএমপির সকল ধরনের বাসের জন্য মাসে ৬২৮ লিটার তেল তথা ডিজেল প্রায় ৪১ হাজার টাকার জ্বালানি বরাদ্দ দেয়া হয়। অপরদিকে, সরকারী মোটরসাইকেল ব্যবহারেও তেল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পরিদর্শক থেকে শুরু করে ডাক ডিউটি পালন করা সিভিল কর্মচারীদের জন্যও। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, পরিদর্শকরা (শহর/যানবাহন) মাসে মাত্র ৭৫ লিটার, যা গড়ে প্রতিদিন সোয়া দুই লিটার হিসাবে প্রায় ৭ হাজার টাকা জ্বালানি তেল ব্যবহারের অনুমতি ছিল। অন্যান্য পরিদর্শকদের ক্ষেত্রে মাসে ৬০ লিটার তথা ৫ হাজার ৪শ’ টাকার জ্বালানি তেল ব্যবহারের অনুমতি ছিল। এসআই, সার্জেন্ট, টিএসআই, এএসআই, এটিএসআই এবং থানার কনস্টেবলদের জন্য মাসে মাত্র ৪৫ লিটার বা ৪ হাজার টাকার তেল ব্যবহারের নির্দেশনা ছিল। সে অনুযায়ী গড়ে পুলিশের এ সব সদস্য প্রতিদিন মাত্র দেড় লিটার তেল মোটরসাইকেলে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। অপরদিকে, ট্রাফিক বিভাগের এসআই, সার্জেন্ট, টিএসআই, এএসআই, এটিএসআইরা মাসে ৬৫ লিটার বা প্রায় ৬ হাজার টাকার জ্বালানি তেল ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে। পুলিশের এক দফতর থেকে অন্য দফতরে অথবা বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী দফতরে চিঠিপত্র আদান প্রদানের জন্য ডাক ও দাফতরিক ডিউটিতে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের জন্য মাসে ৪৫ লিটার বা ৪ হাজার টাকার তেল ব্যবহারের নির্দেশনা ছিল। এছাড়াও প্রত্যেকটি মোটরসাইকেলে মাসে ১ লিটার মবিল তথা ভিসকো মবিল যার বাজারমূল্য প্রায় ৫শ’ টাকা ব্যবহারের অনুমতি ছিল। প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিটি মোটরসাইকেলে প্রতি দুইমাস অন্তর মবিল পরিবর্তনের নিয়ম রয়েছে। করোনাকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সরকারের অর্থ সাশ্রয় করতে নতুন এক নির্দেশনা দিয়েছে। এ নির্দেশনায়ও সরকার তেল লোপাটের বিপরীতে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে ডিসি থেকে শুরু করে থানার অফিসার ইনচার্জদের বিরুদ্ধে। কর্মকর্তা কর্মচারীদের নামে সরকারী যানবাহন সরকারী কাজে ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ আদেশ পালনের জন্য গত ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের মাসিক জ্বালানি তেল ব্যবহারের এ নির্দেশনায় স্বাক্ষর করেছেন সিএমপি কমিশনারের পক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) আমেনা বেগম। এ আদেশে দেখা গেছে, সকল বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনাররা মাসে ৩৮০ লিটার বা গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৩ লিটার জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে পারবেন। জ্বালানি তেলের বর্তমান দাম অনুযায়ী এসব কর্মকর্তা ৩৪ হাজার টাকার তেল ব্যবহার করতে পারবেন প্রতিমাসে। একই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারগণ মাসে ৩৫০ লিটার, সহকারী কমিশনার (জোনাল/ট্রাফিক) মাসে ৩৪০ লিটার, অন্যান্য সহকারী কমিশনার মাসে ৩শ’ লিটার, ১৬ থানার অফিসার ইনচার্জ মাসে ৪শ’ লিটার, মোবাইল ডিউটি পালন করা গাড়িগুলোতে মাসে ৪৫০ লিটার, ২০১৪ সালের পূর্বের তথা পুরাতন গাড়িগুলোতে মাসে ৫১০ লিটার, অলস বসে থাকা এ্যাম্বুলেন্সে মাসে ৪৫০ লিটার, ডাবল ও সিঙ্গেল কেবিনের পিকআপে মাসে ৪শ’ লিটার, বাসে মাসে ৫শ’ লিটার ডিজেল, ট্রাকে মাসে ৫৫০ লিটার ডিজেল ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। এদিকে, সরকারী মোটরসাইকেলগুলোতে শহর ও যানবাহনের পরিদর্শকদের জন্য মাসে ৫০ লিটার, অন্যান্য পরিদর্শকদের জন্য মাসে ৪০ লিটার, এসআই, সার্জেন্ট, টিএসআই, এটিএসআই ও থানার কনস্টেবলদের জন্য মাসে ৩০ লিটার জ্বালানি তেল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগের এসআই, সার্জেন্ট, টিএসআই, এএসআই ও এটিএসআইদের জন্য মাসে ৪০ লিটার জ্বালানি তেল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দাফতরিক চিঠিপত্র আনা নেয়ার ক্ষেত্রে মোটরসাইকেলের বিপরীতে ৪০ লিটার তেল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রতিমাসে মোটরসাইকেলে ব্যবহারের জন্য একটি করে ভিসকো মবিল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এমন আদেশের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে সদয় অবগতি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিএমপি কমিশনারের কাছে। এছাড়াও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এ্যান্ড অপারেশন), ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, সিএমপির সকল উপ পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার, সকল সহকারি পুলিশ কমিশনার, অফিসার ইনচার্জ, টিআই (প্রশাসন ও ট্রাফিক)দেরকে অবহিত করার জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে।
×