ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হিমালয় থেকে গঙ্গায়

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ১৮ নভেম্বর ২০২০

হিমালয় থেকে গঙ্গায়

মানুষ কত বড় মানুষ হতে পারে তার প্রমাণ সৌমিত্র চট্টোপধ্যায়। শিল্পী কত বড় শিল্পী হতে পারে তারও প্রমাণ সৌমিত্র চট্টেপধ্যায়। আমার খুব কাছের মানুষ, খুব প্রিয় মানুষ সৌমিত্র চট্টোপধ্যায়। স্বধীনতা পরবর্তী শখ ছিল কলকাতা যাব। কলকাতার ইট-কাট, রাস্তা-ঘাট দুচোখ ভরে দেখব। স্বধীনতা যুদ্ধের সময় দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠ যেমন কানের ভেতরে বাজত তেমনি উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমিত্র চট্টোপধ্যায় আমার বুকের ভেতর বসবাস করত। তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করা এবং টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়া ঘুরে ঘুরে দেখা ছিল আমার স্বপ্নের একটা বড় অংশ। ১৯৭৩ সালে সমরেশ বসুর গল্প নিয়ে ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবি বানাতে গিয়ে ঠিক করলাম উজ্জ্বল, ববিতাকে নিয়ে ছবিটা বানাব। যে কোন কারণেই হোক সেই পরিকল্পনা পাল্টতে হলো। চলে গেলাম কলকাতায়। সমরেশদাকে বললাম- অপর্না সেন আর সৌমিত্র চট্টোপধ্যায়কে নিয়ে ছবিটা বানাব। সমরেশদা দুজনের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরে জানলাম সলিল সেনের পরিচালনায় এই একই উপন্যাস নিয়ে কলকাতায় ছবি হচ্ছে। সেই ছবির নায়ক নায়িকা এরা দুজন। ভাবলাম তাহলে বম্বে চলে যাই। জয়তির চরিত্রে জয়া ভাদুড়িকে নেই। জয়া তখনও জয়া বচ্চন হননি। লেখক তরুণ কুমার ভাদুড়ির মেয়ে। আমি আর সমরেশদা দু’জন মিলে বম্বে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। সেই সন্ধ্যায় বিশ^রূপায় গেলাম নাটক দেখতে বিমল বিত্রের আসামি হাজির। এই নাটকে আরতি ভট্টাচার্যের অভিনয় দেখলাম। মাথা গুলিয়ে গেল। ঠিক করলাম আরতিকে দিয়েই অভিনয় করাব। ফিরে যাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে। তিনি ছিলেন মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের অভিনেতা। কবি ছিলেন, সম্পাদক ছিলেন, আবৃত্তিকার ছিলেন। আমাদের গর্ব করার মতো অভিনেত্রী ববিতা যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘অসনি সংকেত’ ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন, তেমনি তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ তিনি সন্ধ্যা রায়ের বিপরীতে একটি চোরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এমন কত ধরনের কত শত অভিনয় করেছিলেন যার ইয়োত্তা নেই। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করার সূত্রে প্রতি সপ্তাহে ‘টালিগঞ্জের কথা’ লিখবার সুযোগে আমাকে প্রতি মাসে প্রায় ৪ বার কলকাতায় যেতে হতো। ছবি বিশ^াস, পাহাড়ী সান্যাল, কালী ব্যানার্জী, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবি, অপর্ণা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক, বিশ^জিৎ, সন্ধ্যা রায়, তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটক, হেমন্ত মুখোপধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখার্জী এদের সঙ্গে যেমন নিয়মিত যোগাযোগ হতো, তেমনি সৌমিত্রদার সঙ্গে যোগাযোগটা একটু বেশি হতো। হৈমন্তী শুক্লা থাকে গলফ গ্রীনে তার ফ্ল্যাটে। এই গলফ গ্রীনেই থাকতেন সৌমিত্রদা। হৈমন্তীর জন্য ঢাকা থেকে মিষ্টি নিয়ে গেলে সৌমিত্রদার জন্যও নিয়ে যেতাম। সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমারের জন্য পাঞ্জাবি নিয়ে গেলে সৌমিত্রদার জন্যও নিয়ে যেতাম। সত্যজিৎ রায় গম্ভীর মুখে ভরাট কণ্ঠে বলতেন এসব আবার কেন? উত্তম কুমার তার সেই পরিচিত মিষ্টি হাসি দিয়ে বলতেন-আপনি কি কখনই খালি হাতে আমার কাছে আসতে পারেন না? সৌমিত্রদা প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে বলতেন-আপানার পাঞ্জাবি আমি নিলাম, তবে আগামীকাল আপনি আমার অতিথি হয়ে আমার নাটক দেখবেন। এখনও মনে আছে সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার শেষ দেখা আমি আমার লেখা ‘চিরকালের মহানায়ক উত্তম কুমার’ বইটি তার হাতে দিয়ে বলেছিলাম, আপনি অনুমতি দিলে আপনাকে নিয়ে একটি বই লিখবো। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন আমিতো খুব সাধারণ একজন শিল্পী। দর্শককে এমন আর কি দিতে পেরেছি। তার মতো এত বিশাল মাপের একজন মানুষের এতটা বিনয়ই মানায়। তিনি ছিলেন হিমালয়ের মতো একজন শিল্পী। শিল্পের শাখায় শাখায় ছিল তার বিচরণ। গঙ্গার পানি যেমন আবিরাম জলধারা হয়ে বয়ে চলেছে তেমনি ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম নেয়া ও ২০২০ সালের ১৫ নবেম্বর পরপারে চলে যাওয়া এই সৌমিত্র চট্টোপধ্যায় যা দিয়ে গেছেন- তার সৃজনশীলতার মহাসৃষ্টির যে বিশাল ভাণ্ডার তা বাংলা, বাঙালী এবং এই বাংলাদেশকেও সমৃদ্ধ করে রাখবে শত সহস্ত্র বছর। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি। লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
×