ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌমিত্রের বিদায়

প্রকাশিত: ২০:৫২, ১৮ নভেম্বর ২০২০

সৌমিত্রের বিদায়

মৃত্যু সব মানুষের জন্য অমোঘ সত্য হলেও কিছু কালজয়ী শিল্পীর বর্ণময় কর্মদ্যোতনায় বেঁচে থাকার যে মহিমা তা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন। সারা বাংলা তোলপাড় করা এই অভিনয় শিল্পী অমরত্বের স্বর্ণ সিংহাসনে যে মাত্রায় নিজেকে অভিষিক্ত করলেন তা এক কথায় অনুপম। ৮৬ বছরে শেষ করলেন গৌরবময় এক কালের স্বর্ণ অধ্যায়। সুদীর্ঘ জীবনের আলোকময় জগতকে নানা মাত্রিকে পরিপূর্ণ করা অসাধারণ এই বাচিক শিল্পীর কবিতা আবৃত্তি দর্শক-শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অভিভূত করে রাখত। শৈল্পিক জীবনের নান্দনিক চর্চায় কত সমৃদ্ধ আঙিনায় নিজের দক্ষতাকে সর্বোচ্চ আসনে নিয়ে গেছেন যে মাত্রায়, সেখানে তিনি অপরাজেয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে ‘অপুর সংসারে’ এই অবিস্মরণীয় অভিনয় শিল্পীর শুভাগমন। সেই শুরু। এরপর একের পর এক অভিনীত চরিত্রগুলো আজও দর্শক-শ্রোতার হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে অভিনয়ের আঙিনায় উন্নত শিরে দাপিয়ে বেড়ানো সৌমিত্র করোনায় আক্রান্ত হয়ে মরণের ওপারে সমর্পিত হয়ে অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করা ছাড়াও শিল্প ও নান্দনিকতায় জীবনভর নিজেকে উজাড়ই করে দেননি, তার চেয়েও বেশি যোগ্যতম প্রমাণ করে দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন পেতে বসেছেন। বাংলার আর এক মহানায়ক উত্তম কুমারের সমসায়িক এই কিংবদন্তি কি অসম তেজস্বিতা আর অসাধারণ শিল্প দক্ষতায় নিজের জায়গাটি শক্ত করতে নিরন্তর বদলেছেন নিজেকে। বাংলাদেশের মানুষের কাছেও এই অমর অভিনয় শিল্পী নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন তার অভাবনীয় শৈল্পিক শৌর্যে। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশের অভিনয় শিল্পী ববিতার যে যুগল নান্দনিক অভিগমন, তা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাপ্তি। শর্মিলা ঠাকুরও তার প্রথম ছবি ‘অপুর সংসারে’র অপুকে মনে রেখেছেন এক অনন্য অভিনয় দক্ষতার প্রতীক হিসেবে। অপর্ণা সেনও তার শোকাচ্ছন্ন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, যার বিপরীতে নায়িকা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা ছাড়াও ব্যক্তি সৌমিত্রকে বোঝার ব্যাপারটিও ছিল গভীর। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা লেখা ও সাহিত্য চর্চায় সৃজন ও মনন দ্যোতনার যে অভাবনীয় সংমিশ্রণ, সেখানে এই অনন্য নান্দনিক সত্তা তার সক্ষমতাকে কোন পর্যায়ে অলঙ্কৃত করেন, তা অভিভূত হওয়ার মতো। কিছু ক্ষণজন্মা মহামানব চিরদিন বেঁচে থাকেন তার অনুরাগী এবং শুভানুধ্যায়ীর মাঝে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও সে মাত্রারই একজন অবিস্মরণীয় শিল্পিত মানুষ, যাকে মনে রাখাটাই তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
×