ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষায় কঙ্কালের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সরবরাহ নেই পর্যাপ্ত

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ১৭ নভেম্বর ২০২০

বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষায় কঙ্কালের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সরবরাহ নেই পর্যাপ্ত

অনলাইন ডেস্ক ॥ বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে মেডিকেল শিক্ষায় কঙ্কালের ব্যবহার থাকলেও এটি সরবরাহের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন নীতিমালা এখনো হয়নি। যার কারণে মেডিক্যাল শিক্ষায় এক ধরণের সংকট রয়েছে এবং অনেক সময় শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েন বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর এসব কারণেই কঙ্কাল সরবরাহের ক্ষেত্রে অবৈধ নানা পন্থায় তৈরি হয় বলে মনে করেন তারা। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটে ময়মনসিংহে। গত ১৫ই নবেম্বর ময়মনসিংহে ১২টি মানুষের মাথার খুলি ও শরীরের নানা অংশের দুই বস্তা হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। সেসময় ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ ফিরোজ তালুকদার বলেন, প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, এসব খুলি ও হাড়গোড় ভারত ও নেপালে পাচার করা হতো। এছাড়া মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এসব হাড় শিক্ষার কাজে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের ভেতরেও এসব হাড় সরবরাহ করা হতো বলেও জানান তিনি। কী কাজে ব্যবহার করা হয়? বাংলাদেশে মানুষের কঙ্কাল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় মেডিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে। এছাড়া নার্সিং কিংবা হোমিওপ্যাথি বিষয়ক পড়াশুনার জন্যও কঙ্কাল ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ মানবদেহ নিয়ে পড়াশুনা করতে হয় এমন যেকোন ধরণের শিক্ষায় কঙ্কালের ব্যবহার রয়েছে।ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম মোস্তফা কামাল বলেন, মানুষের শারীরবৃত্তীয় কাজগুলো জানতে এবং শিখতে হলে কঙ্কাল অপরিহার্য। সিলেট ওমেন্স মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল আহসানা নাহিন বলেন, অ্যানাটমি বিষয়ের অধীনে মানুষের কঙ্কাল এবং হাড়গোড় নিয়ে পড়াশুনা করতে হয়।বিশেষ করে মানুষের শরীরে হাড়-গোড় গুলো কোন অবস্থায় থাকে, হাড়ের গঠন, এগুলোতে বিভিন্ন ধরণের ছিদ্র সম্পর্কে জানতে হয়। তিনি বলেন, সাধারণত প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা কঙ্কালের দরকার হয়। তবে অনেক সময় যারা হোস্টেলে থাকে তারা দুই-তিন জন শিক্ষার্থী মিলে একটি কঙ্কাল কিনে পড়াশুনা করে।তবে যারা বাড়িতে থাকে তারা আলাদা কঙ্কাল কিনে নেয়।একই তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী ফাহমিদা সুলতানা তিথিও। তিনি জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় কঙ্কাল ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে।এ বিষয়ে ঢাকা নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী স্নিগ্ধা ইসলাম বলেন, অ্যানাটমি বিষয়ে পড়াশুনার সময় কঙ্কাল ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। "আপনাকে যতই পড়ানো হোক না কেন, হাতে ধরে দেখানোর আগে পর্যন্ত আসলে বোঝা সম্ভব না।" মানুষের কঙ্কালই কেন ব্যবহার করা হয়? মানুষের কঙ্কালের পরিবর্তে আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা কঙ্কাল কেন শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না এমন প্রশ্নে আলাদা ধরণের মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।অনেক শিক্ষক মনে করেন যে, আর্টিফিশিয়াল কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি কঙ্কাল দিয়ে শিক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণ হয় না। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থীরা চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক করেন এবং পরবর্তীতে চিকিৎসক হিসেবে পেশা শুরু করেন তাদের জন্য মানুষের আসল কঙ্কালই প্রযোজ্য বলে মনে করেন তারা। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষক ডা. এ এইচ এম মোস্তফা কামাল বলেন, আসল কঙ্কালের মতো আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম কঙ্কাল বানানো সম্ভব নয়। "অনেক সময় এমন কঙ্কালে অনেক ভুল থাকে।" তিনি বলেন, "রিয়েল কঙ্কালে হয়তো একটা গর্ত আছে, একটা নার্ভ চলে গেছে, একটা গ্রুপ আছে, কিন্তু আর্টিফিশিয়ালে হয়তো ওইটা আসেই নাই।" তবে আর্টিফিশিয়াল বা মডেল কঙ্কাল অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় বলে জানান তিনি। যেমন নার্সিং কিংবা হোমিওপ্যাথির মতো বিষয়গুলোতে অনেক সময় এ ধরণের কঙ্কাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।তবে এ বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করেছেন ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষক ডা. সোহেল মাহমুদ।তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই এখন কৃত্রিম কঙ্কাল ব্যবহার করা হয়।এসব কঙ্কাল এখন অনেক বেশি ভাল মানের বলেও জানান তিনি। কীভাবে সংগ্রহ করা হয়? সিলেট ওমেন্স মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল আহসানা নাহিন বলেন, পড়াশুনার জন্য তিনি যে কঙ্কালটি ব্যবহার করছেন সেটি তিনি সংগ্রহ করেছেন সিনিয়র এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে। মেডিক্যাল কলেজে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষেই এ ধরণের পড়াশুনার দরকার হয় বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, "মোটামুটি সেকেন্ড ইয়ারের পর আর কঙ্কাল তেমন লাগে না। তাই তৃতীয় বর্ষে বা অন্য বর্ষে চলে গেলে তারা কঙ্কালগুলো বিক্রি করে দেয়। এগুলো জুনিয়ররা কিনে নেয়।" একই ধরণের তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষক ডা. সোহেল মাহমুদও।তিনি বলেন, সিনিয়রদের কাছ থেকে জুনিয়ররা সংগ্রহ করে। এছাড়াও বাইরে থেকে কিছু কঙ্কাল আসে। তবে সেগুলো কোথা থেকে আসে সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারেননি। অ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মি. ডা. এ এইচ এম মোস্তফা কামাল বলেন, দুই ভাবে মানুষের কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। প্রথমটি হচ্ছে অনেকে মৃত্যুর পর নিজের দেহ দান করে যান মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়া ও গবেষণার জন্য। "চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্য যারা নিজের দেহ দান করেন সেগুলো মেডিক্যাল কলেজের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কঙ্কালে পরিণত করে সেটি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সরবরাহ করে থাকে, " তিনি বলেন। এছাড়া বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় কঙ্কাল কিনে থাকে। তবে কোথা কেনে সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোন তথ্য পাওয়া যায় না।এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহমিদা সুলতানা তিথি বলেন, সাধারণত সিনিয়রদের কাছ থেকে কঙ্কাল সংগ্রহ করেন তারা। এছাড়া অনেক সময় হাড় নষ্ট হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে নতুন কঙ্কাল সংগ্রহ করতে হয়। নতুন কঙ্কাল বিক্রি করে এমন অনেকের যোগাযোগ ক্যাম্পাসেই খুঁজে পাওয়া যায় বলেও জানানো হয়। "এর জন্য লোকাল বোনস ডিলার থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ক্যাম্পাসের দেয়ালে পোস্টার দিয়ে দেয়া হয়। বোনস বিক্রি হবে বা ফ্রেস বোনসের ব্যবস্থা করা হবে, যোগাযোগ করুন। এমন লেখা থাকে।" স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিক্যাল শিক্ষা বিষয়ক ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আবু সালেহ মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, দুই ভাবে মেডিক্যাল কলেজে কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। প্রথমত, পুরনো মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এক ধরণের ঐতিহ্য রয়েছে যে, যেসব মরদেহের কোন পরিচয় থাকে না বা কেউ দাবি করে না, এমন মরদেহগুলোকে পরবর্তীতে সরকার মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার জন্য দিয়ে দেয়। তবে এর কোন লিখিত নিয়ম নেই বলেও জানান তিনি। দ্বিতীয়ত, অনেকে নিজের দেহ দান করে দিয়ে থাকেন। তবে এই সংখ্যা বাংলাদেশে অনেক কম বলেও জানান তিনি। মি. হক বলেন, যেহেতু বাংলাদেশে কঙ্কাল সংগ্রহের কোন বৈধ উপায় নেই, তাই অবৈধভাবে আসারও সুযোগ থাকে। "পত্রিকা ছাড়াও সরেজমিনেও আমরা অবৈধভাবে কঙ্কাল সংগ্রহের বিষয়টি দেখেছি।" তিনি জানান, শুধু বাংলাদেশে নয় বরং প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানেও একই পদ্ধতিতে কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়। তবে যেসব ক্ষেত্রে কঙ্কাল চুরি করে নিয়ে আসার মতো বিষয়গুলো থাকে সেক্ষেত্রে পুলিশি ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে জানান তিনি। "আসছে সিমুলেশন ল্যাব" বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য কঙ্কালের প্রয়োজন হলেও এ নিয়ে দেশে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিক্যাল শিক্ষা বিষয়ক ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আবু সালেহ মোহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশে এখনো কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি হয়নি। তবে এ বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে এরইমধ্যে দুটি প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন তারা। এর মধ্যে একটি প্রস্তাব মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কঙ্কালের ব্যবহার এবং সরবরাহের পদ্ধতি নিয়ে নীতিমালা তৈরি বিষয়ক। আর আরেকটি মেডিক্যাল কলেজ গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য সিমুলেশন ল্যাব তৈরি বিষয়ক। তবে এ ধরণের ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে বছর পাঁচেক সময় লেগে যেতে পারে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই কর্মকর্তা। এই ল্যাবে আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম মরদেহ থাকবে যেটা ডি-সেকশন বা আলাদা করলে মানুষের দেহে যে ধরণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে ঠিক সে ধরণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই থাকবে। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে সিমুলেশন ল্যাব ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশে এখনো এটি প্রচার পায়নি। কুমিল্লায় একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ছোট আকারে একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর কোন মেডিকেল কলেজে এখনো এটি নেই। তবে তাদের দেয়া প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে দেশের ১৬টি মেডিক্যাল কলেজে এমন ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং ধীরে ধীরে সবকটি মেডিক্যাল কলেজে সেগুলো প্রতিষ্ঠা করা হবে। মি. হক বলেন, সিমুলেশন ল্যাবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মরদেহ কাটা এবং মানুষের দেহের ভেতরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোথায় কিভাবে থাকে, সেটা কেমন, ওজন কত, শক্ত নাকি নরম, এই বিষয়গুলো হাতে নিয়ে স্পর্শ করে দেখার মতো অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। "প্রথমে আর্টিফিশিয়াল বডি দিয়ে তাদের টার্গেট প্র্যাকটিস করানো হবে। পরে তাদেরকে লাইভ সার্জারিতে নিয়ে গিয়ে দেখানো হবে।" তিনি বলেন, বছরখানেক আগেই এই পরিকল্পনা পাস হয়। আর এখন এ নিয়ে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এই প্রকল্প পরিকল্পনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলেও জানান মি. হক। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×