ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাবুনগরী আমির, নূর হোসাইন মহাসচিব ॥ শফীর গোটা পরিবার বাদ

হেফাজতের দায়িত্ব জামায়াতপন্থীদের হাতেই!

প্রকাশিত: ২২:১০, ১৬ নভেম্বর ২০২০

হেফাজতের দায়িত্ব জামায়াতপন্থীদের হাতেই!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হেফাজতে জামায়াতের একচ্ছত্র প্রভাব নিয়ে বেরিয়ে আসা তথ্যই সম্মেলনে তাই প্রমাণ হলো। প্রয়াত আমির আহমদ শফীর ছেলেসহ পুরো পরিবার ও তার অনুসারীদের বাদ দিয়ে তাদের বিরোধিতার মধ্যেই সম্মেলনে বিএনপি-জামায়াত ঘরানা জুনাইদ বাবুনগরীকে আমির এবং নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করে ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। মহাসচিব হওয়া নূর হোসাইন কাসেমী বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেরও নেতা। এদিকে হেফাজতের এ কাউন্সিলকে ‘অবৈধ’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আল্লামা শফীর অনুসারীরা। নতুন কমিটি বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগর হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমির মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাছ। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন, নতুন কমিটি গঠিত হলেও এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রবিবার সকালে হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় শুরু হয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা। এতে সভাপতিত্ব করেন বিদায়ী কমিটির নায়েবে আমির মওলানা মহিবুল্লাহ বাবু নগরী। সারাদেশের আটটি বিভাগ থেকে প্রতিনিধিরা যোগ দেন এ সম্মেলনে। পরে দ্বিতীয় পর্বের কাউন্সিলে নতুন আমির ও মহাসচিবের নাম প্রস্তাবের দায়িত্ব দেয়া হয় মওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীসহ উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে। সেখানে তারা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং নূর হোসাইন কাসেমীর নাম আমির ও মহাসচিব হিসেবে প্রস্তাব করেন। এরপর নতুন নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করা হয়। হেফাজতের নেতৃত্বে কে আসছেন এ নিয়ে বেশ আলোচনা ছিল। শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলে ১৫১ সদস্যের কমিটি গঠনের ঘোষণা হয়। হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফিপন্থীরা পুরোপুরিই বাদ পড়েছেন। কমিটিতে স্থান পাননি শফিপুত্র আনাস মাদানী এবং আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মওলানা মঈনুদ্দীন রুহী। তাছাড়া মহাসচিবের পদে যাকে আনা হয়েছে তাকে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোন রাজনৈতিক দলে পদ রয়েছে এমন কেউ সংগঠনের নেতৃৃত্বে আসতে পারবেন না। নতুন মহাসচিব বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় ঐক্যজোটের শরীক জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব। রাজনৈতিক নেতাকে মহাসচিব করায় হেফাজতের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে অভিমত দলের অভ্যন্তরেই রয়েছে। হেফাজতের ১৫১ সদস্যের এ কমিটিতে নায়েবে আমির ৩২ জন, যুগ্ম মহাসচিব ৪ জন, সহকারী মহাসচিব ১৮ জন, সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ৮১ জন এবং উপদেষ্টা ২৪ জন। সারাদেশে আটটি বিভাগ থেকে আয়োজিত প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন কমিটি গঠন ও ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে। এদিকে, সম্মেলনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর সমর্থকরা। তারা বলছেন, সম্মেলনের পুরো প্রক্রিয়াটিই অবৈধ। সম্মেলনে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। জুনায়েদ বাবুনগরী প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই হেফাজতের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সংগঠনটির প্রয়াত আমির আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এ সম্মেলনকে ঘিরে সংগঠনটিতে দেখা দেয় চরম টানাপোড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়কালে কে বা কারা হাটহাজারী মাদ্রাসার মূল ফটকের বাইরে নানা ধরনের রহস্যময় লিফলেট ছাড়ে। জানা গেছে, যখন মুসল্লিরা জুমার নামাজ আদায় করে মাদ্রাসার বাইরে বের হচ্ছিলেন; ঠিক ওই মুহূর্তে চোখে পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা ধরনের রঙিন লিফলেট। লিফলেটে কারও নাম ঠিকানা না থাকলেও এসব লিফলেটগুলোতে জুনায়েদ বাবুনগরী ও দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর পুত্র শামীম বিন সাঈদীর একটি ছবি দিয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসায় মানবতাবিরোধী সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাঈদীপুত্র শামীম সাঈদীর আনাগোনা কিসের ইঙ্গিত বলে প্রশ্ন তোলে। এছাড়াও হেফাজতে ইসলামকে হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রভাবমুক্ত করতে আহমদ শফীর ঘনিষ্ঠদের বাদ দিয়ে হেফাজতের কমিটি করতে জামায়াত-শিবির ষড়যন্ত্র করছে বলেও এসব লিফলেটে দাবি করা হয়। অন্য একটি লিফলেটে লেখা হয়েছে, ধর্মপ্রাণ ও অরাজনৈতিক হেফাজতকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ষড়যন্ত্রে মরিয়া জামায়াত-বিএনপি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, অতীতে যারা হেফাজত নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে, হেফাজতকে বিলীন করার চেষ্টা করেছে এটা তাদেরই কাজ। তৌহিদী জনতা এখন সব বোঝে, কোন ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না। এদিকে জুনায়েদ বাবুনগরী ও দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর পুত্র শামীম বিন সাঈদীর ‘বৈঠক’ প্রসঙ্গে এর আগে জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছিলেন, সেটা আদৌ জামায়াত-শিবিরের কোন মিটিং ছিল না। এটা ছিল এসএমএম কুরিয়ার সার্ভিস নামের একটি কোম্পানির ইফতার মাহফিল, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেখানে ছিলেন। জুনায়েদ বাবুনগরী দাবি করেন, ওই ইফতার মাহফিলে শামীম সাঈদীর উপস্থিতিতে তিনি বিব্রতবোধ করেছিলেন। মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীও শামীম সাঈদী উপস্থিত হওয়ায় বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ওই সময় বাবুনগরীর পায়ের কাছে বসেন। তিনি পাশে বসা অবস্থায় ওনার এক সহকারী সকলের অজান্তে দুজনের একটি ছবি তুলে ফেলেন। বিষয়টি জানতে পেরে বাবুনগরী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং ছবিটি মুছে ফেলতে বলেন। কিন্তু শামীম সাঈদী বললেন, ছবিটা শুধু স্মৃতি হয়ে থাকবে, অন্য কিছু না। অন্যদিকে শুক্রবার বিকেলে এ বিষয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সম্মেলন (কাউন্সিল) বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য মাওলানা মীর ইদ্রিসের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি কুচক্রী মহল হেফাজতকে বিতর্কিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তারাই হেফাজতের কাউন্সিল বানচাল করতে নানা যড়ষন্ত্র করেছিল। হেফাজতে ইসলামের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম আর থাকবে না বলে মনে করছেন প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর পক্ষীয়রা। হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী বলেন, এই কমিটি অবৈধ। আমরা এটা প্রত্যাখ্যান করি। এই কাউন্সিলের যিনি আহ্বায়ক, সেই মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর হেফাজতে ইসলামের সদস্য পদও নেই। এরকম একজন ব্যক্তি কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করতে পারেন না। তিনি তো হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন, এমনকি হেফাজতের বিরুদ্ধেও বক্তব্য দিয়েছেন। প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর অনুসারীরা বলছেন, এখনই পাল্টা কোন কমিটির দিকে তারা যাচ্ছেন না। তারা বলেছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। রুহীর দাবি, হাটহাজারী মাদ্রাসায় হওয়া কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদে থাকা ৬৫ জনই উপস্থিত ছিলেন না। আমি এখন ঢাকায় আছি। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছি। যেহেতু গঠনতান্ত্রিকভাবে কাউন্সিল বা সিদ্ধান্ত হয়নি, তাই এর সবই অবৈধ। নিজেদের পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। সময়ই বলবে আমরা কী করব। সেই সিদ্ধান্ত আপনাদের জানাব। এদিকে হেফাজতে ইসলামের নতুন গঠিত কমিটি বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংগঠনটির সদ্য বিলুপ্ত কমিটির নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগর হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমির মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাছ। রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর দক্ষিণে ধোলাইপাড় বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আসকান টাওয়ারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ অভিযোগ করেন। চট্টগ্রামে হাটহাজারীর নতুন যে কমিটি হয়েছে, সেখানে মুফতি ওয়াক্কাছকে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে এই কমিটিতে বাদ পড়েছেন আল্লামা আহমদ শফীর পুত্র মাওলানা আনাস মাদানী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মুফতি মঈনুদ্দীন রুহিসহ অনেকেই। সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাছ বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের ইন্তেকাল হয়েছে। এ কারণে তার পদটি পূরণের দরকার ছিল। কিন্তু আজকে হাটহাজারীতে যে কমিটি পুনর্গঠন হয়েছে, তা বিষয়বস্তুতে ছিল না। শুধু আমিরের জায়গায় একজন আমির ঠিক করলেই হয়ে যেত। ওয়াক্কাছ অভিযোগ করেন, ‘আমি তো কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির, ঢাকা মহানগর কমিটির প্রধান উপদেষ্টা। আমার সঙ্গে শুরুতেও কোন আলোচনা করা হয়নি, এমনকি সম্মেলন পর্যন্ত বলা হয়নি, চিঠিও দেয়া হয়নি। এইভাবে অনেক আলেম বাদ পড়ে গেছেন। তিনি বলেন, মনে হয় এটা একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হেফাজতে ইসলামের ব্যাপকতা, সর্বজনীনতা ক্ষুণ্ন করার জন্য বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা পদক্ষেপ। কারও ইঙ্গিতে এগুলো করা হয়েছে। যারা চায় না এদেশে উলামায়ে কেরাম একসঙ্গে থাকুক, কোরানের কথা বলুক, তারাই এটা করিয়েছে বলে সন্দেহ হচ্ছে আমার।
×