ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমরাও জাহাজ তৈরি ও রফতানি করব

প্রকাশিত: ২২:০৭, ১৬ নভেম্বর ২০২০

আমরাও জাহাজ তৈরি ও রফতানি করব

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশ কোস্টগার্ডকে আরও বৃহৎ পরিসরে দায়িত্ব পালনে সক্ষম একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নতুন নতুন দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তুলতে আমরা কোস্টগার্ডকে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী রবিবার সকালে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের দুটি অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল, পাঁচটি ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল, দুটি ফাস্ট প্যাট্রোল বোট এবং বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বেস, ভোলার কমিশনিং প্রদানকালে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন। খবর বাসসর। তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে মূল অনুষ্ঠানস্থল চট্টগ্রামের কোস্টগার্ড বার্থ পতেঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড ও খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত আজকের কমিশনিং করা ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল এবং ফাস্ট প্যাট্রোল বোটগুলো।’ অর্থাৎ আমরা নিজেরাও তৈরি করতে পারি, সেটারই আজ প্রমাণ পেলাম। আজকে এটা আমাদের নিজেদের কাজে লাগল। আগামীতে আমরা রফতানিও করব ইনশাল্লাহ, যোগ করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা এবং সামুদ্রিক জলসীমার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, মৎস্য সম্পদ রক্ষা, দেশের সমুদ্রবন্দরের নিরাপত্তা বিধান, চোরাচালান ও মাদকবিরোধী অভিযান, ডাকাত দমনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জনগণের জানমাল রক্ষায় কোস্টগার্ডের ভূমিকা উত্তরোত্তর বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘নতুন নতুন দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তুলতে আমরা কোস্টগার্ডকে একটি যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি।’ ‘জাটকা নিধন রোধে এবং মা ইলিশ রক্ষায় কোস্টগার্ডের প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মুজিববর্ষে কোস্টগার্ডের বহরে এই নৌযানগুলো যুক্ত হওয়া সংস্থাটির জন্য একটি নতুন অধ্যায় সূচিত করেছে। কারণ, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল টহলে রাখাটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ তাঁর সরকারের সময়ে কোস্টগার্ডের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত প্রায় ১২ বছরে কোস্টগার্ডের জন্য বিভিন্ন আকারের ৫৫টি জাহাজ ও জলযান নির্মাণ করা হয়েছে। তিনটি প্রকল্পের আওতায় কোস্টগার্ডের বেসসমূহের কর্মকর্তা ও নাবিকদের বাসস্থান, অফিসার্স মেস, নাবিক নিবাস ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি পটুয়াখালী অঞ্চলে নিজস্ব প্রশিক্ষণ বেইস ‘বিসিজি বেইস অগ্রযাত্রার’ মাধ্যমে কোস্টগার্ডের জনবলের প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ বাহিনীর সদস্যরা স্বল্পতম সময়ে সুবিশাল সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকার মানুষের জান-মালের নিরাপত্তায় অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে।’ তিনি কোস্টগার্ড সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, কোস্টগার্ডের বিভিন্ন জাহাজ ও ঘাঁটি কমিশনিংয়ের মাধ্যমে এ বাহিনীর সক্ষমতা আজ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। তিনি আস্থা প্রকাশ করে বলেন, এসব জাহাজ ও ঘাঁটি কোস্টগার্ড সদস্যদের পেশাগত উৎকর্ষ, মানসিক বিকাশ ও উন্নত মনোবল অর্জনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, দেশপ্রেম, সততা ও ইমানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন, কোস্টগার্ডের সুনাম যেন সব সময় বজায় থাকে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন। এই বাহিনীর ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে এবং আপনাদের সার্বিক কল্যাণে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সহায়তা সরকার দিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুষ্ঠানে কোস্টগার্ডের একটি সুসজ্জিত চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার এ্যাডমিরাল মোঃ আশরাফুল হক অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুষ্ঠানে অধিনায়কগণের হাতে ‘কমিশনিং ফরমান’ হস্তান্তর করেন। নব্য কমিশনিংকৃত নয়টি জাহাজের ওপর অনুষ্ঠানে একটি ভিডিওচিত্র ও পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত ২০১৪ সালে ইতালি সফরের সময় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ইতালি সরকারের যে সহযোগিতা কামনা করেন তারই অংশ হিসেবে পরবর্তীকালে জি-টু-জি চুক্তির মাধ্যমে ইতালি নৌবাহিনীর চারটি করভেট প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলে রূপান্তরিত করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডকে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার দুটি বিসিজিএস তাজউদ্দীন ও বিসিজিএস সৈয়দ নজরুল জাহাজ দুটি ২০১৭ সালে তিনি কমিশনিং করেন। ইতালি হতে সংগৃহীত আরও দুটি অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল-বিসিজিএস মনসুর আলী এবং বিসিজিএস কামারুজ্জামান আজ (রবিবার) কমিশনিং হলো। পাঁচটি ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল-বিসিজিএস সবুজ বাংলা, শ্যামল বাংলা, সোনার বাংলা, স্বাধীন বাংলা ও অপরাজেয় বাংলা এবং দুটি ফাস্ট প্যাট্রোল বোট-বিসিজিএস সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়া রবিবার এ বাহিনীর বহরে যুক্ত হলো। ’৯৬ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খুলনা শিপইয়ার্ড এবং নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডকে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের জন্যই আজকে দেশেই বিশ^মানের জাহাজ নির্মাণ হচ্ছে বলেও সরকার প্রধান উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশীয় শিপইয়ার্ডে তৈরি এ জাহাজগুলো কোস্টগার্ডের অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। পাশাপাশি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ও নদী পথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিসিজি বেইস ভোলারও আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলেও জাতীয় সংসদে তাদের আনিত বিলের কারণেই ‘কোস্টগার্ড’ একটি বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সৃষ্টির পেছনে একটি মজার ঘটনা রয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল এবং জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আকারে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সৃষ্টির প্রস্তাব উত্থাপন করে। ইতিপূর্বে আনিত অন্যান্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের মতো এটিরও বিরোধিতা করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তা বাতিল করে দিতে চেয়েছিল বিএনপি। ‘একটি পর্যায়ে আমরা দেখলাম সংসদে বিরোধী দলে থাকলেও সংসদে আমাদের উপস্থিতি বেশি ছিল এবং সরকারী দল বিএনপির সদস্যদের উপস্থিতির সংখ্যা খুব কম ছিল। বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় এবং বিতর্কের একটা পর্যায়ে সরকারী দল যখন এটাকে কণ্ঠভোটে নাকচ করে দিতে চাইল সঙ্গে সঙ্গে আমরা ডিভিশন ভোট দাবি করলাম,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এখানে সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনের যে ব্যাপারটি রয়েছে তা হচ্ছে, আমরা তখন তাৎক্ষণিকভাবে ডিভিশন ভোট দাবি না করলে তা নাকচ হয়ে যেতে পারত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের দাবি মোতাবেক জাতীয় সংসদের স্পীকার তখন ডিভিশন ভোট করল, ভোট গুনে দেখা গেল তাদের দলের সংসদ সদস্যই বেশি, কাজেই তাদের আনিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি পাস হলো। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় নিরাপত্তায় আমাদের আনিত প্রস্তাবটি বিরোধী দলে থেকেও পাস করিয়ে আনাটা ছিল একটা বিরল ঘটনা। কিন্তু আমরা সেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলাম ১৯৯৪ সালে। সেখান থেকেই এই কোস্টগার্ড সৃষ্টি। পরবর্তীতে তা আইনও হয়েছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ একটি সংগঠন একান্তভাবে দরকার। ’ সরকার প্রধান বলেন, ১৯৯৬ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের বিভিন্ন জোনের জন্য ভূমি প্রদান, অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিভিন্ন ধরনের জলযান প্রদানের মাধ্যমে দেশের উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ডের কার্যক্রম চালু করার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক কারণে দুর্যোগের সঙ্গে বসবাসরত এবং মানুষের জানমাল রক্ষার্থে তাঁর সরকার কোস্টগার্ড বাহিনীর সক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্য হোভারক্রাফট, ড্রোন ও সব আবহাওয়ায় চলাচলের উপযোগী ৩ হাজার ৫০০ টন ক্ষমতা বিশিষ্ট জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুর্যোগের সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে এবং সেই প্রস্তুতিও আমাদের থাকতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ছাড়াও বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড এবং খুলনা শিপইয়ার্ডে দুটি ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল, একটি ফ্লোটিং ক্রেন, দুটি টাগ বোট এবং ১৬টি বোট তৈরি হচ্ছে। অচিরেই এগুলো কোস্টগার্ডের বহরে সংযুক্ত হবে বলে। কোস্টগার্ডের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গজারিয়ায় একটি ডকইয়ার্ডও নির্মাণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কোস্টগার্ডের জনবলও বৃদ্ধি করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্লু ইকোনমি’ ও গভীর সমুদ্রে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য এ বাহিনীর রূপকল্প-২০৩০ ও ২০৪১ অনুযায়ী বর্তমান জনবল ৪ হাজার ৭৮১ জন থেকে বাড়িয়ে ১৫ হাজার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আস্থা প্রকাশ করে বলেন, গভীর সমুদ্র নির্ভর অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল ও নিরাপদ রাখা, ‘ব্লুু ইকোনমি’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহ ও ব্যক্তিবর্গের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানে আজকের কমিশনকৃত জাহাজসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে কোস্টগার্ডের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে আজকের কমিশনকৃত জাহাজসমূহ অর্জন সহযোগিতার জন্য বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহকেও তাদের ধন্যবাদ জানান। কোভিড-১৯ এর সেকেন্ড ওয়েভ সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করে দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
×