ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষায় করোনার ছোবল (২)

অনিয়ম অদক্ষতায় অবকাঠামো নির্মাণ কাজ স্থবির

প্রকাশিত: ২২:৫২, ১৫ নভেম্বর ২০২০

অনিয়ম অদক্ষতায় অবকাঠামো নির্মাণ কাজ স্থবির

বিভাষ বাড়ৈ ॥ একদিকে করোনার ছোবল, অন্যদিকে প্রধান কর্মকর্তার অদক্ষতা, অনিয়ম ও গাফিলতির কারণে স্থবির হয়ে পড়ছে শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম। কার্যাদেশ দেয়া হলেও দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ এক-দেড় বছরেও শুরু হয়নি। কেন্দ্র থেকে মনিটরিং না হওয়া, ঠিকাদারদের বিল আটকে রাখা, ‘ড্রয়িং ও ডিজাইন’ অনুমোদনে গড়িমসি, শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়মিত দফতরে না বসাসহ নানা কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে পুরো কার্যক্রমে। এদিকে কোন কোন ঠিকাদারও বিল নিয়ে কাজ আটকে রেখেছেন। অথচ তাও দেখার কেউ নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইইডির কর্মকর্তারাই বলছেন, সব কাজে রীতিমতো তালগোল পাকিয়েই আগামী ১৮ নবেম্বর অবসরে যাচ্ছেন ইইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) বুলবুল আখতার। নানা অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে তার পদোন্নতি, প্রমার্জনের আবেদন ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছে শিক্ষা প্রশাসন। জানা গেছে, গত প্রায় দেড় বছর ধরে ঠিকাদারদের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিটিতেই হয়রানির অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারদের। তদ্বির ছাড়া ‘ড্রয়িং’ ও ‘ডিজাইন’ পাচ্ছেন না ঠিকাদাররা। আবার বিলম্বে কার্যাদেশ পেয়েও অনেক ঠিকাদার কাজ শুরু করতে পারছেন না। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে (ইইডি) গত এক বছরে ‘ড্রয়িং’ ও ‘ডিজাইন’ অনুমোদনের হয়রানি কয়েক গুণ বেড়েছে বলে মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা জানিয়েছেন। ইইডির শীর্ষ পর্যায়ের গাফিলতি ও অদক্ষতায় সংস্থার ৬৫টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রকৌশলীরা পড়েছেন বিপাকে। তারা কার্যাদেশ দিয়েও ঠিকাদারদের ‘ড্রয়িং’ ও ‘ডিজাইন’ সরবরাহ করতে পারছেন না। ভোলা সরকারী কলেজে নবনির্মিত চারতলা একাডেমিক কাম প্রশাসনিক ভবন ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন ইইডি গঠিত তদন্ত কমিটি। অভিযোগ রয়েছে, ওই অবকাঠামো নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছিল ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা শাহাবুদ্দিন লাল্টুর ভাইকে। এ কারণে ওই দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ‘মাহতাব ছায়েরা উচ্চ বিদ্যালয়’ ও ‘কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে’ উর্ধমুখী অর্থাৎ একতলা থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণের ‘ড্রয়িং’ সরবরাহ করার জন্য গত ২৪ জানুয়ারি ইইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) বরাবর চিঠি দেন ওই জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী (ইইডি) প্রদীপ কুমার সরকার। শনিবার নাগাদ ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের ‘ড্রয়িং’ সরবরাহ করা হয়নি। এতে নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। ‘নির্বাচিত বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উর্ধমুখী সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের আওতায় ওই নির্মাণ কাজ হচ্ছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সংস্কারে এক বছর আগে কার্যাদেশ পেলেও ‘ড্রয়িং ও ডিজাইন-’ কিছুই পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন ‘খান এ্যান্ড সন্স’র কর্ণধার মুজিবুর রহমান খান। তিনি বলেন, ‘আমি বুলবুল আখতারের কাছে বহুবার গিয়েছি ড্রয়িং ও ডিজাইনের জন্য। উনি কিছুই করতে পারছে না। যিনি এই দায়িত্বে আছেন তিনিও ড্রয়িং-ডিজাইন দিচ্ছেন না। ফলে কাজ হবে কীভাবে?’ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পাকশিমুল হাজী শিশু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে উর্ধমুখী সম্প্রসারণের কার্যাদেশ প্রায় সাত মাস আগে দেয়া হলেও ‘ড্রয়িং ও ডিজাইন’ পাচ্ছেন না ঠিকাদার। এর ফলে কাজ ঝুলে রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘ঠিকাদার কি করবেন? সে টাকা ছাড়া ড্রয়িং পাচ্ছে না বলে আমাদের জানিয়েছেন। এজন্য কাজ বন্ধ আছে।’ প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘ড্রয়িং’ ও ‘ডিজাইন’ না পাওয়ায় দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উধমুখী সম্প্রসারণ কাজ বন্ধ রয়েছে। ঠিকাদারদের কেউ একবছর, কেউ ছয়মাস; এমনকি কেউ কেউ দেড় বছর ধরেও ড্রয়িং ও ডিজাইনের প্রধান কার্যালয়ে ঘুরছেন। দু’জন ঠিকাদার বলেন, ‘ড্রয়িং ও ডিজাইন’ নিয়ে নানা রকম দুর্নীতি হয়। ইইডির শীর্ষ পর্যায়ের সিগন্যাল না হলে যথাসময়ে তা পাওয়া যায় না। দ্রƒতসময়ের মধ্যে এগুলো পেতে হলে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, গত কয়েক বছর সরকারের অন্যতম একটি অর্জন ছিল শিক্ষার অবকাঠানো নির্মাণ। তবে এক বছরেই সেই বিষয়টিতে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কাজ স্থবির। তার মধ্যে করোনা সঙ্কট সামনে আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ড্রয়িং ও ডিজাইন না পাওয়া আরও যেসব প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ কাজ আটকে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে রাজধানীর অগ্রণী স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মৌলভীবাজারের সিদ্বেশ^রী গার্লস কলেজ, রংপুর মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রাজধানীর মুরাদপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, খিলগাঁও গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজ, আহমেদবাগ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, শুক্রাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা কলেজের একাডেমিক ভবন নির্মাণ এবং ছাত্রাবাস নির্মাণ কাজ, সরকারী বাংলা কলেজের ছাত্রাবাস নির্মাণ কাজ, কামাল আহমেদ মজুমদার স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মনিকানন উচ্চ বিদ্যালয়, চিড়িয়াখানা বোটানিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয়, হাজী আশরাফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়, রোটারী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বেংগলী মিডিয়াম হাউ স্কুল ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, হাজী বিল্লাত আলী হাইস্কুল, মুরাদপুর সমীরুনেসা উচ্চ বিদ্যালয়, সিটি কর্পোরেশন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম নুরজাহান মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, উদ্দীপন বিদ্যালয় ও গাউয়াইর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অন্যতম। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ‘১০০টি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ’ (টিএসসি) স্থাপন প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে কারিগরি অধিদফতর ও ইইডির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পের অধীনে নির্মাণাধীন সব অবকাঠামোতে শ্রেণী কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত করতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হলেও বাস্তবায়ন কার্যক্রমে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। কারণ বেশির ভাগ ঠিকাদারই যথাসময়ে ড্রয়িং ও ডিজাইন পায়নি। ড্রয়িং ও ডিজাইন সরবরাহে ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানিরও অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদারদের। আবার তড়িগড়ি করে ত্রুটিপূর্ণ ড্রয়িং ও ডিজাইন সরবরাহ করায় অনেক ক্ষেত্রে কাজ শুরুর পর তা পরিবর্তন করা হয়েছে। পরবর্তীতে সংশোধিত ড্রয়িং ও ডিজাইন সরবরাহ করা হয়েছে। এতে অনেক ঠিকাদার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। আবার যথাযথ তদারকি না থাকায় নির্মাণ কাজের মান নিয়েও ত্যক্ত-বিরক্ত প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কখনও কখনও প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় না করেই একাডেমিক ভবন নির্মাণ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইইডির সঙ্গে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বিরোধ শুরু হয়। এ নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষা ভবনে ইইডি কার্যালয়ে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রনালয় সুত্রে জানা গেছে, ৫ নবেম্বর ইইডির শীর্ষ কর্মকর্তার অবসর ছুটি মঞ্জুর করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ২৮ আগস্ট শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর কর্মকর্তা কর্মচারী পরিষদের ব্যানারে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে সচিব বরাবর অভিযোগ করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়, শীর্ষ কর্মকর্তার ভাই রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ছাত্রাবস্থায় ছিলেন শিবিরের পদধারি নেতা।
×