ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাঙ্গনের সুর

হেফাজতে জামায়াতী অস্থিরতা ॥ ‘আল্লামা শফী হত্যার শিকার’

প্রকাশিত: ২২:৫০, ১৫ নভেম্বর ২০২০

হেফাজতে জামায়াতী অস্থিরতা ॥ ‘আল্লামা শফী হত্যার শিকার’

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে জামায়াতসহ উগ্রবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধি ও আজ রবিবারের সম্মেলন ঘিরে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে হেফাজত ইসলামে। জামায়াতপন্থীদের প্রভাবে শফীপন্থী প্রবীণ আলেমদের বাদ দিয়ে চট্টগ্রামে আজকের সম্মেলনের আগ মুহূর্তে ভয়াবহ অভিযোগ তুলে আল্লামা শফীর পরিবারসহ শফী সমর্থকরা বলেছেন, আল্লামা শফী জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত হত্যকাণ্ডের শিকার। জামায়াত-বিএনপির হাতে যাচ্ছে হেফাজত। এদিকে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে শফীপন্থী আলেম সমাজ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, মূলধারাকে বাদ দিয়ে চোরাইপথে কমিটি হলে আলেম সমাজ মানবে না। হেফাজত চরমপন্থীদের দখলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে ঢাকার সংবাদ সম্মেলন থেকেও। আহমদ শফী জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত হত্যকাণ্ডের শিকার বলে শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ এনেছেন প্রয়াত আমিরের পরিবারের সদস্য ও তার সমর্থক আলেম সমাজ। পরিবারের পক্ষ থেকে সরাসরি এর অভিযোগ আনেন আল্লামা শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন। ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র ব্যানারে আয়োজিত সংগঠনটির একাংশের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানিয়েছেন। একই সংবাদ সম্মেলন থেকে আজ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া হেফাজতের সম্মেলন বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী। উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির ছয় সদস্য এবং আহমদ শফীর নাতি মাওলানা কায়সার, হেফাজতের সহকারী কোষাধ্যক্ষ সরোয়ার আলম, প্রচার সম্পাদক শামসুল হক, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ওসমান কাশেমী প্রমুখ। লিখিত বক্তব্যে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন বলেন, আমার আপন বোন ফিরোজা বেগম (৮০) আমার ভগ্নিপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর শোকে অসুস্থ। আমি তার কান্না সহ্য করতে পারছি না। তার অনুরোধে আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। সংবাদ সম্মেলনে আমিরের ছেলে আনাস মাদানীর অংশ নেয়ার কথা ছিল। হুজুরের হত্যাকারীরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়ায় তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, আমার ভগ্নিপতি হজরত আল্লামা শফী স্বাভাবিকভাবে মারা যাননি। শিবিরের প্রেতাত্মারা শাহ আহমদ শফী হুজুরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আমরা তার খুনের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি। আমরা তার হত্যাকাণ্ডের বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি। তিনি বলেন, শাপলা চত্বরে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ফাঁদে পা না দেয়ার কারণে শফী হুজুরকে তখন থেকেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়ে জামায়াত-শিবিরের লেলিয়ে দেয়া ক্যাডারবাহিনী মাদ্রাসা অবরুদ্ধ রাখে। এ সময় জুনায়েদ বাবুনগরী মাদ্রাসায় অবস্থান করে মীর ইদ্রিছ, নাছির উদ্দিন মুনীর, মুফতি হারুন ও ইনজামুল হাসানদের দিয়ে মাদ্রাসায় ভাংচুর করায়। এক পর্যায়ে তারা জোরপূর্বক হুজুরের কক্ষে প্রবেশ করে ভাংচুর ও হুজুরকে নির্যাতন করে। শফী হুজুরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এতে হুজুর অসুস্থ হয়ে পড়লে মুখে অক্সিজেন দেয়া হয়। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা অক্সিজেন খুলে দিলে তিনি মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়েন। পরে এ্যাম্বুলেন্স এলেও তারা ঠিক সময়ে এ্যাম্বুলেন্স ছাড়তে দেয়নি। তিনি আরও বলেন, মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন, শফী হুজুরকে হত্যার উদ্দেশ্যে এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য জামায়াত-শিবির ১৯৮৫ সালে হামলা চালায়। দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও কওমের প্রতি ভালবাসা থাকায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ হামলা রুখে দেন শফী হুজুর। এছাড়া শফী হুজুর প্রকাশ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের (জামায়াত-শিবির) বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতেন ও তাদের বিরুদ্ধে নানা বইও লিখেছেন। এ কারণে শফী হুজুরের প্রতি জামায়াত-শিবিরের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ড। কাউন্সিল বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, হুজুরের হত্যার বিচার দাবি না তুলে ১৫ নবেম্বর কাউন্সিলের ডাক দেয়া হয়েছে। প্রতিনিধি কাউন্সিলের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে হুজুরের গড়া সংগঠনকে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অবিলম্বে এ সম্মেলন বন্ধ করতে হবে। এদিকে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে শফীপন্থী আলেম সমাজ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, মূলধারাকে বাদ দিয়ে চোরাইপথে কমিটি হলে আলেম সমাজ মানবে না। হেফাজত চরমপন্থীদের দখলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে ঢাকার সংবাদ সম্মেলন থেকেও। চোরাইপথে কমিটি গঠন করা হলে তা বাংলাদেশের আলেম সমাজ মেনে নেবে না বলে ঘোষণা করেছেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শাইখুল ইসলাম, শহীদ আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত ঈমানী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মহলবিশেষের ষড়যন্ত্র উন্মোচন’ সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা একে এম আশরাফুল হক, মাওলানা আলতাফ হোসেন, জিয়াউল হক মজুমদার, মুজিবর রহমান, মাওলানা মনসুরুল হক প্রমুখ। মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, আজ হেফাজতের ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত করে যারা হেফাজতকে একটি চিহ্নিত মহলের ক্রীড়নকে পরিণত করতে চাচ্ছে, অচিরেই জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হবে, ইনশাল্লাহ! হেফাজতের মূলধারাকে বাদ দিয়ে যারা হেফাজতের একজন পদত্যাগী নেতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে এই ঈমানী সংগঠনকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র করছে এদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ বিশেষত উলামায়ে কেরামরা তা কোনদিনই মেনে নেবে না। আল্লামা শফী (রহ.)-এর এই আমানত রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে সবকিছু উৎসর্গ করতে তারা প্রস্তুত রয়েছে। মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, আমরা মনে করি, শাইখুল ইসলাম শহীদ আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে (রহ.) পরিকল্পিতভাবে শহীদ করে বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসা এবং হেফাজতে ইসলামকে একটি চিহ্নিত মহল তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের গভীর ষড়যন্ত্র করছে। এসবের নেতৃত্বে মূলত হেফাজতের গুটিকয় নেতা এবং চিহ্নিত কিছু চরমপন্থী রয়েছে দাবি করে বলেন, হাটহাজারী মাদ্রাসায় আন্দোলনের নামে আল্লামা শফী (রহ.)-এর রুম ভাংচুর এবং তার ওপর মানসিক চাপ, অসৌজন্যমূলক আচরণ, মেডিসিন নিতে বাধা প্রদান, তার চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটানোÑ এসবই ছিল তাদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এসবের হোতারা এ সম্পর্কে অজ্ঞ বলে মিডিয়ার সামনে যে হাঁকডাক ছাড়ছেন তা সত্যের অপলাপ মাত্র। লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, আল্লামা শফীকে পরিকল্পিতভাবে শহীদ করা হয়েছে। এ কথা জানার পরেও এই চরম ও উগ্রপন্থীদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, সত্যকে কখনও ধামাচাপা দেয়া যায় না। সত্য একদিন উদ্ভাসিত হবেই। বাংলার জমিনে শহীদ আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এর অস্বাভাবিক শাহাদতের বিচার একদিন হবেই। আমরা এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। ফয়জুল্লাহ আরও বলেন, স্পষ্টভাবে বলছি, একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হেফাজতের কাউন্সিলের নামে একতরফাভাবে কাউকে দায়িত্ব দিলে তা এদেশের ওলামায়ে কেরাম মেনে নেবে না। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সর্বোচ্চ আমির কর্তৃক গঠিত কমিটির মাধ্যমে হেফাজতের কাউন্সিলে সর্ব সমর্থিত ব্যক্তিত্বদের নেতৃত্বে আনলেই দেশবাসীসহ উলামায়ে কেরাম ওই নেতৃত্বকে গ্রহণ করবে। এছাড়া ভিন্ন পথে কোন কিছু করার ষড়যন্ত্র করা হলে দেশবাসী তা রুখে দেবে, ইনশা আল্লাহ! বলেন, তাই আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শায়খুল ইসলাম (রহ.)-এর গঠিত হেফাজতের কমিটির মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। চোরাইপথে কোন কিছু করা হলে তার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ওপরই বর্তাবে।
×