ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরণের পথে দেশ ॥ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ১৫ নভেম্বর ২০২০

উত্তরণের পথে দেশ ॥ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল

রহিম শেখ ॥ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দা অতিক্রম করছে। এখন করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা মোকাবেলা করছে বিশ্ব। বৈশ্বিক এ অর্থনীতির প্রভাব ছিল বাংলাদেশেও। তা সত্ত্বেও ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পোন্নত দেশ (লিস্ট ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রি বা এলডিসি) থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যে তিনটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই স্বীকৃতি তা অনেক আগেই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। আজ রবিবার জাতিসংঘকে এই সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল (ডেভেলপিং) দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ। জানা গেছে, উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় তিন বছরের ব্যবধানে জাতিসংঘের দুটি মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হতে হয় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে। প্রথম মূল্যায়নে একটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে (ডেভেলপিং কান্ট্রি-ডিসি) পরিণত হতে গেলে যে তিন সূচকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশ সেই তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। প্রথম শর্তে দেশে মাথাপিছু আয় ১২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, যা বাংলাদেশ অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। এখন দেশে মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় শর্তে মানবসম্পদের উন্নয়ন; অর্থাৎ দেশের ৬৬ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯ ভাগ। আর তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩২ ভাগের নিচে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ২৫ ভাগ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় এ সম্পর্কিত জাতিসংঘ সংস্থা দ্য কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) প্ল্যানারি সেশনে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্য বলে সুপারিশ করবে সিডিপি। এরপর তিন বছরের ট্রানজিশন পিরিয়ড শেষে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাবে। সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ চায় কিনা, তা আজ রবিবারের মধ্যে জানাতে সরকারকে চিঠি দিয়েছে সিডিপি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হলে তিনি গ্র্যাজুয়েশন প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে গ্র্যাজুয়েশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইআরডির ‘সাপোর্ট টু সাসটেন্যাবল গ্র্যাজুয়েশন’ প্রকল্পের প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (পিআইসি) সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আজ রবিবার ইউনাইটেড ন্যাশনস ইকোনমিক এ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসক) সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিডিপির সঙ্গে অনুষ্ঠেয় ভার্চুয়াল বৈঠকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের বিষয়টি উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ। এর পর দ্বিতীয় মূল্যায়নটি হবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সিডিপির প্ল্যানারি সভায়। আজকের প্ল্যানারি সভার পর আগামী বছরের ৮-১৫ জানুয়ারি সময়কালে হবে সিডিপির বিশেষজ্ঞ গ্রুপের সভা। সিডিপি মনোনীত ২৮ বিশেষজ্ঞ এ সভায় বাংলাদেশের অবস্থান পর্যালোচনা করবে। তাতে উত্তীর্ণ হলেই সিডিপি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য ইকোসকে বাংলাদেশের নাম সুপারিশ করবে। ইকোসক থেকে তা যাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়া মানে দরিদ্র বা গরিব দেশের তালিকা থেকে বের হওয়া। দরিদ্র দেশ হিসেবে আমাদের আর কেউ দুর্বল ভাববে না। এটা যেকোন দেশের জন্য গৌরবের বিষয়, গর্বের বিষয়, মর্যাদার বিষয়। এটা হলে দেশের ভেতরেও স্বস্তি তৈরি হবে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার কারণে বিশ্বের সব দেশের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী বলে বিশ্বের কাছে বিবেচিত হয়। এর ফলে উন্নয়নশীল হওয়ার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়, সেটা অনেকাংশেই কমে যাবে। ফলে দেশে বিদেশী বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়বে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ঋণ দিতে আগ্রহী হবে। আরও ১০ বছর শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা চায় বাংলাদেশ ॥ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা, কম সুদে বিদেশী ঋণ ও অনুদান পেয়ে থাকে। ওষুধ উৎপাদনেও অব্যাহতি পেয়ে আসছে। যদিও ওষুধের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এই সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত পাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এসব সুবিধা আর থাকবে না। গ্র্যাজুয়েশনের ঠিক পরপরই এটি মোকাবেলার জন্য বাংলাদশেসহ এলডিসিভুক্ত দেশ আগামী জুনে অনুষ্ঠেয় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে জিএসপি সুবিধা আরও ১০ বছর বহাল রাখার প্রস্তাব করবে। একই সঙ্গে, ওষুধের ক্ষেত্রে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ১০ বছর পর্যন্ত ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস থেকে অব্যাহতি পাওয়ারও প্রস্তাব রাখা হবে। বাংলাদেশ আশা করছে, ডব্লিউটিও’র বৈঠক থেকে এসব বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে। ঝুঁকি সত্ত্বেও এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য ‘গর্বের অর্জন’ হবে বলে মনে করছে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। ‘ইমপ্যাক্ট এ্যাসেসমেন্ট এ্যান্ড কপিং আপ স্ট্র্যাটেজিস অব গ্র্যাজুয়েশন ফ্রম এলডিসি স্ট্যাটাস ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক জিইডির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরণের পরও ইউরোপিয়ন ইউনিয়নে পাওয়া বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা অব্যাহত থাকবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। অন্যান্য দেশের দেয়া জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে গ্র্যাজুয়েশন ঘোষণার পর পরই। এরপর রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবেলায় যেসব পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে বাংলাদেশ, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ফ্রি ট্রেড এ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) স্বাক্ষর, রফতানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ। এবার করোনার প্রভাব মূল্যায়ন করবে সিডিপি ॥ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপারিশ করবে কোন কোন দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেয়া যায়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকের দুটিতে আগের তিন বছরে ধারাবাহিকতা থাকলেই কোন এলডিসিকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়। তবে এবার ওই তিন সূচকের বাইরে করোনার প্রভাবও মূল্যায়ন করা হবে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে ওই তিন সূচকের পাশাপাশি করোনার প্রভাব মূল্যায়নে এলডিসিগুলোর ওপর একটি সমন্বিত সমীক্ষা করা হচ্ছে। সিডিপি মনে করে, করোনার কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এসব দেশের স্বাস্থ্যসেবা বেশ দুর্বল। তাই তারা করোনা রুখতে হিমশিম খাচ্ছে। করোনার মতো আঘাত মোকাবেলা করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতায় বেশ দুর্বলতা আছে। তবে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতি এলোমেলো করে দিলেও ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পথে কোন সমস্যা হবে না বলে মনে করেন বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে একক আলোচনায় এই অভিমত ব্যক্ত করেন। এলডিসি উত্তরণপরবর্তী অর্থনীতির সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে টাস্কফোর্স ॥ এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েজন প্রক্রিয়া নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে কাজ করে আসছে ১০ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক এই টাস্কফোর্সের সভাপতি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা এতে যুক্ত রয়েছেন। টাস্কফোর্সকে বিভিন্ন তথ্য ও মতামত দিয়ে সহায়তা করতে সাত মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে এলডিসি উত্তরণ বিষয়ক কোর গ্রুপ। এই গ্রুপে এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই), বিজিএমইএ এবং চামড়া শিল্পসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর প্রতিনিধিরা রয়েছেন। টাস্কফোর্স ও কোর গ্রুপকে কারিগরি ও সাচিবিক সহায়তা দিতে ‘সাপোর্ট টু সাসটেন্যাবল গ্র্যাজুয়েশন’ প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ইআরডির সচিবের সভাপতিত্বে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি), প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বে প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি (পিআইসি) ও প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ইউনিট (পিআইইউ) নামে আলাদা কমিটি রয়েছে। জাতিসংঘ সংস্থা সিডিপি ও ইকোসকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী অর্থনীতির সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা ও করণীয় নির্ধারণে এসব কমিটি কাজ করছে।
×