রাজধানীর আভিজাত্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবার চেয়েও মারাত্মক মাদক ‘আইস’। ‘এমডিএমএ’, ‘আইস’ ডিমেথ, মেথান ফিটামিন বা ক্রিস্টালমেথ নামে পরিচিত অত্যন্ত দামি এই মাদক সমাজের অতি বিত্তশালীদের সন্তানরা ব্যবহার করে থাকেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এই মাদক সেবনের ফলে ধ্বংস হচ্ছে অভিজাত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে মাদকদ্রব্যেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ‘সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম স্টিমুলেটিং ড্রাগস’ নামে পরিচিতি এই মাদক ইয়াবার চেয়ে শতগুণ ক্ষতিকারক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আইসের অন্যান্য নাম সেবু, ক্রিস্টাল ম্যাথ, ডি-ম্যাথ। তবে এর কেমিক্যাল নাম মেথাম ফিটামিন। সম্প্রতি পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে একজন আইস বা ক্রিস্টালমেথ ডিলারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলশান, বনানী ও ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আইস বিক্রি, সেবন ও পরিবহনের কাজে জড়িত থাকায় আরও অনেককেই গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার হওয়া মাদকের মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৬০০ গ্রাম ‘ক্রিস্টালমেথ’। মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা আইস মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতি ১০ গ্রাম বিক্রি করে থাকে এক লাখ টাকায়, যা রাজধানীর অভিজাত ও উচ্চবিত্তরা ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিবার মাদক আইস সেবনে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। গত বছর ২৬ ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ‘আইস’ পিল তৈরি ল্যাবের সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। ওই সময় মাদক তৈরির উপাদান ও কারখানার সন্ধান পাওয়া গেলেও হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। ওই সময় গোয়েন্দারা জানতে পারেন, আইসের উৎপত্তিস্থল অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন। আমাদের যুবসমাজ সাধারণত যেসব ড্রাগগুলোকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করে তাদের মধ্যে সিডাকসিন, ইনকটিন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল ইত্যাদি উল্লেখয্যোগ্য। সাধারণত এই মাদক গুলশান-বনানী এলাকার ইনডোর পার্টি সেন্টারে ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে। অভিজাত শ্রেণীর লোকের সংখ্যা বাড়ছে। সব মাদকের বাজার তৈরির পেছনে অর্থলগ্নি করা হয়। বাংলাদেশেও সেই চেষ্টা চলছে। রাষ্ট্র অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি দেখতে পাচ্ছে। মহামারীর দানবের মতো এ সামাজিক ব্যাধি যেন ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে শুরু করে সবুজ শ্যামলে ঢাকা গ্রাম বাংলায়ও। মাদকের ভয়াবহ পরিণতি দেখে আজ যেমন সমাজ ব্যবস্থা ও প্রশাসন বিচলিত, ঠিক তেমনি অভিভাবকরা আতঙ্কিত। চিকিৎসকরা দিশেহারা। আইস একটি স্নায়ু উত্তেজক ড্রাগ। এটি গ্রহণে হরমুন উত্তেজনা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এক হাজার গুণ বৃদ্ধি পায়। ১৮৮৭ সালে জার্মানিতে মেথা ফেটামিনের উৎপত্তি ঘটে। তিনটি ফরমেশনে এটি গ্রহণ করা হয়। প্রথমত, ধূমপান আকারে, কাচের পাইপের দ্বারা তৈরিকৃত বিশেষ পাত্রের মাধ্যমে। বর্তমানে মাদকদ্রব্য হিসেবে হেরোইন, মারিজুয়ানা এলএসডি, প্যাথেড্রিন, কোকেন, মরফিন, পপি, হাশিশ, ক্যানবিস, স্মাক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মাদক একটি সামাজিক সমস্যা। মাদকাসক্তি নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে সতর্কতা তাতে আমাদের দেশও শামিল হয়েছে। বর্তমানে মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে এক সর্বনাশা ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করেছে। দুরারোগ্য ব্যাধির মতোই তা আমাদের গ্রাস করছে। এর তীব্র দংশনে আজ প্রায় ধ্বংসের পথে আমাদের আগামী দিনের তরুণ সমাজের একাংশ । যে তরুণ যুবশক্তি দেশের প্রাণ, মেরুদণ্ড, নেশার ছোবলে আজ সেই মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়তে বসেছে। নেশার ছোবলে মৃত্যুতে ঢলে পড়ছে লাখো প্রাণ। ধ্বংস হচ্ছে পরিবার ও সামাজিক শান্তি। এদের কারণে সমাজে খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মদ, গাঁজা, ভাঙ, আফিম, চরস, ভদকা প্রভৃতি নেশাজাতীয় দ্রব্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। তা ছাড়াও ইয়াবা নামক মাদকের সর্বনাশা ছোবল বর্তমান সমাজকে ধ্বংস করছে। মাদকের ভয়াবহতা কমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানে ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি কিছুটা কমে এলেও ছড়িয়ে পড়ছে আইসের ন্যায় নিত্যনতুন মাদক। প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে মাদকের ধরন ও বিক্রির কৌশল।
সম্প্রতি নতুন মাদক আইস বা ক্রিস্টালমেথ আমদানির কারণে বর্তমানে এটি মারাত্মক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মাদক অতি মূল্যবান ড্রাগ। আসক্তদের কাছে ১০ গ্রাম এক লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিবর্তনের মাধ্যমে জাপানী সৈন্যদের, বিশেষ করে যুদ্ধবিমানের চালকদের অনিদ্রা, উত্তেজিত ও নির্ভয় রাখার জন্য মাদকের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৬০ সালে এর অপব্যবহার বেড়ে যায়। ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার মেথা ফেটামিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে ১৯৯০ সালে মেক্সিকোর মাদক ব্যবসায়ীরা বিবর্তনের মাধ্যমে মাদক হিসেবে এটি ছড়িয়ে দেয় আমেরিকা, ইউরোপ, চেক রিপাবলিক ও এশিয়াসহ পৃথিবীব্যাপী। ২০১০ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই বছর অস্ট্রেলিয়ায় মাদক হিসেবে এর ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও চীনে এর ব্যবহার রয়েছে ব্যাপক। জীবনঘাতী এই মাদক ব্যবহার করা হয় মূলত স্নায়ুর উত্তেজনা বাড়াতে। এটি সেবনে মস্তিষ্ক বিকৃতিসহ মৃত্যুও ঘটতে পারে। এই মাদকের মূল উপাদান মেথা ফেটামিন বিষণ্নতা থেকে মুক্তি ও প্রাণসঞ্চারে উজ্জীবিত হতে ১৯৫০ সালে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরে তা বিবর্তিত হয়ে ভয়ঙ্কর মাদকে রূপ নেয়। ইন্দ্রিয় অনুভূতি, সাহস ও শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি যৌন উত্তেজনা বাড়াতে এই মাদক পরিচিতি পেলেও এর ক্ষতিকর দিকই বেশি বলে জানা গেছে। এই মাদক সেবনে অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, শরীরে চুলকানিসহ নানা রোগ দেখা দেয়। ধোঁয়ার মাধ্যমের চেয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে এ মাদক নিলে মাত্র ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এর কার্যক্রম শুরু হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে যে কোন কর্মকাণ্ড ঘটাতে দ্বিধা করে না এই মাদক গ্রহণকারীরা। বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত মানবকল্যাণে সৃষ্ট ভেষজদ্রব্য যা নির্দিষ্ট মাত্রায় চিকিৎসকরা রোগীর সেবায় ব্যবহার করে থাকেন তার অপব্যবহার ও মাত্রাধিক্যতায় সমাজের অসাধু লোকদের মাধ্যমে সেই কল্যাণকর ভেষজদ্রব্যই অকল্যাণকর মাদক হয়ে উঠেছে। তবে মাদকদ্রব্যের উপাদানসমূহের ব্যবহার চিকিৎসা শাস্ত্রের তুলনায় অপব্যবহারই বেশি হচ্ছে। মাদকদ্রব্য হলো ভেষজদ্রব্য যা প্রয়োগে মানবদেহে মস্তিষ্কজাত সংজ্ঞাবহ সংবেদন হ্রাস পায় বা থাকে না বললেই চলে। মাদকদ্রব্য গ্রহণে মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় না থেকে অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে যায় এবং তার ফলে এক সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য চালু আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঙ্গীদের চাপ এবং বন্ধুদের কাজ সমর্থনের চেষ্টা, নেশার প্রতি কৌতূহল, সহজে আনন্দ লাভের বাসনা, নিজেকে স্মার্ট দেখানোর জন্য, প্রথম যৌবনের বিদ্রোহী মনোভাব, মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা, প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ, পারিবারিক পরিমলে মাদকের প্রভাব, ধর্মীয় অনুভূতির অভাব, মাদকের সহজলভ্যতা ইত্যাদি কারণ মাদকের প্রতি উৎসাহিত করে তোলে। একজন মাদকাসক্ত নানা শারীরিক সমস্যা ও জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়াও মাদকের কালো থাবা এমনভাবে মানুষকে গ্রাস করে, যাতে মানসিক উশৃঙ্খলা, অবসাদ, বিষণ্নতায় ভোগে। পাশাপাশি কোন পরিবারের ছেলে, স্বামী, মেয়ে যে কোন সদস্য মাদকাসক্ত হলে সমগ্র পরিবার সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হয়। সমাজে সবাই এদের অপরাধী মনে করে এবং সে নজরেই দেখে। কারণ নেশার পয়সা জোগাড় করতে এ ব্যক্তিরা নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী কারও কাছে মান সম্মান থাকে না। অপরদিকে নেশার টাকা জোগানোর জন্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই অপকর্ম ছাড়াও ঘরবাড়ি হতে আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র বিক্রি করে মাদকাসক্তরা নিজে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, পরিবারকেও পথে বসাচ্ছে। এমনও ঘটনা আছে যে, নেশার টাকা না দিতে পারায় মাদকসক্তরা পরিবারের সদস্যকে খুন পর্যন্ত করেছে। কারণ তখন বাবা-মা, ভাই-বোন সম্পর্কে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মাদকাসক্তি এমন এক দুর্বার নেশা যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। মাদক কীভাবে মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় তা সে নিজেও জানে না, বুঝতে পারে না এবং অপরকে বুঝতেও দেয় না। তাই মাদকের সর্বগ্রাসী থাবা থেকে বাঁচতে এর কুফল সম্পর্কে জানতে হবে। জানাতে হবে অপরকে। বাড়াতে হবে সামাজিক সচেতনতা। মাদক প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা, পরিমিত জীবনযাপন, বন্ধু নির্বাচন, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি মাদকাসক্তি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের আসল উপায়।এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে এর কুফল জানাতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়