ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্বিগ্ন বিশ্ব

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ১৫ নভেম্বর ২০২০

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্বিগ্ন বিশ্ব

বর্তমান শতাব্দীকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের জন্য আধুনিকতার বসন্তকাল বিবেচনা করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নতি, জীবন যাপনের নানা উপকরণের নতুন সব উদ্ভাবন আর সহজ লভ্যতার চলমান সময়কে আধুনিক যুগ নামেও ডাকা হয়। তবে পাশাপাশি যাদের জন্য পৃথিবীর এত আয়োজন, তাদের সামগ্রিক অবস্থাদৃষ্টে গোটা বিশ্বের সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের বিভিন্ন সময়ে বেশ আক্ষেপ করতে দেখা যায়। কথা উঠে আসে বস্তুগত সভ্যতার অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে, মানুষ চাঁদের পর মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্বের উন্নতি-অবনতির হিসাব মিলাতে গেলে আশার আলো ক্ষীণ দেখায়। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামষ্টিকতার সব কয়টি ধাপে মানুষ ক্রমেই যেন অন্ধকারে অবগাহন করছে। ফলে বিবেক ও সুস্থবোধের তাড়নায় পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বার বার ঘুরেফিরে উচ্চকিত হচ্ছে মানবাধিকারের কথা, নারী অধিকার ও মর্যাদা-ইস্যু, হারিয়ে যাওয়া সুস্থ-সুন্দর জীবনের কথা, সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়, স্বাধীনতার কথা, মানুষের সার্বিক নিরাপত্তার অভাব ও চূড়ান্ত মুক্তির প্রসঙ্গ। এসব বিবেচনায় একুশ শতক গোটা বিশ্বের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে যে শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছিলেন, জেল থেকে মুক্ত হয়ে সেই শ্বেতাঙ্গদের এক নেতা ডি-ক্লার্কের সঙ্গে এক হয়ে দেশ গঠনে কাজ করেছেন। একইসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে পরবর্তীতে পার্টি প্রধান ও সরকার প্রধান থেকে সরে গিয়ে নতুন নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আফ্রিকার একচ্ছত্র নেতার আসনে আজও সারাবিশ্বে তিনি সমানভাবে সমাদৃত। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে এই পরাশক্তির অলিখিত তকমাটা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। বিশ্বে ক্ষমতায়নের বিস্তারে মূল ভূমিকা সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের। যেমন- বিশ্বব্যাপী আমেরিকার সর্বগ্রাসী প্রভাবের মূল ভিত্তি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের দীর্ঘস্থায়ী সামরিক ও কূটনৈতিক মিত্রতা। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে সময়ের ব্যবধানে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা উইলসন সেন্টারের গবেষক মাইকেল কফম্যান বলছেন-শীতল যুদ্ধ ছিল বিশ্বের দুই পৃথক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রেষারেষি, প্রতিযোগিতা। সে সময় দুই পরাশক্তি তাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির বলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল। বিশ্বজুড়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের কারণে ঐ প্রতিযোগিতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল তখন। আরেকটি কারণ ছিল সামরিক শক্তির ভারসাম্য। কিন্তু এখনকার বিরোধের পেছনে সামরিক সেই ভারসাম্য নেই অথবা আদর্শের কোন লড়াই নেই। এখনকার বিরোধের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে কিছু নেতার কিছু সিদ্ধান্ত, কৌশল এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। এছাড়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে চীনের উত্থান বিশ্বশক্তি আমেরিকার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি ও চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। চীনের উত্থান এবং আমেরিকার প্রতি চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও ব্যর্থ করে দেয়ার উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে আমেরিকা চীন বিরোধী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট হিসেবেই-ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোট গঠনের চেষ্টা করে চলেছে বলে বিশেষজ্ঞ অভিমত। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্বে ওই অঞ্চলে আমেরিকার কৌশলগত নীতিতে তেমন কোন পরিবর্তন না এলেও ট্রাম্প প্রশাসনের সময় দীর্ঘ সময় ধরে পরিচিত, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের নাম বদলে ফেলে নতুন নামকরণ করা হয়েছে-ইন্দো-প্যাসিফিক। সে সঙ্গে, ওই অঞ্চলের কৌশলগত নীতিতেও পরিবর্তন এনেছে আমেরিকা। এই নীতির আলোকেই ট্রাম্প প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রণীত হয়েছে। আমেরিকান ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলটি বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়, যা একটি অপরটিকে অনুসরণ করে। যেমন-চীনের উত্থান, যা আমেরিকার বিশ্বশক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমেরিকা তার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ শক্তির নবায়ন ও শক্তিশালীকরণের ওপর জোর দেবে এবং পাশাপাশি জোট গঠন ও কৌশলগত অংশীদারিত্বকে (বাহ্যিক ভারসাম্য) জোরদার করার ক্ষেত্রে ভারসাম্য অনুসরণ করে ওই চ্যালেঞ্জের জবাব দেবে। এই হুমকি শুধু আমেরিকার জন্যই নয়, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জন্যও। আমেরিকান কৌশলগত ভারসাম্যের নীতিটি ওই দেশগুলোর পক্ষেও কার্যকর হতে পারে। অর্থাৎ, চীনের বিরুদ্ধে, পাল্টা কৌশল হলো, আমেরিকার নিজস্ব সামরিক শক্তি গঠন ও বৃদ্ধি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক জুড়ে মিত্র ও অংশীদারদের সন্ধান করা। কিন্তু আমেরিকার কৌশলগত এই পরিবর্তনের পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। একটি হলো, ভূ-অর্থনৈতিক এবং অন্যটি হলো, ভূ-রাজনৈতিক। একদিকে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান এবং ভারত মহাসাগরে চীনের একক কর্তৃত্ব স্থাপনের প্রচেষ্টা, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচী, দক্ষিণ চীন সাগরের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব ইত্যাদি কারণে ওই অঞ্চলের প্রতি আমেরিকার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে অনেক বেশি। এই অঞ্চলের ওপর প্রভুত্ব করা নিয়ে চীন আমেরিকার দ্বন্দ্ব-বিরোধ অনেক পুরনো। একদিকে, ভারত-আমেরিকা মৈত্রী, অন্যদিকে চীন-পাকিস্তান মৈত্রী। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচী, এই অঞ্চলে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে। অবশ্য চীন এই অঞ্চলের এবং একই সঙ্গে বিশ্বরাজনীতির অন্যতম ফ্যাক্টর। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে দেশটি অন্যতম বৃহৎ শক্তি। আমেরিকান সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন শতাব্দীতে কেবল চীনই আমেরিকার সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করে। ২০০৬ সালে পেন্টাগনও চীনকে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান প্রতিযোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তাই চীন হচ্ছে আমেরিকার টার্গেট। চীনকে মোকাবেলার লক্ষ্যে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ‘কনটেন্টমেন্ট তত্ত্ব’ অনুসরণ করছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলা ও সমাজতন্ত্রের কর্তৃত্ব, বিশ্বরাজনীতি থেকে মুছে ফেলা ছিল এই তত্ত্বের মূলকথা। এমনকি এই চার দশকের মধ্যেই আমেরিকার এই তত্ত্ব ফলও দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছিল। ওই একই তত্ত্ব এখন চীনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে চলেছে আমেরিকা। কারণ, চীনের পতন চায় আমেরিকা। ১৯৪৫ সালের পর থেকে আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং ১৯৮০ সালের পর থেকে ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্ব করে আসছে। এখন আমেরিকা ও তার মিত্রদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের দ্বারা বাধার সম্মুখীন। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে আমেরিকা ও মিত্রদেশ ভারত ক্রমবর্ধমান চীনা উপস্থিতির সম্মুখীন। অর্থাৎ চীন এখন আমেরিকার কর্তৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য চীনের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে চীনকে কোণঠাসা করার কৌশল ও চীনকে ঘিরে ফেলার কৌশলের অংশ হচ্ছে এই জোটের রাজনীতি। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে চারদিকে অস্থিরতা ও যুদ্ধের দামামা। দেশে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ, জাতি- গোষ্ঠীর ঘৃণা, হানাহানি। আরও আছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি। শান্তি এখনও সুদূরপরাহত। স্থিতিশীলতা বিশ্বজুড়ে নানাভাবে বিঘ্নিত। সমতা ও ন্যায়বিচারের অভাব প্রকট। বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর এক-পঞ্চমাংশ রয়েছে চীনে। দেশটি নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে এবং অবশ্যই ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সাধনে দীর্ঘ পথ এগিয়ে গেছে। চীন জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন করেছে। তাদের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং মানবজাতির উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যার ফলশ্রুতিতে আজ চীন বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে দাঁড়িয়ে। বোধগম্য কারণেই চীনের প্রতি বিশ্বের মনোযোগ বাড়ছে। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, চীনের বর্তমান নেতৃত্ব চীনকে শান্তি, অগ্রগতি ও মর্যাদার আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং এশীয় অঞ্চলে ও সাধারণভাবে গোটা বিশ্বকে আরও শান্তিময়, সম্প্রীতিময় ও বাসযোগ্য করে গড়ে তোলায় প্রভূত অবদান রাখবে। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো যত বেশি মহাশক্তি হতে যাবে, যুদ্ধ ততই অনিবার্য হবে। সেই আদিম মানব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ছিল। এই আধুনিক ইতিহাসেও তা বর্তমান। বিশ্ব শক্তিগুলো পাল্লা দিয়ে শক্তি সঞ্চয় ও বৃদ্ধি করছে। যুদ্ধের ধরন পাল্টালেও তার ফলাফল এখন অনেকটা আগে থেকেই অনুমিত। অর্থাৎ, যুদ্ধে কারা জয়লাভ করবে বা কারা পরাজিত হবে, তা আগে থেকেই ধারণা করা যায়। আর তা সম্ভব হয়েছে তথ্যের কারণে। দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উদার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চীন বা রাশিয়া মেনে নেয়নি এবং তাদের ওপর সেটা চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতাও এখন পশ্চিমা বিশ্বের নেই। ফলে রাজনীতিতে ক্ষমতার রেষারেষি ফিরে আসছে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য পশ্চিমা বিশ্বেরও কিছুটা দায় রয়েছে এবং নতুন এক শীতল যুদ্ধের যে ধারণা পশ্চিমাদের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
×