ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যবিত্ত জীবনের আখ্যান

প্রকাশিত: ০০:০৬, ১৩ নভেম্বর ২০২০

মধ্যবিত্ত জীবনের আখ্যান

একজোড়া পয়ন্ত ইলিশ এক ইলিশ পাগল পরিবারের কাহিনী। ইলিশকে ঘিরেই এই পরিবারের যত টানপোড়েন, প্রত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, বিষাদ আনন্দ। মাহফুজা আর মোতাহের তরফদারের আনন্দময় সংসার। মোতাহের তরফদার চাঁদপুরের সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই বাবার কেনি আঙ্গুল ধরে বাজারে যেতেন। বাবার ইলিশ মাছ কেনা দেখতেন। তখনই বুঝতে শিখেছেন কোনটা খাঁটি ইলিশ, কোনটা বিস্বাদ। বিবাহিত জীবনেও তার ইলিশ বিলাস প্রচণ্ড। ঢাকার বাজারগুলো ঘুরে ঘুরে তিনি পয়মন্ত ইলিশ কেনেন। টাকা পয়সার দিকে না তাকিয়ে দু’হাতে বাজার করেন। ইলিশের ব্যাপারে তিনি উদারহস্ত। কোন তরকারির সঙ্গে ইলিশের কোন অংশটা রাঁধলে ভাল হবে তাও তার জানা। সেভাবেই বাজার করেন। আর মাহফুজাও স্বামীকে, সন্তানদের খাইয়ে তুপ্ত। মনপ্রাণ ঢেলে রাঁধেন। তরফদারের প্রকাশ কম। মুখে প্রশংসা কমই করেন। তবে তার পরিতৃপ্ত মুখ দেখে মাহফুজা বেশ বোঝেখ রান্নাটা ভালই হয়েছে। তিনি শুধু নিজে খেয়ে তৃপ্ত হন না, অন্যদের খাইয়েও তৃপ্ত হন। স্ত্রীর রান্নার হাত আর ইলিশের ব্যাপারে তার কেরামতি দেখিয়ে তিনি আনন্দ পান। তাই মাঝে মাঝে অফিস কলিগদের দাওয়াত করেন। সুখেই যায় মাহফুজার দিন। কিন্তু এ সুখ বেশিদিন সইলো না। একদিন এক জমজমাট ইলিশ পর্বের পর অকস্মাৎ অচেনায় চলে গেলেন স্বামী। তিন মেয়ে নিয়ে অকালে বিধবা হলেন মাহফুজা। তারপর কঠিন জীবন সংগ্রাম। জীবনের মধ্যযাম পেরিয়ে গেছে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তারা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। মাঝে মাঝে বায়বীয় আলাপ হয়। ছোট মেয়ে দিপু সংসারের হাল ধরেছে। চাকরি করছে। দিপুকে নিয়ে মাহফুজার যত চিন্তা। মেয়েটা স্বল্পবাক, চাপা স্বভাবের। এই মেয়ে একদিন তার স্বভাব ভেঙে জানাল, শিহাব নামের একটা ছেলে তাকে পছন্দ করে। পাকা দেখতে আসার দিন ঠিক হলো। দিপু লজ্জাবনত মুখে মাকে এটাও জানাল যে, গল্পে গল্পে শিহাবকে দিপু জানিয়েছে তার বাবার ইলিশ প্রেমের কথা। তাই রান্নার পদে যেন ইলিশ রাখা হয়। ওরা ইলিশ পছন্দ করে। এই ইলিশ নিয়ে শুরু হলো নতুন গল্প। মাহফুজার ঘরে ইলিশ নেই। তার বাড়িতে কোন মানুষ নেই যাকে দিয়ে ইলিশ কেনানো যায়। প্রতিবেশ, পাশের দোকানদার, মেয়ে দিপু কাউকে বলেই কোন সুরাহা হলো না। না জানি ইলিশের কারণে বিয়েটাই ভেঙে যায়। শঙ্কিত মাহফুজার মনে পড়ল, তার নাজু খালার মেয়ে নুসরাতের পানচিনিতে পায়েসে নুন দেয়া হয়েছিল বলে বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল আর আর নুরু ফুফার জামাই পোলাউয়ের ওপর রেবেস্তা বিছানো ছিল না বলে গালগাল করে তিন বছর শ্বশুরবাড়ি যায়নি। এমন নানা কুচিন্তায় যখন অস্থির মাহফুজা তখনই বেল বেজে ওঠে। তিতিবিরক্ত মাহফুজা দরজা খুলে যাকে দেখে তাকে দেখে তার বিরক্তি চরমে পৌঁছে। দূর সম্পর্কের দেওর কসিরউদ্দিন পাটোয়ারি। লোকটাকে খুব অপছন্দ মাহফুজার। সে কথা বলার সময় থুতু ছিটায়। হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে সুড়ুুৎ সুড়ুৎ করে আওয়াজ তুলে চা খায়। এই লোকটাকে আজই আসতে হলো! কসিরউদ্দিন ঘরে ঢুকে জানাল, ভাইজানকে স্বপ্নে দেখেছে। স্বপ্নে মনে হল তিনি তার কাছে ইলিশ খেতে চাইছেন। তাই মেঘনা ঘাট থেকে এই ইলিশ কিনে স্টিমারে উঠেছেন। তার হাতে ঝোলানো একজোড়া ইলিশ। এ গল্প এক মায়ের, এক মধ্যবিত্ত জীবনের, সবার বড় কথা এক জীবনের। এ গল্প পড়ে আমার মনে হয়েছে, লেখক জীবনকে দেখেছেন গভীরভাবে। তার গল্পের বর্ণনা এবং সংলাপে সেটা স্পষ্ট। গল্পে উঠে এসেছেন আমাদের সমাজে বাস্তবতা। পায়েসে নুন দেয়া আর বেরেস্তা না ছিটানোর মতো ছোটখাটো বিষয় দেখার এবং সে বিষয় আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার মতো লোকও এ সমাজে আছে। সহকর্মীর স্ত্রীর রান্না, সাজগোজ আর মেহমানদারির বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক সমাজের হঠাৎ স্মার্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া নারীদের তুলে এনেছেন। পাশাপাশি যে মেয়ে চাপা স্বভাবের সেও তার ঐতিহ্য, তার বাবার ইলিশ প্রীতির কথা বলতে ভোলেনি। সে শুধু ইলিশের গল্প করে না। সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করে তার বাবাকে। আর বিদেশে উড়াল দেয়া দুই মেয়ের সঙ্গে বায়বীয় আলাপের মাধ্যমে লেখক বিচ্ছন্ন সংসারের চিত্র তুলে ধরেছেন। এ বিচ্ছিন্নতা বড়ই বাস্তব। কেউ হয়ত প্রয়োজনে, কেউ আরও ভাল থাকার উন্মাদনায় বিদেশে যায়। এ উন্মাদনা নেশার মতো। যা মা মেয়েকে আটকে রাখে তারের সুতোয় বা বাতাসের কম্পনে। একজোড়া পয়মন্ত ইলিশ গ্রন্থের অন্য গল্পগুলোও সমাজ বাস্তবতার চিত্র। ঝরঝরে সাবলীর ভাষায় লিখেছেন তিনি। ‘কুইচ্যা মুুরগি’ -এর মতো অঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চমৎকার। কিছু উপমা অসাধারণ। যেমন, ‘পাওয়ার টিলারের মতো দুর্মর জল¯্রােত।’ লেখক দিলারা মেসবাহকে ধন্যবাদ জানাই এমন কিছু জীবন ঘনিষ্ঠ গল্প আমাদের উপহার দেবার জন্য। তাকে অভিনন্দন জানাই সাধারণ মানুষের গল্প বলার জন্য। তার দীর্ঘ প্রাণময় বেগবান লেখক জীবন কামনা করি।
×