ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আলমগীর রেজা চৌধুরী

গল্প ॥ কবেকার অন্ধকার

প্রকাশিত: ০০:০২, ১৩ নভেম্বর ২০২০

গল্প ॥ কবেকার অন্ধকার

চারদিকে ঘন কুয়াশা। শেষ রাতের দিকে চাঁদ যেন মরে গেছে। কুয়াশার ঠাশ বুনন ভেদ করে সামনে কিছু দেখার উপায় নেই। অন্ধকার আর কনকনে শীতে ঠক্ঠক্ করে কাঁপছে রোকন। ওপাশে শীতের মৃত নদী। রোকনের সামনে উঁচু মাটির ঢিবি। সেটা না থাকলে এ রকম খোলা জায়গায় নির্ঘাত আত্মাহুতি দেয়া ছাড়া উপায় নেই। কে কোথায় পজিশন নিয়েছে রোকন জানে না। এক পাশে তোফাজ্জল হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে রাইফেল তাক করে। তোফাজ্জলকে দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ শব্দ করে ও ওর উপস্থিতি জানাচ্ছে। রোকনের খুব সিগারেটের তৃৃষ্ণা পায়। রাতে ঘুমানোর আসে তিন শলা থেকে এক শলা খেয়েছিল, অবশিষ্ট দুটো তখনও পকেটে। কিন্তু উপায় নেই। দিয়াশলাই বালিশের নিচে ছিল তেমনি রয়েছে হয়ত। জোছনা যখন আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে তখন সমীর সংবাদ নিয়ে পৌঁছে। ঘুম থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে মোনায়েমকে অনুসরণ করে এসে এই ঢিবির আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে রোকন। কমান্ডার বলেছিল কিছুক্ষণের মধ্যে আক্রমণ হতে পারে। সমীরকে রোকনের বিশ্বাস নেই। গত তিন দিন ধরে একই সংবাদ নিয়ে কমান্ডার বেশ বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। রোকনের রাগ বাড়তে থাকে। হেড কোয়ার্টার থেকে তিন দিন আগে এখানে এসে অপেক্ষা করতে হচ্ছে দশজনের এই দলটিকে। রোকন জানে, কমান্ডারের কোন যুদ্ধ প্ল্যান নেই। নির্ঘাত গাড়ল একটা। সারাক্ষণ হুঁশ হুঁশ করে সিগারেট টানে, বেড়ালের মতো পিট পিট করে তাকায়। এ রকম মানুষগুলোর আইকিউ তীক্ষè হয় কিন্তু ওর বেলায় হয়েছে বিপরীত। আবার বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার ছিল। পোঁন্দে লাথি মেরে বের করে দেয়নি এই বেশি। কথা বলার সময় মনে হয় জেনারেলের পদটি না দিয়ে ভুল করেছিল পাক সরকার। প্রথম থেকেই এ লোকটি রোকনের কাছে এ্যালার্জির মতো। কমান্ডার কী জানে রোকন ওকে সহ্য করতে পারে না? মনে হয় না। সেই মনোভাব রোকন কোন সময় প্রকাশ করেনি তার চেয়ে বরং অন্যদের তুলনায় তার প্রতি আস্থা পোষণ করে বেশি। এই তো এই ঢিবির আড়ালে পজিশন নেয়ার পর কমান্ডার দু’বার এসে দেখে গেছে। হাতে সিগারেট। তা দেখে রোকনের তৃষ্ণা আরও বেড়ে যায়। একবার বলতে ইচ্ছে করে- ‘জব্বর ভাই সিগারেট খাব, আগুনের দরকার।’ এ রকম চ‚ড়ান্ত মুহূর্তে সিগারেট খাবার নিয়ম নেই। হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করলে বকাঝকা শুনতে হবে। শালা গাড়ল কেমনে হুঁশ হুঁশ করে সিগারেট টানছে। কমান্ডার চলে যেতেই তোফাজ্জল ডাকল, ‘রোকন, দিয়াশলাই আছে?’ ফ্যাস ফ্যাসে কণ্ঠে খুব অপরিচিত লাগে। ‘না নেই। আমারও খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। ভাবছি তোর কাছে আছে বোধ হয়?’ একটু উচ্চৈঃস্বরে বলল রোকন। ওদের কণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে কমান্ডার ছুটে আসে। ‘বোকামি করো না রোকন, শত্রæবাহিনী আমাদের অবস্থান জেনে গেলে ভীষণ খারাবি হবে!’ কমান্ডারের কণ্ঠ বেয়ে ঝবে পড়ে শ্লেষ। রোকন কথা বলে না, ওর বিরক্তি লাগে। নদীর ওপারেই ওরা আসে নাই, অথচ নদীর পারে আমাদের লোক বসে আছে, কমান্ডারের ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে শত্রæ ঘাড়ের কাছে রাইফেল উঁচিয়ে বসে আছে। দূরে কোথাও হুক্কা-হুয়া রবে শেয়াল ডাকে। এখন রাতের শেষ প্রহর। আর ঘণ্টাখানেক পরই সূর্য উঠবে। কনকনে শীত সূঁচের মতো বিদ্ধ করছে লোমকুপে। সোয়েটারে শীত মানতে চায় না। রাইফেলে হাত রাখলে হিম হয়ে আসে। শির শির করে গা। এভাবে আরও দশ মিনিট চুপচাপ বসে রইল রোকন। দীর্ঘ একটা হাই শেষে তোফাজ্জলকে ডাকতে যায় ও। ঠিক এ সময় একঝাঁক গুলি ভেসে এলো মেশিনাগান থেকে। বুকের ভেতর একবার নড়ে ওঠে রোকনের। পরক্ষণেই রাইফেলটা আঁকড়ে ধরে শক্ত করে। চারদিক একনাগাড়ে গুলির শব্দ। শত্রæদের গুলি অনেক দূরে গিয়ে পড়ছে। ওরা ধারণাই করতে পারেনি মুক্তিবাহিনী এত কাছে পজিশন নিতে পারে। সাঁই সাঁই করে মাথার ওপর দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে রোকন। বুলেট এখন শেষের দিকে। এখনও সাপ্লাই আসছে না কেন? আর মাত্র তিনটে বুলেট আছে। শেষ সম্বল হারাতে চায় না রোকন। তা ছাড়া যেভাবে গুলি যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে সরতে গেলে নির্ঘাত মরতে হবে। আস্তে আস্তে বের হচ্ছে। আবছা দেখা যায়, তোফাজ্জল ওর পজিশনে নেই। ওরা কি সব পালিয়েছে? নিজকে অসহায় ভাবতে শুরু করল রোকন। এ সময় অবশিষ্ট তিনটে বুলেটে আর কোন ভরসা জোগায় না। তার চেয়ে বরং নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়া প্রয়োজন। গোলাগুলি এখন কমে আসছে। হঠাৎ হঠাৎ ঠাস করে উঠে রাইফেলের গুলি। কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রæ নদী পার হয়ে এদিকে মার্চ করবে। এখন উপায়। খুব দ্রæত ভাবতে থাকে রোকন। খুব নিঃশব্দে পিছু হঠতে থাকে রোকন। জোরে দৌড় দিল। কিছু দূর যেতেই অস্পষ্ট কথাবার্তা কানে আসতে থাকে। রোকন ভাবল ওরা ইতোমধ্যে নদী পার হয়ে গেছে। একটু পরিষ্কার হলেই ধরা পড়ে যাবে রোকন! আবছা দেখে সামনে মৌড়ালের ঝোপ। তার আড়ালে আশ্রয় নিতেই বাঙ্কারের মতো এক গর্তে আদৃশ্য হয়ে যায় রোকন। মাথার ওপর ঘাসের বাড়ন্ত ডগার আবরণ। বেশ নিরাপদ বোধ করতে থাকে ও। কুয়াশা কেটে গিয়ে রোদ্দুর উঠল। রোকন একবার মাথা বের করে তাকাল, অস্পষ্ট কুয়াশা, পাক বাহিনী নদীর এপারে উঠে এসেছে। প্রচন্ড শীতে হাত-পা জমে যাচ্ছে। রোকন দেখে ধুপ ধপ করে পা ফেলে গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। গর্তটায় এতোক্ষণ ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। এখন আলো ঢুকছে। রাইফেল এক পাশে সরিয়ে রেখেছিল অনেক আগে। হঠাৎ করে রাইফেলের ব্যারেল বরাবর নিচের দিকে তাকায় রোকন। এক মুহূর্তের জন্য আঁতকে ওঠে। একটা মাথার খুলি, তার পাশে একগুচ্ছ দীর্ঘ চুল পড়ে আছে। এতক্ষণ পর ভয় শুরু হয় রোকনের। কিন্তু উপায় নেই, এখান থেকে বের হলে নির্ঘাত মৃত্যু। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে ওর। এতক্ষণ একটা কঙ্কালের পাশে বসেছিল, তাও আবার কবরের ভেতর! এক নজর তাকায় খুলি এবং চুলগুলোর দিকে। মিচমিচে কালো। ও একবার মাথা বের করে দেখে পাক সেনাদের শেষ দলটি গ্রামের দিকে যাচ্ছে। এক পলক তাকিয়ে থেকে কাছিমের মতো মাথাটা আবার গুটিয়ে নিল। চুলগুলোর দিকে আবার তাকিয়ে থাকে। অন্তহীন নিঃস্তব্ধ তা কবরের ভেতর। রোদ এতক্ষনে তাতিয়ে উঠেছে। আবার কবর থেকে মাথা বের করল রোকন। গ্রামের দিকে তাকাতেই চোখ স্তির হয়ে যায় ওর। গ্রাম জ্বলছে। অসংখ্য বাড়ি ঘরে একবারে আগুন দিয়েছে ওরা। কুয়াশা কেটে যাওয়াতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রোকন। পাকবাহিনী গিজ গিজ করছে এলাকাটা। অক্ষম চোখ দুটো আবার ফিরে এলো সেই চুলগুলোর কাছে। হতাশায় নুয়ে পড়ে ও। আকস্মিক চুলগুলো খুব চেনা মনে হতে থাকে। অবিকল মিকির মতো। এতটুকু তফাত নেই। আশ্চর্য। কলেজের এক সঙ্গে পড়েছে। ও কত যে বিলি কেটেছে মিকির চুলে। মিকিকে রোকন সত্যি কি ভালবাসে? ঠা-ঠা করে লাইট মেশিনগানের গুলি হচ্ছে। উল্লাসে দস্যুরা গুলি করছে। আবার মাথা বের করে দেখতে চেষ্টা করে রোকন। বাড়ি-ঘুরগুলো পুড়ে গেছে অনেক আগে। নিভু নিভু আগুনের ধোঁয়া উড়ছে। দেখতে দেখতে আগুন নিভে গেল। পোড়া ধ্বংসস্ত‚প এখন সারা গ্রাম। মাঝে মাঝে আগুনের হাল্কা বাতাসে উড়ছে। রোকন তাকিয়ে থাকে অসহায় দৃষ্টিতে। আর কতক্ষণ নিজের অক্ষমতাকে পুষে রাখবে? রাগে দুঃখে আবার কাঁদতে ইচ্ছা করল। হাত বাড়িয়ে রাইফেলের অস্তিত্ব অনুভব করে। শক্ত করে আঁকড়িয়ে ধরে বুলেটগুলো। এক এক করে খুলে নেয় সব। মাত্র তিনটে বুলেট। আবার রাইফেল লোডেড করে, চুলগুলোর দিকে তাকায়। অবাক হয় রোকন। রোকনের ভুল হওয়ার কথা নয়। ওগুলো বীথির চুল। ওর একমাত্র বোন। এক সঙ্গে বড় হয়েছে। চোখ জলে ঝাঁপসা হয়ে আসে। মাথার রগগুলো দাপাদাপি করতে থাকে। আকাশের দিকে তাকায়। নিঃসঙ্গ চিল উড়ছে অনেক ওপরে। ওর সোনালি ডানায় রোদের ঝিকিমিকি। এতক্ষণে কবরের মুখে রোদ্দুর। রোকনের খুব তৃষ্ণা পায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হামাগুঁড়ি দিয়ে কবর থেকে বর হয়। রোদ গায় করে চিৎপাত শুয়ে থাকে কতক্ষণ। মায়ের কথা মনে পড়ে, বীথির কথা, মিকির কথা। যা ভুলে যায় এক সময়। দূরে অনেক দূরে রাইফেল গর্জে ওঠে। হানাদাররা ফিরে যাচ্ছে রাইফেল কাঁধে। মৌডাল ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আসে রোকন। নিজের অজান্তে বলে ওঠে- ‘জয় বাংলা?’ আবার মনে পড়ে আগামীকাল সোমবার, সতের তারিখ। তারাবহ ক্যাম্প আক্রমণ করতে হবে। সব প্লাটুন একত্রিত হবে আজ। হানাদারদের নিস্তার নেই। নিভে যাওয়া ধ্বংসস্ত‚পের পাশ দিয়ে ওর ভেতর আগুনের হলকার মতো ছুটে যায় প্রতিশোধ স্পৃহায়।
×