ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সব্যসাচী দাশ

বিষণ্ণতার নীল কুয়াশায় ঘেরা...

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ১২ নভেম্বর ২০২০

বিষণ্ণতার নীল কুয়াশায় ঘেরা...

‘যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়’ জীবনানন্দ দাশের এই লাইন ধরে বলছি, এখন হেমন্তের পূর্ণ যৌবনকাল! হাল্কা শীতের মিষ্টি চাদর যেমনি আমাদের জড়িয়ে ধরেছে, তেমনি বিষণœতার নীল কুয়াশাও আমাদের ঘিরে ধরেছে! কিছু কাল আগের কথা, এমনি কার্তিকের দিনে শহর থেকে শুরু করে আবহমান বাংলার প্রত্যন্ত সব জনপদে মৌসুমি উৎসবের রথ ঘুরে বেড়াত। কিন্তু প্রচলিত ওই উৎসবের রথ বর্তমানে এসে থেমে গিয়েছে! বলা চলে, অতীতের সেই আমেজ এখন আর আমাদের মধ্যে বর্তমান নেই। হারিয়েছে। হয়ত একেবারেই হারিয়েছে! বাঙালী সত্তার সঙ্গে। আমরা এখন সংস্কৃতি বিমুখ হয়ে পড়েছি। গ্রামীণ যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, সার্কাস কিংবা পাড়া-মহল্লায় অনুষ্ঠিত হরেক রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবই আজ নির্বাসিত! তবে কি নিঃশেষের পথে বাঙালী জাতিসত্তার নিজস্ব পরিচয়। বিশেষ করে, সাধারণ মানুষের সব থেকে বড় আগ্রহের বিষয় ছিল যে স্বদেশী চলচ্চিত্র; তা ও এখন অস্তগামী সূর্যের ন্যায় পাটে বসেছে। সপরিবার বা স্ববান্ধে সিনেমা দেখার যে অভ্যাস আমাদের ছিল সে সব আজ কেবলই অতীত। এর কারণও অধিক। বর্তমান সময়ে দেশের বিভাগীয় বড় শহর ছাড়া বেশিরভাগ জেলা শহরে সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। উল্লেখ্য, দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জেলা বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা মতো শহর ঘুরে দেখা গিয়েছে, এসব জেলায় সিনেমা হলের যে ইমারাত রয়েছে- সেখানে সিনেমা প্রদর্শন কিংবা মিলনাতয়নে দর্শণার্থীদের বসার যেমন কোন পরিবেশ নেই, তেমনি নেই কোন আশাজাগানিয়ার খবর। যদিও এমন বাস্তবতায় আমরা রাজধানী থেকে অনেক আশার বাণী শুনি কিন্তু, তার ফল অন্তসার শূন্য বলেই বর্তমান। এভাবেই চলছে অনেক দিন ধরে, আমরা সিনেমা, নাটক, সঙ্গীত সর্বোপরি নিজস্ব্য সংস্কৃতি চর্চায় খেই হারিয়ে ফেলেছি, এ কথা নতুন নয়। তবে এক্ষেত্রে কফিনে শেষ পেরেক মেরেছে ‘করোনাভাইরাস’। এই মহামারীর প্রভাবে চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশের অবশিষ্ট সিনেমা হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়, সঙ্গে সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ! যদিও গত মাসের ১৬ তারিখ নাম মাত্র খোলা হয়েছে সিনেমা হল। এরও কিছু আগে শুরু হয়েছে নাটক সিনেমার অসমাপ্ত কাজ কিন্তু, এর রেজাল্ট যে অর্থহীন তা এখন স্পষ্ট! গত এক মাসে প্রকৃতার্থে সিনেমা মুক্তি পেয়েছে একটি তাও আবার হাতেগোনা দুই-তিনটি সিনেমা হলে। চলতি মাসে নতুন সিনেমা মুক্তির সম্ভাবনা নেই! দায়ে পরে যে সব সিনেমা হল খুলেছে সেগুলো পুরনো সিনেমা চালিয়ে দিন কাটাছে এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া শূন্য। রাজধানী শহরের বেশিরভাগ সিনেমা হলের পরিবেশ তুলনামূলক ভাল হওয়া সত্ত্বেও নতুন সিনেমার অভাব এবং লোকসানের কারণে বন্ধ রয়েছে। প্রসঙ্গে মধুমিতা সিনেমা হল মালিক এবং প্রাক্তন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় বর্তমানে তাদের অবস্থা এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে। জবাবে নওশাদ আনন্দকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে আমার হল বন্ধ রয়েছে। কেবল আমারটাই নয় ঢাকা শহরের বেশিরভাগ সিনেমা হল এখন বন্ধ! কি করব কোন উপায় নেই। সব শেষ ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ মুক্তি পেয়েছে নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় এই ধরনের সিনেমা দিয়ে দর্শক হলে ফেরানো যাবে না। দরকার শাকিব খানের নতুন সিনেমা। কিন্তু তার প্রযোজক এখনই নতুন সিনেমা হলে তুলবেন না। সময় পেরিয়ে গেলে যে গল্পের গুরুত্ব কমে তা তারা বুঝেও বোঝে না। তা হলে পুরনো সিনেমা চালিয়ে অযথা লোকসান গোনার কি মানে আছে। সে দিনও খসরু (প্রযোজক সমিরি সভাপতি) সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনিও সায় দিয়েছেন হল বাঁচিয়ে রাখতে ভারতের সিনেমা চালাতে। কিন্তু কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি। এভাবেই চলছে, আপাতত পরিকল্পনা হীন! এ বিষয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু আনন্দকণ্ঠকে বলেছেন, করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমাদের সিনেমার। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। চলতি বছর চলচ্চিত্র শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হিসেবে ভাবা হলেও করোনাভাইরাস সব কিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। সিনেমা হল খুললেও এই মুহূর্তে কেউ ঝুঁকি নিয়ে নতুন ছবি মুক্তি দিতে চাচ্ছেন না। আরও কিছু দিন সময় নিয়ে সবাই নতুন ছবি মুক্তি দিতে চায়। অনেক ভাল বাজেটের নতুন ছবি মুক্তির অপেক্ষায় আছে। এ সমস্যা বেশি দিন থাকবে না, খুব শীঘ্রই সমাধান হবে। এ ক্ষেত্রে হল মালিকদেরও সহযোগিতা দরকার। আমরা আশাবাদী খুব শীঘ্রই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারব, সিনেমার সুদিন ফিরবে। অন্যদিকে পরিচাল সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার মনে করেন, সিনেমা হল বন্ধ বা খোলা রাখা হল মালিক এবং প্রযোজক সমিতির সিদ্ধান্ত তাদের কিছু বলার নেই। তবে দীর্ঘ দিন হল বন্ধ থাকা এবং হল খুলে নতুন সিনেমা তোলার বিষয়ে একজন চিত্রপরিচালক হিসেবে আপনি কি মনে করেন? এমন প্রশ্নে গুলজার বলেন, তা তো বটে! নতুন সিনেমা ছাড়া তো হল চালিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তবে আমি যত দূর জানি সংশ্লিষ্টরা খুব শীঘ্রই বসে একটা সিদ্ধান্তে আসবেন। আশা করি ইতিবাচক খবর পাওয়া যাবে। খবর যাই পাওয়া যাক না কেন যে সিনেমার ভরসায় আবার হল খুলবে তাতে কি দর্শক ইতিবাচক সাড়া দেবে? মিটবে কি তাদের সিনেমা বা শিল্পের ক্ষুদা। গত কয়েক বছরে ঢাকাই সিনেমার তালিকা দেখলে দর্শক জয় করা সিনেমার সংখ্যা আঙ্গুল গুনে বলা যাবে। এতে করে একটা শিল্পের ভবিষ্যত সুপ্রত্যাশা করা যায়? চলচ্চিত্রের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে নামমাত্র চর্চা হচ্ছে, তাতে স্পষ্ট দেখা যায় চলচ্চিত্র শিল্পের মতোই চলছে আমাদের শিল্প রথ!
×