ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর থেকেই তৎপর নেতৃত্ব দিচ্ছেন হেফাজতের ঢাকার আমির নূর হোসাইন কাসেমী ও মামুনুল হকপন্থীরা

মরিয়া জামায়াত ॥ হেফাজতের দখল নিতে

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১২ নভেম্বর ২০২০

মরিয়া জামায়াত ॥ হেফাজতের দখল নিতে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বাইরে জামায়াত যুদ্ধাপরাধী বিরোধী চেহারা দেখালেও হেফাজত যে জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে সেটি স্পষ্ট হয়েছিল ২০ সেপ্টেম্বর আমির আল্লামা আহমদ শফীর জানাজার সময়েই। ওইদিন হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রবীণসব হেফাজত নেতা শফীর লাশের ধারেকাছে ঘেঁষতে না পারলেও লাশের খাটিয়া ছিল জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ নেতাদের কাঁধে! এর পর থেকে হেফাজতকে পুরোপুরি দখলে নিয়ে সরকার বিরোধীদের কাজে লাগাতে রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি-জামায়াত। হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে হেফাজতের ঢাকার আমির নূর হোসাইন কাসেমী ও মামুনুল হক পন্থীরা। ২০ সেপ্টেম্বর দেশবাসীকে অবাক করে দিয়েই জামায়াত-শিবির নেতাদের কাঁধে উঠেছিল হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক মহাপরিচালক ও হেফাজত আমির আহমদ শফীর মরদেহ। বিষয়টি উদ্বেগের হলেও শফীর জানাজায় ঘটেছিল এমনই ঘটনা। জামায়াতের প্রভাবশালী দুই শীর্ষ নেতা, সাবেক এমপি ও শিবিরের বর্তমান সেক্রেটারি কাঁধে বহন করেছেন আহমদ শফীর লাশের খাটিয়া। ইসলামি নিয়ম ও রীতি অনুসারে পরিবারের সদস্য অথবা নিকট আত্মীয়দেরই এ খাটিয়া বহন করতে দেখা যায়। ওই দিনই প্রশ্ন ওঠে, হাটহাজারী মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলাম এখন কি জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে? ভাইরাল হয়ে পড়েছিল ঘটনার ভিডিও, ছবি। হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। জামায়াত নেতাদের পাশে উপস্থিত কওমি মাদ্রাসা সংগঠনের অন্যতম নেতা আল্লামা মামুনুল হকের উপস্থিতি ওইদিনই বিতর্ক বাড়িয়েছিল। মামুনুল হকের জামায়াত সম্পৃক্ততা নিয়ে আগেই ছিল বিতর্ক। আহমদ শফীর জানাজা সম্পন্ন হওয়ার পর তার লাশ যখন বহন করতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন দেখা যায় মাওঃ মামুনুল হক, জামায়াতের চট্টগ্রামের সাবেক এমপি আলহাজ শাহজাহান চৌধুরী, সাবেক এমপি ও জামায়াতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও ছাত্র শিবিরের বর্তমান কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তার লাশ বহন করছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের আরও বহু নেতা। এখানেই শেষ নয়, ওইদিন কোন রাখঢাক না নিয়েই জানাজায় অংশ নেয়া জামায়াত-শিবির নেতাদের তালিকা প্রকাশ করে জামায়াত। এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী রাহিমাহুল্লাহুর জানাজায় অংশগ্রহণ করেছেন সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। বলা হয়, সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে জানাজায় আরও অংশগ্রহণ করেন কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য চট্টগ্রাম মহানগরী শাখা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরী শাখার সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম উত্তর সাংগঠনিক জেলা শাখার আমির আমিরুজ্জামান, চট্টগ্রাম মহানগরী শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মাদ উল্লাহ ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল সালাউদ্দিন আইয়ুবীসহ স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মী। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ মূলত বাংলাদেশের কওমি মাদ্রসাভিত্তিক একটি সংগঠন যা ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের কথিত ইসলাম বিরোধী ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করে আসছে। হেফাজতের মূল শক্তি কওমি মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসাগুলো হতে শিক্ষা লাভ করা কওমি আলেম ও শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ থেকেই কওমি আলেমদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের আকিদাগত (আদর্শগত) পার্থক্য বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানীদের পক্ষ অবলম্বন করায় কওমি অনেক আলেমের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে কওমি আলেমদের প্রহণযোগ্যতা সমাজে বৃদ্ধি পেতে থাকলেও বিতর্কিত কর্মকা- ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে জামায়াত তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির দেশের অন্যতম বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন হেফাজত ও কওমি মাদ্রাসাগুলোকে তাদের দখল নেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে আসছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রশিবির ১৯৮৫ সালে কওমি অঙ্গনের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় আক্রমণ করে মাদ্রাসাটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়। এ ঘটনায় তিনজন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে ছাত্রশিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা শাহ আহমদ শফী ১০ ছাত্রকে বহিষ্কার করলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে মাদ্রাসায় হামলা হয় যাতে ১০/১৫ জন আহত হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখ আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগ থেকেই হাটহাজারী মাদ্রাসায় জামায়াত ক্যাডাররা আনাগোনা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় মাদ্রাসায় তারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভিন্নভাবে প্রচার চালাতে থাকে। হাটহাজারীর ছাত্রদের সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ করে হাটহাজারী মাদ্রাসায় মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত আসামি দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদীর আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। হেফাজতের বিতর্কিত নেতা মুফতী হারুন ইজহার ও মাওলানা মামুনুল হকের যাতায়াত বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ছেলে মামুনুল হকের স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কীয় অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজন জামায়াত-শিবিরের সদস্য বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ আছে। জানা যায়, মাওলানা মামুনুল হক সুকৌশলে জামায়াত-শিবিরের নেতাদের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের সেতুবন্ধন তৈরির প্রচেষ্টা চালায়। শফীর মৃত্যু পরবর্তী হেফাজতের নতুন কমিটি গঠনের জন্য চলতি মাসের মাঝামাঝি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে পারে। ইতোমধ্যে সংগঠনের বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাদের অনেকের সরাসরি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও যোগাযোগ আছে। প্রায় প্রতিদিনই কাউন্সিলের কমিটি গঠনের জন্য বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শী হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা মীর ইদ্রিস, মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়জী, মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির, মাওলানা জাফর আলম নিয়মিত গোপন বৈঠক করে হেফাজতের কমিটির তালিকা তৈরি করছে। তালিকাটি কাউন্সিলের দিন মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। নতুন কমিটি গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উল্লেখিত আলেমরাই জামায়াত-শিবির মতাদর্শী বলে জনশ্রুতি আছে। অন্যদিকে হেফাজত নামে অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীকে হেফাজতের মহাসচিব করার জন্য বিএনপি-জামায়াত চক্র ইন্ধন যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। কাসেমী বর্তমানে হেফাজতের ঢাকা মহানগর আমির। ফলে সব সময়েই হেফাজতকে বিএনপি-জামায়াত নিজেদের হিসেবে ব্যবহার করেছে। এখন হেফাজতের নেতৃত্ব চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য নূর হোসাইন কাসেমী ও মামুনুল হক চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যাতে হেফাজতের ভবিষ্যত নেতৃত্ব হাটহাজারীর প্রভাবমুক্ত এবং ঢাকাকেন্দ্রিক করা যায়। এটি তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করছেন হেফাজতের ভেতরে থাকা জামায়াতবিরোধী ও আহমদ শফীর মতাদর্শে বিশ^াসী আলেম ও ছাত্ররা। কেবল তাই নয়, হেফাজতের নেতৃত্ব পুরোপুরি দখলে নেয়ার জন্য শফীপন্থী কোন আলেমকে হেফাজতের নতুন কমিটিতে রাখা হবে না বলে শফীপন্থী আলেমদের আশঙ্কা। হেফাজতের নেতৃত্ব ঢাকাকেন্দ্রিক করার মাধ্যমে অরাজনৈতিক কওমি সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নামের সংগঠনটি জামায়াত দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে বলে চট্টগ্রামের সিনিয়র আলেমদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। ভবিষ্যতে হেফাজতের ভাঙ্গনের কারণ হতে পারে বলেও মনে করছেন তারা। তারা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের পরিচিতি সারাবিশ্বেই রয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে দেশের বেশিরভাগ আলেমকে একই অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন আহমদ শফী। এমন একটি সংগঠনকে জামায়াতের মতো স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী সংগঠনের সঙ্গে একাত্ম করার অপকৌশল হিসেবেই জামায়াত পন্থীদের হাতে তুলে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে।
×