ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গোরা বিশ্বাস

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ॥ চিরুনি অভিযান আবশ্যক

প্রকাশিত: ২০:৫০, ১২ নভেম্বর ২০২০

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ॥ চিরুনি অভিযান আবশ্যক

ডেঙ্গু নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে গেল মধ্যযুগের যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার দুটি লাইন। তিনি এক সময় ব্যঙ্গোক্তি করে কলকাতা শহরের বর্ণনা করেছিলেন এভাবে, রাতে মশা দিনে মাছি/এই নিয়ে কলকাতায় আছি। এ থেকে বোঝা যায় প্রায় আড়াইশো বছর আগে কলকাতার অবস্থা কেমন ছিল। সেরকম অবস্থা এখন আর নেই। অত্যন্ত সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে একটি আধুনিক শহর কলকাতা। থাক কলকাতার কথা। আমাদের রাজধানী ঢাকার অবস্থা কেমন সেদিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আর ঢাকা মহানগর পৃথিবীর সবচেয়ে নোংড়া শহরের খাতায় ইতোপূর্বেই নাম লিখিয়েছে। জনসংখ্যা ঘনত্বের দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় শহর। দুই কোটি লোকের বসবাস ছোট্ট এই শহরে। এছাড়াও প্রতিদিন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ ভাসমান লোক রাজধানীতে নানা কাজে আসে, আবার ফিরে যায় দিনশেষে। একদিকে যেমন শহরের পরিধি ও লোকসংখ্যা বাড়ছে, আরেক দিকে লোকসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানাবিধ সমস্যা ও নাগরিক চাহিদা। যেমন অপরিচ্ছন্নতা, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, যানজট, জলাবদ্ধতা, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ ও মশা-মাছির উৎপাত। এ সমস্যাগুলো নগরবাসীর যাপিত জীবনকে দূর্বিষহ যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও সাধারণ মশা নিয়ন্ত্রণ করা। নগরবাসী সকলেই ডেঙ্গুর কথা জানেন। এ রোগের নাম শোনেননি এমন লোক খুব কম। কিন্তু ডেঙ্গুরোগে কিভাবে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তা হয়ত অনেকেরই অজানা। এডিস নামক এক প্রকার মশা ডেঙ্গু রোগের জীবাণু বহন করে, যা মানুষকে কামড়ালে সে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এডিস মশাগুলো সাধারণ মশার মতো আকারে এত ক্ষুদ্র নয়। দেখতে বেশ বড়। এরা বড় কোন পুকুর, ডোবা নালা বা স্রোতের কোন জলাধারে বাস করে না। এদের প্রজনন স্থান হচ্ছে অপরিচ্ছন্ন স্যাঁতসেঁতে ঠা-া জায়গা। বিশেষ করে রাস্তার ওপর পরিত্যক্ত ডাবের খোসা, টিনের কৌটা, পলিথিন ব্যাগ, পুরনো টায়ার টিউব, ফেলে দেওয়া লেপ-কাঁথা ইত্যাদির ওপর জমে থাকা পানিতে তাদের দেখা মিলে। এমনকি বাথরুমে রাখা জমানো পানির পাত্রে কিংবা ছাদের ওপর রাখা টব, নির্মাণাধীন হাউস ও অপরিচ্ছন্ন ড্রেনের মধ্যে এরা ডিম পাড়ে। প্রথমে ডিমগুলো ফুটে লার্ভা তারপর পরিণত মশায় রূপান্তর হয়। এ কারণেই বাসাবাড়িতে জমানো পানি তিন দিনের মধ্যেই ফেলে দিয়ে নতুন পানি রাখতে হবে। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সাধারণত বৃষ্টি ও বর্ষা মৌসুমেই এডিস মশার বংশ বিস্তার বেশি ঘটে। এখন যেহেতু প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে সেজন্যই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, গত অক্টোবর মাসে ১৩৮ জন ডেঙ্গুরোগে আক্রান্ত হয়েছে। আমরা সকলেই জানি এ বছর সারা পৃথিবী জুড়ে করোনার করুণ তা-ব চলছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে করোনা প্রশমিত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর যদি ডেঙ্গুরোগ প্রকট আকার ধারণ করে তাহলে সার্বিক পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। মশক নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর মশক নিবারণী সংস্থা ও সিটি কর্পোরেশনসহ যে কয়টি বিভাগ কাজ করে থাকে তন্মধ্যে সিটি কর্পোরেশন এর ভূমিকাই প্রধান। মশক নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব দুই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যাস্ত। সে কারণেই তাদের জবাবদিহিতাও বেশি। কিন্তু সিটির ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং খালগুলোর দায়িত্ব এখনও ঢাকা ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় রয়েছে। যার ফলে কাজের গতিশীলতা আসছে না বলে ঢাকার দুই মেয়রই মনে করেন। এ ব্যাপারে দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এক ভার্চুয়াল সভায় বলেছেন, যদি ঢাকার খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব কর্পোরেশনকে দেয়া হয় তাহলে আগামী বছরে ঢাকা শহরে তার এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকবে না। তিনি প্রতিষ্ঠানের কাজের জবাবদিহিতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মচারীদের গণবদলীর ব্যবস্থা করেছেন। তার এ ব্যবস্থাকে সমাজ চিন্তক ও নগর পরিকল্পনাবিদগণ ইতিবাচক দিক হিসাবেই দেখছেন। তবে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, কয়েক দশক আগের চেয়ে বর্তমান দুই মেয়র ক্ষমতা গ্রহণের পর সিটি কর্পোরেশনের গতানুগতিক কাজের ধারা অনেকটাই বদলেছে। উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রতিবারের ন্যায় এবারও ডেঙ্গু প্রতিরোধে ২ নবেম্বর থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে চিরুনি অভিযান শুরু করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত উত্তরা, মহাখালী ও মিরপুর অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া বাড়ির মালিকদের জরিমানার আওতায় এনেছে। সকালে লার্বিসাইড, এডাল্টি সাইড ও সন্ধ্যায় ফগার মেশিনের কাজ অব্যাহত রেখেও এডিস মশার প্রজনন বেড়েই চলছে। সম্প্রতি তিনি চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে যেভাবে নগরবাসীর কাছ থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে অনেকাংশে সফল হয়েছেন, তেমনি এ অভিযানেও ডেঙ্গু প্রতিরোধসহ বাকি সমস্যাগুলো দূর করে ঢাকা উত্তরের জনগণের স্বস্তি ফিরিয়ে আনবেন বলেও আমাদের বিশ^াস। এখানে একটুখানি বলে রাখা ভাল যে, গত বছর ডেঙ্গু নির্মূল করতে গিয়ে বেশ কিছু বাগানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ বছর যেন সেদিকটায় একটু সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। কেননা গাছপালা হচ্ছে নগর সৌন্দর্যের প্রতীক আর ছাদ-বাগান হচ্ছে নগরবাসীর পুষ্টি চাহিদা পূরণের একটি বড় উৎস। তিনি শিশু কিশোরদের খেলার মাঠ তৈরি ও পার্কগুলোকে সংস্কার করে নগরবাসীর বিনোদন ব্যবস্থাকে আরও সুযোগ করে দিয়েছেন। উভয় মেয়রই হকার মুক্ত ফুটপাথ, অবৈধ স্থাপনা, রাস্তার ওপর ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক তার, অবৈধ বিলবোর্ড, অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ব্যানার পোস্টার অপসারণের কাজ চলমান রেখেছেন। তা ধরে রাখতে হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডে নাগরিক কমিটি গঠন করে কাজগুলোর মনিটরিং করা হলে আশানুরূপ ফল আসতে পারে। পরিশেষে বাংলার একটি প্রচলিত প্রবাদ বাক্য দিয়ে শেষ করতে চাই। কথায় আছে ‘মশা মারতে কামান দাগা’। অর্থাৎ, ক্ষুদ্র মশাকে মারতে যেন শুধু ঢাক-ঢোল পেটানো নয়, শুধু কথা মালার রাজনীতি নয়, আন্তরিকতা, সততা, নিষ্ঠা ও নির্মোহভাবে কাজ করলে সবই করা সম্ভব। আধুনিক সভ্যতার সোপান যদি নগর হয়, তাহলে সে নগরের উন্নয়ন যেমন আবশ্যক, তেমনি নাগরিক সেবাও অপরিহার্য। অতএব সিটি কর্পোরেশনের কাছে ট্যাক্স হোল্ডার নগরবাসীর সে আশাটুকু করা অমূলক নয়। সর্বোপরি জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততাই হতে পারে ডেঙ্গু প্রতিরোধের একটি অবলম্বন। লেখক : উন্নয়নকর্মী
×