ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

অভিমত ॥ আমেরিকার নির্বাচন এবং কিছু প্রশ্ন

প্রকাশিত: ২১:১৪, ১১ নভেম্বর ২০২০

অভিমত ॥ আমেরিকার নির্বাচন এবং কিছু প্রশ্ন

আমি রাজনীতির মানুষ নই এবং রাজনীতি নিয়ে কথা বলা আমার কাজ নয়। তবে একজন সচেতন মানুষ হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতির নিউক্লিয়াস বলে পরিচিত আমেরিকায় কি ঘটছে বা ঘটতে চলেছে তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। এবারের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণার ধরন দেখে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় এরশাদ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণার কথা মনে পড়ে গেল। সেই নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অধীনে আট দলীয় জোট অংশ নেয়। নির্বাচন শেষে যথারীতি ফল প্রকাশিত হতে থাকলে দেখা যায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোটের প্রার্থীরা অধিকাংশ আসনে এগিয়ে চলেছেন এবং জয়লাভ করতে শুরু করেছেন। আর ঠিক তখনই মাঝরাতে হঠাৎ করেই নির্বাচনের ফল ঘোষণা বন্ধ করে দেয়া হয়। তখনই আমরা বুঝেছিলাম যে, সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনার আর জয় লাভের সুযোগ নেই। সকালে উঠে দেখি পত্রিকার পাতায় বড় হেডলাইন-এরশাদের দল ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছে। প্রায় ত্রিশ বছর পর একটি উন্নয়নশীল দেশের স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল ঘোষণার ধরনই যেন প্রতিফলিত হয়েছে গণতন্ত্রের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত আমেরিকার এবারের নির্বাচনে। নবেম্বরের তিন তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচন শেষে যখন একের পর এক অঙ্গরাজ্যের ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছিল তখন দেখা গেল এক পর্যায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল ২১৪ ভোট পেয়ে এবং জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট দল ২২৪ ভোট পেয়ে কাছাকাছি অবস্থান করছে। ঠিক তখনই সিএনএনসহ অধিকাংশ চ্যানেল এই াফল দেখানো বন্ধ করে দিয়ে, কি হলে কি হতে পারে- সেই আলোচনায় মগ্ন হয়ে যায়। এমনকি কানাডার সিটিভি নিউজ চ্যানেলসহ বিশ্বের অনেক চ্যানেলও তাদের পূর্বঘোষিত আমেরিকার নির্বাচন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলে। সব টেলিভিশন চ্যানেলে তখন সমস্ত দৃষ্টি নিয়ে আসা হয় পাঁচটি অঙ্গরাজ্যের দিকে, যেখানে নির্বাচন পরবর্তী তিনদিন ধরে মেইল-ইন ব্যালট গ্রহণ ও গণনা অব্যাহত রাখা হয়। তখনই আমাদের মতো সাধারণের কাছে সেই গত শতাব্দীর আশির দশকের এরশাদের অধীনে নির্বাচনের ফল ঘোষণার মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, এই নির্বাচনে জো বাইডেন হবেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনের তিনদিন পার হয়ে যাবার পরও ফল প্রকাশে ব্যর্থতা এবং যেভাবে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভোট পরবর্তী তিনদিন ধরে মেইল-ইন ব্যালট সংগ্রহ এবং গণনা করা হয়েছে তা আমেরিকার মতো উন্নত দেশে ঘটতে পারে, এটা বিশ্বাস করাও কষ্টকর। তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশের নির্বাচনে যদি এভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হতো তাহলে নিশ্চয়ই আমেরিকাসহ সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে হৈচৈ ফেলে দিত। এমনকি কোন কোন দেশ হয়ত তাদের সিনেট বা পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাবও নিয়ে আসত। আমেরিকার নির্বাচনের ফল ঘোষণার এমন বেহাল অবস্থায় সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব একেবারে নিশ্চুপ এবং সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে, কারণ আমেরিকা বলে কথা। অবশ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি অতীতে তার অতিকথনের কারণে অতিমাত্রায় আলোচিত সমালোচিত না হতেন, তাহলে হয়ত তার এই অভিযোগের কারণে আমেরিকার নির্বাচন ব্যবস্থার ভিতই কেঁপে উঠত। আমেরিকার নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে একথা কোন বোকাও হয়ত বিশ্বাস করবে না। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে অনেক বাকবিত-াই হতে পারে। তবে বাস্তব সত্য হলো আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো যেমন স্বাধীন, তেমনি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। তাই এখানে নির্বাচনে কারচুপি হবে এটা কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তবে সে সঙ্গে যে কথাটি বিশ্বাস করা কঠিন তা হলো আমেরিকার মতো উন্নত দেশ যারা মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের দ্বারপ্রান্তে, সেখানে নির্বাচনের পর তিনদিন পার হয়ে গেলেও ফল ঘোষণা করতে না পারা। আরও একটি বিষয় বিশ্বাস করা কঠিন তা হলো ভোটের নির্ধারিত সময় পরেও কেন মেইল-ইন ব্যালট গ্রহণ করতে হবে। এবং কেনই বা এ ব্যাপারে আদালত থেকে পূর্বানুমতি নিয়ে রাখতে হবে, যদি সেই রাজ্যের আইনেই তেমনটার উল্লেখ থাকে। যুক্তি হিসেবে করোনা মহামারীর কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কোভিডের কারণে তো আমেরিকার কোন কিছুই ঠেকে নেই। তাহলে শুধু ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়। কোভিডের কারণ দেখিয়ে যদি আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনপত্র নির্ধারিত সময়ের পরে পৌঁছায় বা নির্ধারিত সময় পরে কোন চাকরির আবেদনপত্র জমা দেয়া হয়, তাহলে কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেগুলো গ্রহণ করবেন ? নিশ্চয়ই নয়। বরং এক বাক্যে প্রত্যাখ্যান করে দেবেন। তাহলে সেই একই দেশে ভোটের ক্ষেত্রে কেন এমনটি করা হলো তা অনেকের কাছেই এক বড় প্রশ্ন হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন। ভোটের নির্ধারিত সময়ের পরেও মেইল-ইন ব্যালট সংগ্রহ এবং গণনার ঘটনা ঘটেছে মাত্র পাঁচটি অঙ্গরাজ্যে যেগুলোর দিকে ডেমোক্র্যাটরা আগে থেকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছিল এবং বেশ সতর্ক দৃষ্টি রেখে আসছিল শুরু থেকেই। এর পিছনে নিশ্চয়ই রাজনীতি আছে যা ডোনাল্ড ট্রাম্প বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা তিনি মূলত রাজনীতিবিদ নন, একজন সফল ব্যবসায়ী মাত্র। এবারের আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে গেলেও প্রকৃত অর্থে রিপাবলিকানরা লাভবানই হয়েছে। কেননা এবার নির্বাচনের পূর্বের জনমত জরিপ এবং বিশেষজ্ঞ মহলের মতামত অনুযায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের এলোমেলো বক্তব্য এবং কিছুটা একগুয়েমি আচরণের কারণে রিপাবলিকানদের ভরাডুবি হওয়া, আর জো বাইডেনের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটরা ভূমিধস জয় পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হয়নি। বরং ঘটেছে উল্টোটা। কারণ ডেমোক্র্যাটদেরই জয়লাভ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদি মেইল-ইন ব্যালটের ম্যাজিক না ঘটত তাহলে তো ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ই নিশ্চিত ছিল। আমেরিকার এবারের নির্বাচনে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একা লড়তে হয়েছে। তার পক্ষে তেমন কেউই ছিল না। রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকেও তেমন জোরালো প্রচারণা চালাতে দেখা যায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিকথন এবং তার কিছু আচরণ ও কর্মকা-ের জন্য রিপাবলিকানরা তাদের দলের ইমেজ সঙ্কটের ঝুঁকি নিতে চায়নি বিধায় কিছুটা নিরাপদে থেকেছে। পক্ষান্তরে জো বাইডেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল সকল মহল। দল হিসেবে ডেমোক্র্যাটরা সর্বশক্তি নিয়ে জো বাইডেনের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমনকি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামা প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন। বারাক ওবামা তো শেষমুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন যা সাধারণত উন্নত বিশ্বের রাজনীতিতে দেখা যায় না। এমনকি অধিকাংশ সেলিব্রেটিরাও জো বাইডেনের পক্ষে অবস্থান নেন। বিখ্যাত গায়ক লেডি গাগা তো প্রকাশ্যেই জো বাইডেনকে ভোট প্রদানের আহ্বান জানান। এই অবস্থাও ইতোপূর্বে উন্নত বিশ্বের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ করা যায়নি। এতকিছুর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প একক প্রচেষ্টায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চালিয়ে হেরে গেলেও আমেরিকার অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রিপাবলিকানদের কট্টর সমর্থক বানিয়ে গেলেন, যাদের ওপর ভরসা করেই তারা আগামী নির্বাচনে খুব সহজেই পার পেয়ে যেতে পারে। তাই এই নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে গেলেও রিপাবলিকানরাই প্রকৃত অর্থে লাভবান হয়েছে। এখন দেখার বিষয় ট্রাম্পকে হটিয়ে জো বাইডেন আমেরিকানদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারেন। যতটুকু জানা গেছে আমেরিকার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একজন সজ্জন ব্যক্তি এবং খুবই শান্ত মেজাজের মানুষ। তাছাড়া তিনি বারাক ওবামার সময় দুই টার্ম ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সিনেট সদস্যও ছিলেন। হোয়াইট হাউসের প্রশাসন তার নখদর্পণে। আমেরিকার এমন একজন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আমেরিকান এবং বিশ্ববাসী উপকৃতই হবেন বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যেই হোক তাতে আমাদের মতো সাধারণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন লাভ নেই। তবে জো বাইডেন যদি বিশ্বের অন্য কোথাও যুদ্ধ বাধানোর ক্ষেত্রে সমর্থন না যোগান এবং আউটসোর্সিংয়ের নামে এখানকার চাকরিগুলো স্বল্প শ্রমমূল্যের দেশে প্রেরণ করে বৃহৎ কোম্পানিগুলোর অতি মুনাফার সুযোগ করে না দেন, তাহলেই আমাদের মতো সাধারণ মানুষ খুশি থাকবে। লেখক : ব্যাংকার, টরেনটো, কানাডা [email protected]
×