ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াবা ॥ কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ

প্রকাশিত: ২১:৪৬, ১০ নভেম্বর ২০২০

ইয়াবা ॥ কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ৩৭ কারখানায় উৎপাদিত মাদকের নাম ইয়াবা। দেশে আমদানি নিষিদ্ধ এই পণ্যটি কারও জন্য পৌষ মাস আবার কারও জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। মরণ নেশা এই ইয়াবার কারণে বহু শিক্ষার্থী অকালে ঝরে পড়ছে। ৪০ হাজার ইয়াবাসহ আটক হয়েছে সপ্তম শ্রেণীর এক শিশু ছাত্র। সূত্র জানায়, সীমান্ত এলাকার কোন ইয়াবা কারবারি হয়ত ওই শিশুটিকে টাকার লোভে ফুঁসলিয়ে ইয়াবার চালানটি পৌঁছে দেয়ার বাহক নিয়োজিত করে। কিন্তু অবুঝ এই শিশু জানে না যে, ইয়াবার এই চালান তার জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। তাকে অকালে ঝরে যেতে হবে শিক্ষা জীবন থেকে। আটক শিশু বলেছে, আমাকে ছেড়ে দেন- কয়েকদিন পর স্কুল খুলবে। আমি স্কুলে যাব। আটক ওই স্কুলছাত্রের নাম মোঃ ফয়সাল (১৩)। সে পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম নয়াপাড়ার আবুল কালামের পুত্র ও ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। স্থানীয়দের মতে ইয়াবার চালানটি পৌঁছে দিলে ওই ছাত্রটিকে কয়েক লাখ টাকা উপহার দিত না ইয়াবা ডনরা। হয়ত কয়েক শ’ টাকা বখশিশ দিত। কিন্তু শিশু ফয়সাল জানত না যে, এই কয়েক শ’ টাকা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। টাকার লোভ দেখিয়ে শীর্ষ ইয়াবা কারবারিরা দরিদ্র্যতাকে পুঁজি করে এভাবে কোমলমতি ফয়সালের মতো বহু শিক্ষার্থীকে পথভ্রষ্ট করেছে। গডফাদাররা নিরাপদে থাকলেও কিছু টাকার বিনিময়ে ইয়াবা কারবারির তালিকায় নাম উঠছে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। ইতোপূর্বে কলেজ পড়ুয়া যেসব ছাত্র-ছাত্রী ইয়াবাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। জানা গেছে, সবাই ছিল শীর্ষ ইয়াবা ডনদের বাহক মাত্র। তারা টাকার বিনিময়ে ইয়াবা সরবরাহ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তবে সপ্তম শ্রেণীর ধৃত ছাত্রের এত জ্ঞান হয়নি। তারপরও সে কেন মাদকের চালান বহন করতে গেল? এ বিষয়ে প্রথমে তার পিতা আবুল কালামকে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। ধৃত শিশুর পিতা হয়ত জানতে পারে এসব ইয়াবার মালিক কে? ওই শিশুকে ব্যবহার করার জন্য তার পিতার সঙ্গে ইয়াবা কারবারির নগদ বিনিময় হয়েছে কি না। তদন্তের মাধ্যমে আসল রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করেছেন স্থানীয়রা। সীমান্তের অধিবাসীরা জানান, ওপারে স্থাপিত ৩৭ কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার প্রধান হাট হচ্ছে বাংলাদেশ। ওইসব কারখানার মালিক মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও বর্ডারগার্ড পুলিশের (বিজিপি) কিছু কর্মকর্তার স্বজন। মিয়ানমারের ইয়াবা ডিলাররা ইতোপূর্বে টেকনাফের হাজী সাইফুল করিমের (বন্দুকযুদ্ধে নিহত) মাধ্যমে লাখ লাখ ইয়াবার চালান পাঠিয়েছিল বাংলাদেশে। সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর বর্তমানে আশ্রয় ক্যাম্পে চিহ্নিত রোহিঙ্গা ও সীমান্ত এলাকার কতিপয় চোরাচালানির মাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ইয়াবার চালান পাঠাচ্ছে দেশে। মাদক কারবার রোধকল্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তথা বিজিবি জওয়ানরা সীমান্ত এলাকায় পালাবদল করে টহল এবং পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত দুই বছর আগে সরকার মাদক রোধ ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অভিযানে নামে। এরপর পালিয়ে যায় ইয়াবা ডনরা। দু’দফায় অনেকে আত্মসমর্পণ করেছে। কেউ কেউ জামিনে মুক্ত হয়ে ফের শুরু করেছে মাদক কারবার। ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, ধৃত ফয়সাল ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়ে। ফয়সাল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। স্কুলে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অসামান্য অবদান রখেছে। ইয়াবার কাছে হেরে গেল মেধাবী শিক্ষার্থী ফয়সাল। শিক্ষাজীবন থেকে অকালে ঝরে গেল। রবিবার ৪০ হাজার ইয়াবাসহ উখিয়ার ঘাটিরবিল এলাকায় বিজিবির হাতে ধরা পড়েছে। শিক্ষকরা বলেন, ফয়সালকে কে বা কারা এই মাদকের চালান ধরিয়ে দিয়েছে, তদন্তক্রমে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আলী হায়দার আজাদ আহমেদ জানান, প্রথমে বিজিবির সদস্যরা মোঃ ফয়সালকে সন্দেহ জনক হিসেবে আটক করে। পরে তার কাছ থেকে ৪০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এদিকে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় ক্যাম্পের চিহ্নিত শীর্ষ কারবারি রোহিঙ্গারা ইয়াবার চালান আনছে মিয়ানমার থেকে। মাঝে মাঝে বিজিবির হাতে কিছু কিছু চালান জব্দও হচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং বাজার, বালুখালী বাজার, ক্যাম্প অভ্যন্তরে রাখাইনের আদলে স্থাপিত বলিবাজার, লম্বাশিয়া বাজার, জামতলী বাজারের সব দোকানের মালিক রোহিঙ্গা। ওইসব দোকানে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা লেনদেন করছে রোহিঙ্গারা। দোকানগুলোতে স্বর্ণ ও ইয়াবার চালান পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে এদের রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ। তাদের কাছে রয়েছে বাংলাদেশী ছাড়াও মিয়ানমারের একাধিক সিম ও মোবাইল সেট। বাংলাদেশী সিম থেকে গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেলে মিয়ানমার সিম থেকে কল করে চালান নিয়ে আসা হয় সীমান্ত এলাকায়। সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করানো হয় রোহিঙ্গা শিবিরে।
×