ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

কিশোররা সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১০ নভেম্বর ২০২০

কিশোররা সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার

২০১৯ সালের ২৪ জুন চাঞ্চল্যকর ও বহুল আলোচিত রিফাত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যে মূল আসামি নয়ন বন্ডও হত্যার শিকার হয়। স্ত্রী মিন্নিকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয় ঘটনার ধারাবাহিক বিশ্লেষণে। সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং বিস্ময়কর বিষয় হলো ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন এবং বিচারে তাদের শাস্তির বিধান দেয়া। ১১ জন কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগের নির্দেশ আসে রায়ের মাধ্যমে। বাকি ৩ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয় অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায়। কিশোর অপরাধ চক্র আজ সারাদেশে এক ভয়ঙ্কর গ্যাং হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা জঘন্যতম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে খুন, জখম, ধর্ষণ এবং মাদকাসক্তির ঘৃণ্য জালে আটকে যাচ্ছে। কেন দেশের সম্ভাবনাময় কিশোর শক্তি এভাবে অধঃপতনের শেষ ধাপে তাদের মূল্যবান জীবনকে নামিয়ে এনেছে? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। রিফাত হত্যা মামলার আসামি ১৪ কিশোরের জীবন পর্যালোচনায় উঠে আসে- তারা মেধাবী ছিল এবং সামনের আলোকিত জগতে পা রাখার স্বপ্নও তাদের অভিভূত করত। এদের মধ্যে কেউ কেউ বোর্ড পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার তথ্যও জানা যায়। দু’জন, যারা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা এবার উচ্চ মাধ্যমিকেও বোর্ড সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ-প্লাস পেয়ে যাবে। ১৪ জনের মধ্যে ২ জনই তেমন সম্ভাবনার দ্বারে। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে দেশকে আলোকিত বলয়ের নির্মাতা হিসেবেও নিজেদের অভিষিক্ত করতে পারত। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে নৃশংস পাশবিকতার যে স্খলন, সেখানে শুধু সামাজিক অবক্ষয় আর অপরাজনীতিকে দায় করলে চলবে না। তার চেয়েও বেশি মায়া-মমতায় ঘেরা ছোট্ট পারিবারিক আঙ্গিনাটিও আমলে আনতে হবে। একজন অবোধ শিশু মায়ের জঠর থেকে যখন পৃথিবীর আলোয় নিজেকে সিক্ত করে, তার মধ্যেই প্রচ্ছন্ন থাকে দ্যুতিময় অপার সম্ভাবনা। পারিবারিক স্নেহসিক্ত আবহ, শিশুটিকে ক্রমান্বয়ে মানুষের মত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার মন্ত্রে দীক্ষিত করে। এক সময় তার পারিবারিক বলয় থেকে আর এক ধাপ পার হয়ে শিক্ষা জগতে অনুপ্রবেশ ঘটে। এভাবে সামাজিকীকরণের মধ্যে শিশুটির বৃহত্তর সামাজিক জগত চেনার সুযোগ তৈরি হয়। মানব ইতিহাসের বৃহত্তর সমাজ কখনও সুস্থির আর স্বস্তিতে ছিল বলে জানা যায় না। ঘাত, প্রতিঘাত, বিপন্ন আর প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই মানবসভ্যতাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। সভ্যতার চরম বিকশিত যুগ আর তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত বলয়েও নিরাপদ ও নির্বিঘœ সমাজ মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন সুখ-আনন্দের সঙ্গী হয়নি। অন্যায়, অবিচার, সমাজ ও বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত এক শ্রেণীর মানুষ উদ্ধত, বেপরোয়া জীবন ছাড়াও পেশীশক্তির দুর্বৃত্তায়নে সব সময়ই নেতিবাচক প্রভাবে সামাজিক বন্ধনকে অস্থিতিশীল করে তুলতে ব্যস্ত। আধুনিক সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রাসঙ্গিক উদ্ভাবন মানব সমাজকে উপহার দিলেও মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবধানকে সেভাবে ঘোচাতে পারেনি। সঙ্গত কারণে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে ফারাকের যে প্রাচীর তৈরি হয় সেখানে শুধু বিত্তই নয়, ক্ষমতার অশুভ লড়াইয়েও ক্ষতবিক্ষত হয় সমাজবদ্ধ নিরীহ আম জনতা। যখন কোন শিশু তার বাল্যকাল পার হয়ে উদ্দীপ্ত কিশোরের নতুন সম্ভাবনায় তৈরি হওয়া শুরু করে, সে দুর্লভ সময়টি যেন মায়াচ্ছন্ন অন্য এক পৃথিবী। বয়ঃসন্ধিকালের এমন অভাবনীয় পর্বে সাধারণ কিশোররা কিছুটা বিচলিত ও দিশেহারা আবেশে শরীর ও মনের নতুন আহ্বানকে আমলে নিতে একটু হিমশিমও খায়। ন্যায়-অন্যায় বোধও বিবেচনায় আনা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। সবকিছুই অবিমিশ্র সুন্দও কিংবা কদর্য ভাবতেও দ্বিধান্বিত হয় না। তেমন বয়সে জার্মান কবি গ্যাটে বলেছিলেন- আমার বয়স যখন আঠারো তখন মনে হতো সারা জার্মানি আঠারোর আলোয় ঝলমল করছে। এই আলোকিত মনন ও সৃজন বোধে তিনি মহাকবির আসন অলঙ্কৃত করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও এই আঠারো বছরের অপার সম্ভাবনায় জগতকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন আলোকের ঝর্ণাধারায়। সঙ্গে ছিল তার অসাধারণ প্রতিভা, ঠাকুরবাড়ির পাহাড়সম ঐতিহ্য আর নির্মল পারিবারিক বন্ধন। আর বিপ্লবী কবি সুকান্ত লিখেই ফেললেন এমন বয়সকে ঘিরে এক অসামান্য কবিতা। দুর্বার এই যুগসন্ধিক্ষণে উদীয়মান তরুণ পর্বতসম বাধা ডিঙোতে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতেও দ্বিধাহীন। বাধাভাঙ্গা জোয়ারের মতো এমন উন্মত্ত উন্মাদনায় কিশোর-কিশোরী অজানার আহ্বানে শিহরিত হয়। কঠিন আঘাতকেও বীরদর্পে অতিক্রম করে যাওয়ার এই সময়ে পারিবারিক মমতাঘন ও বিশুদ্ধ আবহ তৈরি করা পিতা-মাতা-অভিভাবকদের এক বিরাট দায়িত্ব। উন্নয়নশীল যে কোন সমাজে অপরাধ জগতের হাতছানি এক অবিচ্ছেদ্য বিষয়। যেখান থেকে সজাগ, সন্তর্পণে নিজেকে বাঁচানোই শুধু নয় আরও বেশি করে ভেতরের ইতিবাচক অপার সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা দেশের সঙ্গে নিজের স্বার্থেও জরুরী। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার হরেক রকম বিচিত্রতায় শরীর ও মনের ওপর যে নবদ্যুতির ডাক, তখনই তৈরি হতে হবে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে। এমন ক্রান্তিকাল আমরা সবাই অতিক্রম করে এসেছি। বর্তমানের বিপদগ্রস্ত অগণিত কিশোর-কিশোরীর পিতা-মাতাকেও বয়ঃসন্ধিকালের এই দুর্বার গতিবেগকে অত্যন্ত সহমর্মিতায় সামলাতে হবে। কিশোর অপরাধ নতুন কিংবা আধুনিক কোন প্রত্যয় নয়। বিধিবদ্ধ আইনী ব্যবস্থাপনাও আছে এমন অপরাধের প্রতিকার হিসেবে। তবে আইনী কাঠগড়া পর্যন্ত যাওয়াকে প্রবলভাবে রুখতে হবে পারিবারিক স্নেহসিক্ত পরিবেশে। শিল্পোন্নত আধুনিক বিশ্ব উদীয়মান নতুন প্রজন্মের জীবন গড়ার প্রাসঙ্গিক উপাদান উপহার দিলেও অনেক দুর্যোগ আর বিপন্নতাকেও উপরি পাওনা হিসেবে দিয়ে দেয়। সামাজিক অস্থিরতা, অবক্ষয়, অপরাজনীতি, পেশীশক্তির দুর্বৃত্তায়নসহ হরেক রকম অভয়ারণ্যের জাল বোনা থাকে চার পাশে। তেমন ফাঁদ পাতা জগতে প্রবেশ যেমন সহজ, সেই গড্ডালিকা স্রোতে গা না ভাসানোও সাধ্য আর শক্তির নিয়ন্ত্রণে। সারা বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ গতিশীলতায় সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার বিপরীত স্রোতও অনেককে দুর্বিষহ অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশে এই উদীয়মান তরুণ-তরুণীদের একটি ভয়ঙ্কর সংগঠন আছে যাকে বলা হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং।’ আর এই কিশোর গ্যাংয়ের প্রবল প্রতাপে স্থানীয়রা উদ্বিগ্ন। এমন কি প্রাণ সংশয়েরও ভয়ে থাকেন। এরা খুন, জখম, গুম, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে নিজেদের দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়। শুধু তাই নয় বীভৎস অত্যাচার-নিপীড়নের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে এতটুকুও ভাবে না। আপত্তিকর ছবি ভাইরাল করে সংশ্লিষ্টদের নাজেহাল করাও তাদের বিবেকে লাগে না। এমন উন্মত্ত সহিংসতা কিভাবে সম্ভাবনাময় নতুন প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করল তা ধারণা করাও কঠিন। সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরাও সন্তানদের এমন জীবন কোনভাবেই আশা করেননি। তাদের আশা-আকাক্সক্ষা, লালিত স্বপ্ন সবই আজ হুমকির মুখে। শুধু আইন দিয়ে এমন জঘন্য অপরাধ দমন করা কঠিনই নয়, সেখান থেকে বের হয়ে আসা ততোধিক অসম্ভব। কারণ আইনী ব্যবস্থাপনায় কিশোরদের যেভাবে সংশোধনাগারে রেখে অবরুদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলা হয় সেটাও কোন নির্মল ও শঙ্কাহীন পরিবেশ নয়। ততোদিনে তার মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সঙ্গত কারণে নিরাময় নয়, প্রতিরোধ কিংবা প্রতিষেধকই এক্ষেত্রে একান্ত আবশ্যক। এর সিংহভাগ দায়িত্বই বর্তায় অতি আবশ্যিকভাবে পারিবারিক আবহে পিতা-মাতার স্নেহ ধারায়। শুধু তাই নয়, উঠতি বয়সের বাচ্চাদের ইতিবাচক সামাজিক সাংস্কৃতিক শুদ্ধ আবহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করলে তারা অপরাধ জগত থেকে সরে তো যাবেই, আধুনিক জ্ঞান আর শিল্পের সঙ্গেও পরিচিত হবে, যা কোন উদীয়মান প্রজন্মের মানসিক বিকাশ শুদ্ধ চর্চায় ভরিয়ে তুলতে নিয়ামকের ভূমিকায় থাকবে। যে কোন মানুষের মনোবিকাশ তার নিয়মিত চর্চা আর পারিপার্শ্বিক আবহ দ্বারা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত। সেখানে শুদ্ধ জ্ঞানচর্চা, সুস্থ সাংস্কৃতিক বোধ আর পরিশীলিত জীবনধারা তাকে মানবিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে। জ্ঞানী, গুণী ও প-িত ব্যক্তিদের সমৃদ্ধ গ্রন্থ এবং আবহমান বাঙালীর শাশ্বত সাংস্কৃতিক বৈভব একজন অবোধ শিশু কিংবা উদীয়মান কিশোরকে যথার্থ জীবনযাপনে আগ্রহান্বিত করে তুলবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোনভাবেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করাও মঙ্গলজনক হয় না। আধুনিক সময়, নব উদ্ভাবন, নতুন জগতের সম্ভাবনার আলয়কেও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। অগ্রসরমান বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়াও কোন শুভ সঙ্কেত নয়। তবে ভাবতে হবে কোন বিষয়কে সার্বিকভাবে গ্রহণই শুধু নয়, বর্জন করার উপাদানকেও শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরী। অপরাধ বলয় আর পেশীশক্তির হাতছানি সব সমাজেই দৃষ্টিকটুভাবে বিদ্যমান। সেখান থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সমাজের গণ্যমান্য বিশিষ্টজনদের জীবনগাঁথা অনুসরণ করাও নৈতিক দায়িত্ব। দেশপ্রেমের মতো অপার মাহাত্ম্যকে সর্বান্তকরণে আমলে নিতে হবে। দেশকে ভাল রাখতে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা সবার আগে জরুরী। আর পিতা-মাতার প্রতি সচেতন দায়বদ্ধতায় তাদের স্বপ্নের দুয়ারে পাড়ি দেয়াও দেশের সময়ের প্রজন্মের কাক্সিক্ষত যাত্রা হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাবা-মাকেও স্নেহশীল পরিবেশে সন্তানদের সাহচর্য দেয়া এক প্রকার দায়িত্ব। শাসনের সঙ্গে সোহাগের অবিমিশ্র সংযোগ সন্তানের জন্য এক অভাবনীয় সম্পদ। ভাল-মন্দের ফারাক, ন্যায়-অন্যায় বোধ, সহনশীলতা-এ সবই সন্তান আয়ত্ব করে পারিবারিক বিশুদ্ধ আঙিনায়। পরবর্তী ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের ভাবী কারিগরদের তৈরি করতে অনবদ্য অবদান রাখে। বিদ্যাশিক্ষার পবিত্র স্থানটিও হতে হবে পরিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার এক তীর্থকেন্দ্র। বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে হরেক রকম অভিশাপ থাকলেও আশীর্বাদ বর্ষিত হওয়ার বিষয়ও কম থাকে না। যার জন্য প্রয়োজন উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। দেশকে ভালবেসে বিশ্ব সভায়ও নিজের স্থান করে নিতে হবে উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায়। তেমন মনন ও সাধনযজ্ঞে নিজেকে সমর্পণ করতে পারলে অন্য কোন দুঃসহ যাত্রাপথ আপনা থেকেই সরে যাবে। সঙ্গত কারণে সবার আগে নিজের মধ্যেই শুভশক্তির আরাধনা করা প্রত্যেকের সজাগ, সচেতন দায়িত্ব। আর চারপাশের নিকটজনেরা তো আছেনই বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিতে। লেখক : সাংবাদিক
×