সংসদ রিপোর্টার ॥ শুরু হলো দেশের ইতিহাসে সংসদের প্রথম বিশেষ অধিবেশন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বে জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে; তিনিই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জিতে হয়েছিলেন দেশের প্রথম সংসদ নেতা। সেই পথ ধরে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রবিবার থেকে শুরু হয়েছে একাদশ সংসদের বিশেষ অধিবেশন। বাংলাদেশের এই অবিসংবাদিত নেতাকে স্মরণ করতেই বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংসদের এটিই প্রথম কোন ‘বিশেষ অধিবেশন।’ আর বিশেষ অধিবেশনই সংসদের ইতিহাসে প্রথম কোন অধিবেশন, যেখানে সংসদ কক্ষে টানানো হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।
যে সংসদ নেতার আসনে বসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই আসনেই সংসদ নেতা হিসেবে টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘বিশেষ অধিবেশনে’ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনের যখন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তখন সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুরই মেয়ে শেখ হাসিনা। বাবার হাত ধরে যার রাজনীতিতে আসা, তিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিদিন ধরে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সংসদের শুরুতেই সভাপতির বক্তব্যে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মুজিববর্ষের বিশেষ অধিবেশনে সকলকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সুপ্রীমকোর্টের রায় ও সংবিধান অনুযায়ী সংসদ কক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। সংসদ কক্ষে জাতির পিতার ছবি স্থাপন দেশের ইতিহাসে অবশ্যই একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। তিনি জানান, আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ( ১২ নবেম্বর) এই পাঁচদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশন চলবে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ আজ সোমবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভাষণ দেবেন। এছাড়া বিশেষ অধিবেশনে সংসদ নেতা শেখ হাসিনাসহ সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তুলে ধরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
আজ সোমবার রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের স্মারক বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হবে বিশেষ অধিবেশনের কার্যক্রম। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার আগে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণ সংসদ কক্ষে দেখানো হবে। বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য ও কর্মময় রাজনৈতিক জীবন নিয়ে রাষ্ট্রপতির স্মারক বক্তৃতার পর তা নিয়ে আলোচনার জন্য একটি সাধারণ প্রস্তাব আনা হবে। এই প্রস্তাবের ওপর সংসদ নেতা শেখ হাসিনাসহ সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের আলোচনা শেষে তা পাস হবে।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার সন্ধ্যা ৬টায় সংসদের এই বিশেষ অধিবেশন শুরু হয়। প্রথমেই স্পীকার সভাপতিম-লীর সদস্যদের মনোনয়ন দেন। তাঁরা হলেন- আবুল কালাম আজাদ, ড. বীরেন শিকদার, শামসুল হক টুকু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও উম্মে কুলসুম স্মৃতি। স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারের অনুপস্থিতিতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে তাঁরা সভাপতির আসনে বসে সংসদ পরিচালনা করবেন।
শোক প্রস্তাব গৃহীত ॥ এর পর স্পীকার সংসদে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সাবেক গণপরিষদ সদস্য সৈয়দ একেএম এমদাদুল বারী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম, নুরুল ইসলাম, খন্দকার গোলাম মোস্তফা, শামছুল হক তালুকদার, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল-হক, কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার, সাংবাদিক আবুল হাসনাত, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীসহ বিশিষ্ট কয়েকজনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মৃত্যুতেও শোক প্রকাশ করে সংসদ। একই সঙ্গে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় হতাহতের জন্য শোক প্রকাশ করা হয়। উত্থাপিত শোক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার পরে তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি কামনা করে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন শেষে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন সরকারী দলের বজলুল হক হারুন।
এরপর প্রশ্নোত্তর ও জরুরী জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণীয় নোটিস নিষ্পত্তি করা হয়। অধিবেশনে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২০’ সংসদে উত্থাপন করেন। এর আগে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে গত ২২ অক্টোবর অধ্যাদেশটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়। পরে ‘তথ্য কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৯’ সংসদে উত্থাপন করবেন তথ্যমন্ত্রীর পক্ষে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান। সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট উত্থাপন করবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম মেহের আফরোজ ও জাতীয় সংসদের সরকারী হিসাব কমিটির সভাপতি ডা. মোঃ রুস্তম আলী ফরাজী।
সংসদে উত্থাপিত বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সে সম্পর্কিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ, বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোঃ শহীদুজ্জামান সরকারের পক্ষে কমিটির সদস্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোঃ আফছারুল আমীন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু।
অধিবেশনের প্রথম দিনে আইন প্রণয়ন কার্যাবলীতে তিনটি নতুন বিল উত্থাপন করা হয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০’, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন)বিল-২০২০’ এবং শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বিল-২০২০’ উত্থাপন করেন। উত্থাপনের পর বিলগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
বর্ণিল সাজে জাতীয় সংসদ, উৎসবের আমেজ ॥ করোনা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশেষ অধিবেশনকে ঘিরে নেয়া হয়েছে নানা আয়োজন। নতুন সাজে সাজানো হয়েছে পুরো সংসদ ভবন এলাকা। জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ এই অধিবেশনকে ঘিরে পুরো সংসদ অধিবেশনে দেখা যায় উৎসবের আমেজ। সংসদ ভবন চত্বরে প্যান্ডেল করে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে আলোকচিত্র ও প্রামাণ্য দলিলে পাকিস্তানের গণপরিষদ, স্বাধীন দেশে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও সংসদে বঙ্গবন্ধুর কাজগুলো তুলে ধরা হয়। একটি রাষ্ট্রের জš§, সংবিধান প্রণয়ন ও সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধু যা কিছু করেছেন তা তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
এছাড়া বিশেষ অধিবেশনকে সামনে রেখে সংসদ ভবনের ভেতরে-বাইরে নানা ধরনের বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে। সংসদ ভবনের অধিবেশন কক্ষে স্পীকার যেখানে বসেন, তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো হয়েছে। সংসদ ভবনের লেকে ভাসানো হয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য দৃষ্টিনন্দন দুটি নৌকা। দেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নের প্রতীক এই নৌকা তৈরি করেছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। সংসদ লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০ বাণী নিয়ে আলো-ছায়ার দৃষ্টিনন্দন কোলাজ করা হয়েছে। অধিবেশনের শেষ অংশে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদ ফ্রান্সে মহানবীকে অসম্মান করায় সংসদে নিন্দা প্রস্তাব আনার দাবি জানিয়ে বলেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে অবশ্যই সংসদে একটি নিন্দা প্রস্তাব আনা উচিত।