ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিজিবির হেলিকপ্টার উইং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অর্পিত দায়িত্ব পালন করুন

প্রকাশিত: ২২:২১, ৯ নভেম্বর ২০২০

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অর্পিত দায়িত্ব পালন করুন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবিকে ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করে এর সদস্যদের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতির পিতার নির্দেশনা মেনে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এখন থেকে বিজিবি সদস্যরা জলে, স্থলে ও আকাশপথে বিচরণ করবেন। হেলিকপ্টার সংযোজন কেবল শুরু মাত্র, এই যাত্রা বিজিবির সার্বিক কর্মকান্ড আরও গতিশীল করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বিজিবির সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা সব সময় দেশপ্রেম, সততা ও ইমানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এই বাহিনীর সুনাম ও মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন। একদিন এ বাহিনী বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মর্যাদা লাভ করবে- এ আমার আশা।’ রবিবার বিজিবি এয়ার উইং-এর জন্য ক্রয় করা রাশিয়ার তৈরি দুটি অত্যাধুনিক এমআই-১৭১ই হেলিকপ্টার ‘বীর শ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ’ এবং ‘বীর শ্রেষ্ঠ আবদুর রউফ’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরের বীর উত্তম আনোয়ার হোসেন প্যারেড গ্রাউন্ডে এ উপলক্ষে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। হেলিকপ্টার সংযোজনের মধ্য দিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এয়ার উইংয়ের যাত্রা শুরু হলো। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজিবিতে হেলিকপ্টার সংযোজনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজিবি এয়ার উইংয়ের এই যাত্রা বিজিবির সার্বিক কর্মকা-কে আরও গতিশীল করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। দুইটি হেলিকপ্টার উদ্বোধনের মাধ্যমে আমি বিজিবিকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করছি। আজ থেকে বিজিবি ত্রিমাত্রিক বাহিনী। সরকার প্রধান বলেন, বিজিবি এখন অন্যান্য বাহিনীর মতো ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে উন্নীত হয়েছে। আমরা আধুনিক হেলিকপ্টার ক্রয় করেছি, প্রকৃতপক্ষে হেলিকপ্টারের কথা আমি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বলেছিলাম। কারণ, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দুর্গম পার্বত্য এলাকার নিরাপত্তা দেয়া একান্তভাবে দরকার। সে কারণেই এই হেলিকপ্টার ক্রয় করে দিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা আমরা মুজিববর্ষ উদযাপন করছি, এই মুজিববর্ষেই বিজিবি হেলিকপ্টার পেল, এটা অত্যন্ত গৌরবের এবং আনন্দের বলে আমি মনে করি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিডিআর বিদ্রোহের প্রতি ইঙ্গিত করে এ ধরনের ঘটনাকে অনাকাক্সিক্ষত আখ্যায়িত করে এই ধরনের ঘটনা যেন আর ঘটতে না পারে সেজন্য সকলকে সতর্ক করে বলেন, এই ধরনের ঘটনা আর ঘটুক তা আমি চাই না। কারণ, এ ঘটনায় যারা জড়িত তারা নিজেদের, বাহিনীর এবং দেশের ক্ষতি সাধন করেছে। তিনি এ সময় বিডিআর বিদ্রোহে নিহতদের রুহের মাগফিরাতও কামনা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বিজিবি কর্তৃক নির্মিত ‘ত্রিমাত্রিক সক্ষমতা অর্জনে বিজিবি’ শীর্ষক একটি প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। বিজিবির একটি সুসজ্জিত চৌকস দল প্রধানমন্ত্রীকে অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একটি উদ্বৃতি তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতা ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-এর তৃতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে বলেছিলেন- ‘ইমানের সঙ্গে কাজ করো, সৎ থেকো, দেশকে ভালোবেসো।’ তিনি বলেন, এটা শুধু বিজিবি নয়, বাংলাদেশের সকলের জন্য প্রযোজ্য। প্রধানমন্ত্রী বিজিবির উন্নয়নে তার সরকারের পক্ষে যা যা করণীয় তা করারও আশ্বাস দেন। বিজিবিতে আরও জনবল বাড়াতে সরকারের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বাহিনীতে আরও ১৫ হাজার জনবল বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা তিনটি ধাপ বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে ৪ হাজার ৩৮২ জন জনবলের সমন্বয়ে একটি রিজিয়ন সদর দফতর, একটি সেক্টর সদর দফতর এবং ৪টি ব্যাটালিয়ন, একটি কো-নাইন ইউনিট, একটি রিজিয়ন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, একটি স্টেশন সদর দফতর, একটি গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সৃজনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা ২০২২ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। দ্বিতীয় ধাপে মোট ৫ হাজার ৭৮২ জন জনবলের সমন্বয়ে একটি সেক্টর, পাঁচটি ব্যাটালিয়ন, একটি রিজার্ভ ব্যাটালিয়ন, একটি কে-নাইন ইউনিট এ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং পাঁচটি বর্ডার গার্ড হাসপাতালের জনবল বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব বিবেচনাধীন রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, সীমান্তের সার্বিক সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিজিবি’র সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত অতি পুরাতন ট্যাঙ্কবিধ্বংসী অস্ত্রের পরিবর্তে আধুনিক, যুগোপযোগী ও কার্যকরী ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মিসাইল ক্রয় করা হচ্ছে। ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ৫৩৯ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় নতুন ৬২টি বিওপি নির্মাণের মাধ্যমে ৪০১ দশমিক ৫ কিলোমিটার সীমান্ত ইতোমধ্যে নজরদারিতে আনা হয়েছে। অবশিষ্ট ১৩৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় আরও বিওপি স্থাপন করা হবে। সরকার প্রধান বলেন, গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে একনেকের সভায় আরও ৭৩টি নতুন কম্পোজিট বিওপি নির্মাণের বিষয়ে অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। এতে বিজিবি’র অপারেশনাল সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধিসহ সৈনিকদের মনোবলের ওপরে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। বিজিবি’কে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে আমরা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন-২০১০ পাস করেছি। একটি বিশ্বমানের আধুনিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১’ পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আজ অত্যন্ত দক্ষ, সুসংগঠিত এবং গতিশীল একটি বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, গত প্রায় ১২ বছরে বিজিবি’র নতুন সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী ৫টি রিজিয়ন সদর দফতর স্থাপন করে কমান্ডস্তর বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এ বাহিনীকে আরও গতিশীল ও ফলপ্রসূ করা হয়েছে। বিজিবির গোয়েন্দা সংস্থাকে শক্তিশালী করে বর্ডার সিকিউরিটি ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। নতুন ৪টি সেক্টর ও ৫টি রিজিয়নাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ও ১৫টি ব্যাটালিয়ন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও নতুন ১৪০টি বিওপি, ৩৪টি বিএসপি এবং একটি এয়ার উইং সৃজন করার মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তার সরকার ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বিজিবি’র জনবলও বৃদ্ধি করে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার ১৪৬ জন জনবল নিয়োগ করেছে। ২০১৫ সালে বিজিবি’তে প্রথম নারী সৈনিক নিয়োগের মাধ্যমে এ বাহিনীতে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। বর্তমানে এ বাহিনীতে নারী সদস্যের সংখ্যা ৮৪১ জন। বিজিবি’র কর্মকা-ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকা নির্বাচন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৩২৮ কিলোমিটার সীমান্তে স্মার্ট ডিজিটাল সার্ভেইল্যান্স এ্যান্ড ট্যাকটিক্যাল রেসপন্স সিস্টেম স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও, ডিজিটাল মোবাইল রেডিও (ডিএমআর) নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিজিবি সদর দফতর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বিওপি এবং বিওপি পরিচালিত টহলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে বিজিবি’র অপারেশনাল সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং কেন্দ্র থেকেই যেকোন সময় যেকোন সিদ্ধান্ত দেয়া এবং বাস্তবায়ন করা যাবে। বিজিবি’র দৈনন্দিন দাফতরিক ও প্রশাসনিক কাজকে সহজ করার লক্ষ্যে ‘সীমান্ত ডাটা সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ভূমিকম্পের বিষয়টি বিবেচনায় এনে বিজিবি কর্তৃক যশোর অঞ্চলে ‘ডিজাস্টার রিকভারি’ (ডিআর) সাইট নির্মাণ করা হচ্ছে যা বিজিবিসহ দেশের বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্যরাও ব্যবহার করতে পারবে। তিনি বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধে টহল কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিজিবি’র জন্য ১২০টি অল ট্যারেইন ভেহিক্যাল (এটিভি) ক্রয় করা হয়েছে। এছাড়া সীমান্তের সার্বিক সুরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় বিজিবি’র সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১২টি আর্মাড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং ১০টি রায়ট কন্ট্রোল ভেহিক্যাল ক্রয় করা হয়েছে। বিজিবি’র বহরে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ১২টি হাইস্পিড বোট এবং ২টি পল্টুন সংযুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিজিবি’র জন্য অত্যাধুনিক দু’টি ফাস্ট ক্রাফট, সমুদ্রগামী ৭টি অত্যাধুনিক হাইস্পিড বোট, দু’টি মেরিনা এবং দুইটি ট্রেইলার ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সুন্দরবন সংলগ্ন জলসীমায় কার্যকরী টহল পরিচালনার পাশাপাশি মিয়ানমার সীমান্তে এসব উন্নত নৌযান মোতায়েন করে নাফনদ ও সাগর উপকূলে ইয়াবা পাচার ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি অধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
×