ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর দর্শন সমবায়ে উন্নয়ন

প্রকাশিত: ১৯:৫৫, ৭ নভেম্বর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর দর্শন সমবায়ে উন্নয়ন

প্রতিবছর নবেম্বর মাসের প্রথম শনিবার দেশে বর্ণাঢ্যভাবে পালিত হয় জাতীয় সমবায় দিবস। সে হিসেবে ৭ নবেম্বর ২০২০ হলো ৪৯তম জাতীয় সমবায় দিবস। দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য : ‘বঙ্গবন্ধুর দর্শন, সমবায়ভিত্তিক উন্নয়ন।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনমানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। এ প্রেক্ষিতে তাঁর ভাবনা ও সমবায়ের কর্মকাণ্ড ছিল একই সূত্রে গাঁথা। গণমানুষের চাহিদা পূরণে সমবায় পদ্ধতিকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছিলেন। সর্বদাই বাঙালী জাতির উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সোচ্চার। তাঁর আদর্শিক চিন্তা-ভাবনা সমবায় পদ্ধতিকে সার্থক করে তুলতেও সহায়ক ছিল। জাতীয় অর্থনীতির দ্বিতীয় খাত হিসেবে সমবায় মালিকানাকে স্বীকৃতি দান বঙ্গবন্ধুর অনন্য অবদান। আমরা সকলেই অবগত যে, স্বাধীনতা উত্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ সংবিধানের ১৩নং অনুচ্ছেদে তিন ধরনের মালিকানা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে : ক. রাষ্ট্রীয় মালিকানা অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারী খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা; খ. সমবায় মালিকানা অর্থাৎ আইন দ্বারা নির্ধারিতসীমার মধ্যে সমবায়সমূহের মালিকানা এবং গ. ব্যক্তিগত মালিকানা অর্থাৎ আইন দ্বারা নির্ধারিতসীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সমবায় সম্মেলনে সমবায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে সমবায় নিয়ে ভাবনা ও দিকনির্দেশনাকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছিলেন। আমরা দেখি নানা বিচ্যুতি ও ভুল-ত্রুটি থাকলেও বিগত ৪৮ বছরে এদেশে সমবায় বিকশিত হয়েছে, সমবায়ের রয়েছে অগণিত সাফল্যের গল্প। জুন ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে মোট নিবন্ধিত সমবায় সমিতির সংখ্যা ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭৫টি। এর মধ্যে প্রাথমিক সমবায় সমিতি ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭১টি। কেন্দ্রীয় সমিতি ১ হাজার ১৮২টি এবং জাতীয় সমিতি ২২টি। এ সকল সমবায় সমিতির সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৫০৫ জন। সদস্যদের পরিশোধিত শেয়ার মূলধন ১ হাজার ৭৫৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সঞ্চয় আমানতের পরিমাণ ৭ হাজার ১৮২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। সমিতিগুলোর কার্যকরী মূলধন প্রায় ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সমবায়ের ভিত্তি হলো পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, ভালবাসা, একতা, পরস্পরের সহযোগিতা চবড়ঢ়ষব ঐবষঢ় চবড়ঢ়ষব. সমবায়ের মাধ্যমে সদস্যদের স্বল্প পুঁজি একত্র হয়ে বৃহৎ পুঁজিতে রূপান্তর করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক বা অন্য কোন অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের সেবা থেকে যারা বঞ্চিত তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সমবায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ অমর্যাদাকর ও হতাশা থেকে উদ্ধার হয়ে আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়। সরকার ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০২১’ ও ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে সমবায় প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে আর্থিক ও সেবাখাতে জননির্ভর নতুন কার্যক্রম গ্রহণ বিদ্যমান কার্যক্রমের গতিশীলতা বাড়াতে এবং বিভিন্ন প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সমবায় অধিদফতর ও সমবায়ীরা আন্তরিকভাবে কাজে নেমে পড়লে বেশকিছু মৌলিক লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও সেবা সহজীকরণ করে বেকার-হতাশ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অগ্রসর ও পশ্চাদপদ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করে জাতির জনকের সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে সমবায় গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতির জনককে হত্যার পরবর্তীতে যে সকল ব্যক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই পুঁজিবাদী ধারার অর্থনীতির প্রবক্তা ও অনুসারী। পুঁজিবাদীরা যৌথ অর্থনীতি চায় না। তারা ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের মধ্য দিয়ে চলা অর্থনীতির এক সময় নাম দিয়েছিলেন চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতি। এ অর্থনীতির মূলসুর ছিল- ধনী পুঁজিপতিদের ভোগের পর যে অবশিষ্ট অংশ চুঁইয়ে নিচে নেমে আসবে বা পড়বে তা চুষে গরিব, মধ্যবিত্তরা সুখে থাকবে। এ ধারায় যখন ধনীদের সমূলে উৎখাতের বিষয়টি জনগণের সামনে চলে এলো তখন তাদের দলভুক্ত পুঁজিবাদী ধারার অর্থনীতিবিদরা পুঁজিবাদীদের বোঝাতে সক্ষম হলো এভাবে চললে বেশি দিন টিকে থাকা যাবে না। এখন কি করতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পুঁজিবাদী চিন্তার অর্থনীতিবিদরা উঠেপড়ে লেগে গেলেন। দীর্ঘ চিন্তার পর তারা বললেন, ‘ইউরেকা’ পেয়ে গেছি। এ পেয়ে যাওয়া পুঁজিবাদী ধারার অর্থনীতির নামকরণ করা হলো ‘বাজার অর্থনীতি’। ১৯৯০ সাল থেকে বাজার অর্থনীতি বিশ্ব পুঁজিবাদীদের নানা ছলাকলা দিয়ে যাত্রা শুরু করে মাত্র ১৮ বছরের মাথায় ২০০৮ সালেই বিশ্বমন্দা জন্ম দিল। পুঁজিবাদে বিশ্বাসী আমাদের দেশের সরকার প্রধানরা দেশ চালাতে গিয়ে বৈশ্বিক মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষ অবলম্বন করে পুঁজিবাদী ধারায় নানাবিধ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। আমাদের দেশে বিশ্বমন্দা অর্থনীতির ছোবলে ছোট-বড় পাঁচ হাজারের অধিক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসবের মাঝে বিশ্বখ্যাত সমবায় ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রীয় অবহেলায় আমাদের দেশে পথ-হারিয়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। অন্যদিকে এনজিওরা রাষ্ট্রের ও বিদেশী দাতা ও পুঁজিবাদে বিশ্বাসীদের আর্থ-সামাজিক আনুকূল্যে ফুলে ফেঁপে পুষ্ট হয়ে দেশের উন্নয়ন সেক্টরের সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করছে। নানা ক্ষেত্রে সরকারের কাজের সমালোচনা করছে । ২০০৮ সালের সৃষ্ট বিশ্বমন্দার আঘাত থেকে উদ্ধারের পূর্বাহ্নে শুরু হওয়া কোভিড-১৯-এর আঘাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তারা স্বদেশের অর্থনীতির বিপর্যয়ের ধাক্কায় দিশাহীন হয়ে পড়ছে। বিশ্বে মোড়ল দেশসহ সর্বত্র করোনা নিয়ে যে হারে আলোচনা হচ্ছে সে তুলনায় অর্থনীতির বিপর্যয়ের হাত থেকে কর্ম ও বাস্তুচ্যুত মানুষ নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম খুব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ভাবধারায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছে সেহেতু এ সরকারের কাছে সমবায়ীদের প্রত্যাশা পূর্বের যে কোন সরকারের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতা জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সোচ্চার এ কথা মানুষ বিশ্বাস করেন। তিনি বলেছেন, ‘সমবায় সমিতিকে উৎপাদনমুখীকরণ, পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন।’ দেশে প্রায় ২৬ হাজার সঞ্চয়-ঋণদান সমবায় সমিতি কার্যকর রয়েছে। এসব সমিতি ৯ লাখের অধিক কর্মী কর্মরত। সমিতিগুলোর সদস্য নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ। করোনার আঘাতে দেশে কর্মচ্যুতি প্রতিদিনই বাড়ছে। সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার কমে যাচ্ছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙ্গে চলছে। এ অবস্থায় লাখো কোটি পরিবার ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। সমবায় প্রতিষ্ঠান করোনার আঘাতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থা উত্তরণে কার্যকর সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা তহবিল থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে ঋণ দেয়ার ধারা চালু করা গেলে এবং বিশে^র বিভিন্ন দেশের মতো করোনার প্রতিকারে জনসচেতনতামূলক কাজে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করা হলে প্রতিকূল অর্থনীতি ও করোনা প্রতিকারে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। জাতীয় সমবায় দিবস ২০২০-এ সমবায়ীদের প্রত্যাশা, জাতির জনকের সমবায় নিয়ে স্বপ্ন এবং সমবায় বিষয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা দেশে সঠিক ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন সমবায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দেশে বিদ্যমান সমবায় আইন ও বিধিমালা সমবায়বান্ধব করা। সমবায়কে ব্যাংক-বীমা ও এনজিওদের প্রতিযোগিতায় না ফেলে বরং এসব প্রতিষ্ঠানের মতো আইনানুগ সুযোগ সৃষ্টি করে প্রতিটি হাট-বাজার, গ্রাম, পাড়া-মহল্লা ও প্রতিটি পেশায় সমবায় সমিতি গঠনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। একই সঙ্গে সমবায় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনগত কাঠামো জোরদার করা। এ কাজগুলো করার মধ্য দিয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করতে পারবে। এতে করে জননির্ভর স্বাধীন অর্থনৈতিক ভিত্তিভূমির উদাহরণ বাংলাদেশে রচিত হবে। বিশ্বে বিদ্যমান পুঁজিবাদী ধারার অর্থনীতির বিকল্প সমবায় অর্থনীতির ধারা হবে সুদূরপ্রসারী। লেখক : জাতীয় সমবায় পুরস্কারপ্রাপ্ত ও কাল্ব বোর্ডের প্রাক্তন সেক্রেটারি
×