ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাকিয়া রহমান

শ্রমিক জীবনের গাঁথা

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ৬ নভেম্বর ২০২০

শ্রমিক জীবনের গাঁথা

সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে একজন কথাসাহিত্যিক তাঁর চারপাশে দৃশ্যমান সমূহ সমস্যা ও সঙ্কটকে লেখনীর মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। কেননা মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যা সম্পর্কে অন্ধত্ব ঘুচিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করাই লেখকের দায়বদ্ধতা। কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালও এর ব্যতিক্রম নয়। মরুঝড় উপন্যাসে লেখকের কথা এবং পরিমার্জিত চতুর্থ প্রকাশের নিবেদন অংশে লেখক তাঁর অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি এবং দায়বদ্ধতার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর মরুঝড় উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। তপ্ত মরুর বুকে প্রবাসী বাঙালী শ্রমিকদের প্রতি মুহূর্তের সঙ্কটময় জীবন সংগ্রাম ও শৃঙ্খলিত পরাধীন জীবনকে তিনি দেখেছেন। শ্রমিকদের মুখ থেকে শুনেছেন তাদের অভাব অভিযোগ তথা পরাধীন প্রবাসী জীবনখোড়া নিত্য সমস্যার কথা। সমাজ সচেতন এ কথাশিল্পী সে বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রাণ সঞ্চার করে মরুঝড় উপন্যাসের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। লেখক ২০১২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সেই সুবাদে দুবাইয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, শেখদের ধনাঢ্য জীবন, বিশাল বিস্তৃত মরুপ্রান্তর, মরুঝড়সহ প্রবাসী বাঙালী শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। শেখ আমিরদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি তিনি স্বদেশী শ্রমিকদের একান্ত আপন হয়ে যান। মননে ধারণ করা লেখক-সত্তার তাড়না বা অন্তর্নিহিত সুপ্ত মানবিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোহিত কামাল শ্রমিকদের দলে মিশে গেছেন। স্বদেশী ভাইদের কষ্ট অনুধাবনে হেঁটেছেন মরুভূমির তপ্ত বালুচরে। সংসার জীবনে নিত্য পোড় খাওয়া মানুষগুলো যেন ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে মরুভূমির বুকে পুড়তেই যায়। পাশাপাশি দেশের মাটিতে তাদের স্বজনদের অন্তরাত্মা পুড়ে ছাই হয়। সঙ্গীর সঙ্গে দীর্ঘ বিচ্ছেদ ও ভুল বোঝাবুঝির ছিদ্রপথে প্রবেশ করে ভাঙন। ছিন্ন হয় সম্পর্ক। শরীর পুড়ে মরুর উত্তপ্ত রোদে আর মন পুড়ে ভুল বোঝাবুঝি আর বিচ্ছিন্নতার কষ্টের আগুনে। মোহিত কামাল দুবাইয়ের ধনাঢ্য আমির শেখদের পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র মরুঝড় উপন্যাসে রূপায়িত করতে পারতেন। বুঝিবা লেখকের সে অভিপ্রায় নেই। বিজাতীয় সংস্কৃতির উচ্চবিত্ত আমিরদের জীবনভাষ্য নয়, তিনি সচেতন প্রয়াসে স্বজাতি প্রবাসী ভাইদের দুঃখ-দুর্দশাকে উপন্যাসের কলেবরে স্থান দিতে চেয়েছেন। সঙ্গত কারণেই আমির শেখদের বাঁধনহারা উচ্ছৃঙ্খল বর্ণাঢ্য জীবন এ উপন্যাসে অনুপস্থিত। যদিও বাঙালী শ্রমিকদের জীবনগাথা রচনায় একটি শেখ পরিবার অর্থাৎ দুবাই কলিদের পারিবারিক দম্ভ, ঐতিহ্য ও বিলাসী জীবনচিত্র মরুঝড় উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। লেখক একাধারে কথাসাহিত্যিক ও মনোবিদ হওয়ায় মানব মনের গতিবিধি নির্ণয়ে দক্ষ। সঙ্গত কারণেই লেখকের চরিত্র সৃজনের বিচক্ষণতায় উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র হয়ে উঠেছে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। চরিত্রগুলোর সক্রিয়তায় কাহিনী পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মরুঝড় উপন্যাসের প্রারম্ভেই পাঠক মরুঝড়ের দর্শন লাভ করে এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। কাহিনীর মোড়ক উন্মোচনের শুরুতে মরুঝড় ওঠায় পাঠক মন তাৎক্ষণিক ভীতসন্ত্রস্ত হয়। ততোধিক ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কায় শঙ্কিত পাঠক পরবর্তীকালে আর কোন প্রাকৃতিক বালুর ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয় না। তবে পাঠক মন মরুর বুকে প্রাকৃতিক ঝড়ের ঘূর্ণায়মান বালুর কু-লির চেয়ে শতগুণ বড় ঝড়ের কু-লির বাঁকে ঘুরপাক খেতে থাকে। কেননা মনোরাজ্যের ঝড় মরুঝড়ের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। চিরসত্য এ বিষয়টি লেখকের শিল্প নির্মাণের দক্ষতায় কাহিনীর গাঁথুনিতে সুস্পষ্টভাবে স্থান করে নিয়েছে। মরুঝড় উপন্যাসটি ২০১২ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সাহিত্য শাখায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। উপন্যাসে দুবাই প্রবাসী রুস্তম বাঙালী প্রবাসী শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি। নববধূ কলিকে মায়ের দায়িত্বে বাড়িতে রেখে সে জীবিকার সন্ধানে প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছে। জন্মধাত্রি মায়ের স্বরূপ, মনস্তত্ত্ব ও সংকট রুশনা বেগমের চরিত্রে বাস্তবতার নিরিখে ফুটে উঠেছে। রুশনা বেগম একদিকে রুস্তমের জননী অন্যদিকে পুত্রবধূ কলির শাশুড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’ গল্পে নববধূ হৈমন্তীকে শ্বশুরবাড়িতে প্রতিনিয়ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। হৈমন্তীর শুভাকাক্সক্ষী কেউ ছিল না। শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা সকলেই এক একজন বিজ্ঞ পরীক্ষক রূপেই ছিলেন। হৈমন্তী গল্পটি সবুজপত্র পত্রিকায় ১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। একশত বছর অতিক্রান্ত হলেও এই একবিংশ শতকেও নববধূর প্রতি শ্বশুরবাড়ির মানুষদের আচরণ ও মানসিকতা অধিকাংশে একই রয়ে গেছে। উপন্যাসে ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক কুফিয়ার সংসার ভাঙার বর্ণনায় প্রমাণ মিলে বিষয়টি শুধু বাঙালীর সংস্কার বা মজ্জাগত সমস্যা নয়। নববধূকে নির্যাতন বিশ্বের অনেক স্থানেই প্রচলিত রয়েছে। হৈমন্তী শ্বশুরবাড়িতে প্রধানত যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছে অন্যদিকে কলির নির্যাতনের কারণ কাহিনীর প্রয়োজনে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। স্বরূপটি এক না হলেও মানসিক নির্যাতন ও শাশুড়ি কর্তৃক পুত্রবধূকে আপন করে না নেওয়ার বিষয়ে শতভাগ মিল লক্ষণীয়। পুত্র সন্তানের জননী পুত্রের বিয়ের পরে মানসিক হীনম্মন্যতায় ভোগে। এ সময় তার পুত্রের প্রতি ষোলআনা অধিকারবোধে আঘাত লাগে। সংকীর্ণ মনের উদ্ভট চিন্তায় পুত্রের অধিকার আদায়ের যুদ্ধে শাশুড়ি নবপরিণীতা বধূকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। যে কোন উপায়ে বধূর নামে না সূচক কথা উপস্থাপন করে ছেলের কান ভারি করে তোলে। নবদাম্পত্য জীবনের বিশুদ্ধ প্রেমপূর্ণ সম্পর্কের মাঝখানে হামলে পড়ে শাশুড়ির মনগড়া অভিযোগ। বিশুদ্ধ প্রেম বিষময় হয়ে ওঠে। শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর চূড়ান্ত মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট ও সম্পর্কের দূরত্ব। শাশুড়ি ব্যক্তিটি শুধু ছেলেকে দখলে রাখার নীরব প্রতিযোগিতায় নিজের অজান্তেই ছেলের সুখি-সত্তায় আগুন জ্বেলে দেন। মনোজগতের ভুল পরিকল্পনায় হয়তো কখনও কখনও তিনি ক্ষণিক বিজয়ের হাসিতে পুলকিত হয়ে ওঠেন। অধিকাংশ বাঙালী সংসারে গতানুগতিক এই একই চিত্র হাজার বছর ধরেই প্রবহমান। মরুঝড় উপন্যাসে সে প্রবহমানতার সাক্ষী হিসেবে রুশনা বেগম চরিত্রটি ফুটে উঠেছে। কলির শাশুড়ি রুশনা বেগম পুত্রবধূর প্রতি উদার নয়। বাড়ির বাহিরে শৌর্যের মতো কিশোরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলেও তিনি কলির দিকে সন্দেহের তির নিক্ষেপ করেছেন। অন্যদিকে তার কন্যা রওনক জাহান পূর্ব প্রেমিক মনিরের সঙ্গে ভরা সন্ধ্যায় পুকুর পাড়ে ত্রিশ মিনিট সময় কাটিয়ে আসলে তিনি সামান্য বিব্রত হয়েছেন মাত্র। বিদ্রোহ করেননি বা মেয়েকে অবিশ্বাস করেননি। এই একটি ঘটনায় পরিবারে বধূ এবং কন্যার অবস্থানটি কথাশিল্পী মোহিত কামাল অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। প্রকৃতপক্ষে স্বামীর উপস্থিতিতেই নববধূকে সংসারের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে অত্যাচার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। উপন্যাসে প্রবাসী রুস্তমের সুন্দরী বধূ কলি শাশুড়ির মাত্রাতিরিক্ত অভিভাবকত্ব এবং পুত্রের প্রতি তার একচ্ছত্র অধিকার রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টায় মিথ্যা দোষারোপে শতধা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কলির শাশুড়ি মোবাইল ফোন নিজের মালিকানায় রেখেছে। রুস্তমের সঙ্গে ফোনে কথা বলায় তার প্রবল আপত্তি রয়েছে। ছেলের বউয়ের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি ও ভালবাসায় বাধা সৃষ্টি করাকেই তিনি যুক্তিযুক্ত ভেবেছেন। সঙ্গত কারণেই শৌর্য কেন্দ্রিক বানোয়াট মিথ্যা অভিযোগের বিষ রুস্তমের কানে ঢেলে দিয়ে তৃপ্ত হয়েছেন। পরিণামে যন্ত্রণায় ছটফট করেছে রুস্তম ও কলি। শাশুড়ির মনগড়া অভিযোগ, কলিকে অহেতুক সন্দেহ করা সর্বোপরি স্বামীর সঙ্গে কলির নিয়মিত যোগাযোগ বন্ধ করার মতো ঘৃণ্য কাজ তার মনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই ক্ষোভের বশবর্তী কলি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। গায়ে বোরখা চাপিয়ে শাশুড়ির অনুমতি ছাড়াই উপজেলা পরিষদ অফিসে পৌঁছে স্বামীর খবর জানতে চায়। স্বামীর সম্ভাব্য আরও সংবাদ জানার জন্য উদগ্রীব কলি জাফর আহমেদের দেওয়া মুঠোফোনটি নিতে বাধ্য হয়। কলি বালিকাবধূ হলেও সামাজিক আচার-বিধি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। সমাজের অদৃশ্য শৃঙ্খল বোঝে বলেই সে শৌর্যের মাছ ধরার সাথী হতে পারে না। ইচ্ছে হলেই শৌর্যের সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলতেও পারে না। সঙ্গত কারণেই সে জাফর আহমেদের মুঠোফোনটি নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। শাশুড়ির কটু কথাসম মিথ্যা অভিযোগে রক্তাক্ত হয়েছে কলির অন্তরাত্মা। অনেক সময় দিশেহারা অবস্থাতেও সে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। স্বামীর মুক্তির প্রচেষ্টায় প্রথম স্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি পত্র শৌর্যের মাধ্যমে দুবাই পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। সর্বোপরি স্বামীর কল্যাণ কামনায় তাকে বিপদমুক্ত করতে বাঙালী নারীর সীমাহীন আত্মত্যাগের চিত্রটি উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে। কলির চেতনায় শুভবুদ্ধির পাশাপাশি উপন্যাসে তার অবচেতন মনের দুরভিসন্ধির সংকেতও রয়েছে। শৌর্যের বাড়বাড়ন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে তার শরীরকে চকচকে রুপালি রাজপুঁটি মনে হওয়ায় চিরাচরিত মানবমনের অবচেতন স্তরের প্রবৃত্তির দিকটি প্রকাশিত হয়। প্রবাসী স্বামীর বালিকা বধূর একাকিত্বকে জোরালোভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজনে; বিরহী বধূর কামনাকে জানান দিতে লেখক বাগানের মাঝে জোড়া সরবতী লেবু, কোকিলের ডাক, নীল মেঘের আনাগোনা, রাজপুঁটির চকচকে শরীর ইত্যাদি নানা উপমা ও রূপক ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে কলির মনের চেতন-অবচেতন স্তরজুড়ে যে ভালবাসা তা দখল করে আছে স্বামী রুস্তম। কলি রুস্তমের অনুপস্থিতিতে কিশোর দেবর শৌর্যের বাড়বাড়ন্ত শরীরের প্রতি যে কিঞ্চিৎ মোহময় দৃষ্টি ফেলেছে তার জন্য প্রাথমিক দৃষ্টিকোণে শাশুড়ির ক্রমাগত সন্দেহকে দায়ী করা যায়। স্বাভাবিক জীবন চলায় হয়তো কলির মন শৌর্যের শরীরের প্রতি এতটা তীক্ষè দৃষ্টি নিক্ষেপ করতো না। কেননা বাঙালী বিরহী বধূর স্বামীর জন্য অস্থিরতার সবটুকু কলি চরিত্রে লক্ষণীয়। ছেলের অনুপস্থিতিতে রুশনা বেগম নিজের অজান্তেই বালিকা বধূকে অপ্রীতিকর কথার মাধ্যমে শৌর্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। তবে শুদ্ধ সত্তার অধিকারী কলি সার্বিকবোধ ক্ষমতার দ্বারা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কলি নিজের মনের চাওয়ার কাছে পরাজিত হয়ে উপলব্ধি করেছে তাকে নিয়ে শাশুড়ির উৎকণ্ঠার যৌক্তিকতা। অর্থাৎ শাশুড়ি শৌর্যের সঙ্গে কথা বলা পছন্দ করেন না কেন এ বিষয়টি তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। লেখক কলির অবচেতন মনের ইঙ্গিতকে নির্বাপিত করে বিবাহিতা বাঙালী নারীর ধর্ম রক্ষা করেছেন। ভাবির জন্য শৌর্যের মনে রয়েছে দায়িত্ববোধ ও ভালবাসা। এই ভালবাসা সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করতে চাইলে কিশোর শৌর্যও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যা তার নয়, তা পাওয়ার জন্য হাত বাড়ায়নি। উপন্যাসে উপজেলা পরিষদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে কিশোর শৌর্যের গভীর দীর্ঘশ্বাসেই মিশে আছে ভালবাসা ও সংযমী মনোভাব। শৌর্য ও কলির মনে তৈরি হওয়া নির্ভরতা-বিশ্বাসকে সে নাম দিয়েছে কুটুম বন্ধু। অবশেষে বন্ধুত্বের বিশ্বাস থেকেই শৌর্য-কলিকে আশ্বস্ত করেছে। ভালবাসা ও দায়িত্বজ্ঞানকে কথাকার বন্ধুত্বের বন্ধনে কালিমামুক্ত করেছেন। মরুঝড় উপন্যাসে বাংলাদেশী কলির পাশাপাশি দুবাই কলি চরিত্রের দেখা মেলে। দুবাই কলি অপ্সরার মতো সুন্দরী। কাহিনীর সূচনায় দুবাই কলি একরূপে পাঠকের সামনে উপস্থিত হলেও বন্দী রুস্তমের মুক্তির পরে তার স্বরূপ বদলে যায়। অর্থাৎ রুস্তমের সঙ্গে দেখা করার প্রবল ইচ্ছার যে নীল নকশা তা প্রথমাবস্থায় কামুক দুবাই কলিকে উপস্থাপন করে। পরবর্তীকালে সে স্বীকার করে তার এই নীল নকশার পেছনে ছিল রুস্তমের মানবিক সত্তার শুদ্ধতা যাচাইয়ের পরীক্ষা। সমালোচক মনে এই স্বীকারোক্তির সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থাৎ শুধু শুদ্ধতা যাচাই নয় রুস্তমের প্রতি দুবাই কলির দুর্বলতাও ছিল। ঘটনা-দুর্ঘটনার অন্তঃস্থলে রুস্তমের প্রতি তার অধিকারবোধের প্রমাণ মেলে। আম্মিজানের সম্মুখে রুস্তম বিবাহিত শোনার পরেই দুবাই কলির মুখে ফুটে ওঠা অস্থিরতাই সে সত্যতার প্রমাণ দেয়। দুবাই কলি রুস্তমের প্রতি দুর্বলতা, অধিকারবোধ ও মুগ্ধতার বিনিময়ে তাকে দুবাইয়ের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। উচ্চপদে কর্মসংস্থান করছে। এমনকি রুস্তমের স্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। এই আবেদন বা আত্মিক চাওয়া এক মুহূর্তে সৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতপক্ষে রুস্তমের প্রতি দুবাই কলির দুর্বলতা, ভাললাগা ও ভালবাসা অঙ্কুরিত হয়েছিল সিঁড়িঘরে লাল পতাকা উড়ানোর পূর্বেই। বাথরুমের লাইট জ্বালানোর কাজে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে রুস্তমের বেডরুমে প্রবেশের পূর্বেই দুবাই কলির মনে পূর্বরাগের সৃষ্টি হয়েছে। রুস্তমের শাস্তির পরে সে পূর্বরাগ ক্রমাগত পরিপূর্ণ আস্থা ও ভালবাসায় রূপ নিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে তাঁর নীতিবাদী সত্তার কাছে শিল্পীসত্তা পরাজিত হয়েছে। নীতিবাদী বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষ উপন্যাসের কুন্দনন্দিনী এবং কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের রোহিনী চরিত্র দুটিকে হিন্দু ধর্মের নিয়ম লঙ্ঘন করে বিপথগামী হাওয়ার শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদ- দিয়েছেন। তবে মৃত্যুদ- দেওয়ার পূর্বে কুন্দ এবং রোহিনীকে জীবন রসের সুধা পাত্র হাতে ধরিয়ে তা পান করিয়েছেন। মরুঝড় উপন্যাসেও কথাশিল্পী মোহিত কামালের নীতিবাদী সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। ধর্মীয় রীতি অমান্য করে দুবাই কলির সামান্য চারিত্রিক দুরাচারিতায় লেখক তাকে জীবন সঙ্কটে ফেলেছেন। লেখক দুবাই কলির জীবনে ঘটে যাওয়া কলঙ্ককে খ-ন করেননি। তাকে কলঙ্কের সঙ্গী করেই পরবর্তী অনিশ্চিত সঙ্গীবিহীন শূন্য জীবন উপহার দিয়েছেন। উপন্যাসের শেষে জানা যায় কলঙ্কের কারণে দুবাই কলির বিয়ে ভেঙে যায়। বিয়ের প্রস্তাবটিও পঞ্চাশোর্ধ্ব বা ততোধিক বৃদ্ধ আমিরদের পক্ষ থেকেই আসে। দুবাই কলির অপরাধ বা পাপ কুন্দ বা রোহিণীর সমতুল্য নয় বলেই হয়তো লেখক তাকে মৃত্যুদ- দেননি। এরূপ শাস্তি প্রদান করে বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। অর্থাৎ মোহিত কামালের লেখক সত্তার নীতিবাদী রূপটি উপন্যাসের কাহিনীতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় মরুঝড় উপন্যাসে লেখকের শিল্পীসত্তাকে ছাড়িয়ে নীতিবাদী সত্তার জয় ঘোষিত হয়েছে।
×