ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুজিব শতবর্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্মান দিন

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৫ নভেম্বর ২০২০

মুজিব শতবর্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্মান দিন

মুজিব শতবর্ষে সবচাইতে বিনম্র শ্রদ্ধামণ্ডিত একটি কার্যক্রমের কথা ভাবছিলাম। কি হতে পারে সেই শ্রেষ্ঠ সুন্দর কাজটি? অনেক দিন আগে থেকেই একটা আকাক্সক্ষা মাঝে মাঝেই জানান দিত। এটি হচ্ছে- আমরা যদি একসঙ্গে আমাদের সম্মানিত শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী বিশেষত যাঁরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নানাভাবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদেরকে একটি বড় তালিকা করে একটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হলে সেটি হবে মুজিব শতবর্ষের উদযাপনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজ। এর ফলে অনেক বুদ্ধিজীবী, প্রধানত শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা এমন অনেক শহীদ পেশাজীবী রয়েছেন, যাঁরা স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদক প্রাপ্ত অনেকের চাইতে অনেক বেশি অবদান রেখেছেন, অথচ কোন স্বীকৃতি পাননি এখনও। এ প্রসঙ্গে বিদেশী যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রেখেছেন, তাঁদের প্রায় সবাইকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হয়েছে। যদিও সোনার মেডেলগুলো ছিল আমলাদের তৈরি খাদবিশিষ্ট খুঁতওয়ালা! তাদের মধ্যে একটি দল বাদ পড়েছেন, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ধর্ষিত নারীদের নবজাত পনেরোটি শিশুকে দত্তক গ্রহণ করে পরে অন্য দেশীয়দের ’৭২ সালে জাত গর্ভবতী বীরাঙ্গনাদের নবজাতক শিশুদের দত্তক গ্রহণের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তাঁদের সবাইকে সম্মান জানানোর এটি একটি প্রকৃষ্ট সময়। কেননা এটি একদিকে বঙ্গবন্ধু শতবার্ষিকী, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তি বার্ষিকী। আশা করছি, এটি করা হবে। এখন আসা যাক আমাদের কোন রকম রাষ্ট্রীয় সম্মান না পাওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গে। একটি তালিকা করে তাঁদেরকে একসঙ্গে, ধরা যাক এক হাজার শহীদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিককে এই আসছে ২০২১-এর মার্চ মাসে স্বাধীনতা পদক বা ‘স্বাধীনতা স্মারক মেডেল’ তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা সম্ভব এবং এ কাজটি খুবই যৌক্তিক হবে। এ প্রসঙ্গে কয়েক শহীদের কথা মনে পড়ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে বেশ ক’জন সেনা-পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছিলেন, যাদের মধ্যে মনে পড়ছে লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেন (পদকপ্রাপ্ত), বরিশালে কর্মরত এসপি গোলাম হোসেন (শহীদ কিন্তু সম্মাননা পাননি), এসপি মামুন মাহমুদ (শহীদ, সম্ভবত পদকপ্রাপ্ত), পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুর রহমান (শহীদ হুমায়ূন আহমদের পিতা, সম্মাননা পাননি)। শহীদ চিকিৎসকদের মধ্যে মে-জুন মাস থেকেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু করেছিলেন সিলেটের শহীদ ডাঃ শামসুদ্দীন, ঢাকার শহীদ ডাঃ আলিম চৌধুরী, ডাঃ ফজলে রাব্বী, ঢাকার হাতিরপুলে বাসরত নববিবাহিত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সার্জারির তরুণ ডাঃ আজহারুল হক, একই সঙ্গে কর্মরত ডাঃ হুমায়ুন কবির, যারা প্রতিরাতে বাসার কাছে একটি ভাড়া করা কক্ষে যুদ্ধে আহত হয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে চিকিৎসা দিতেন। কিন্তু নবেম্বরে তাঁরা এ এলাকার এক বিহারীর নজরে পড়ে যান। ১৪ নবেম্বর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একই বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাট থেকে প্রতিদিনের মতো দুই বন্ধু ঢাকা মেডিক্যালে যাবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে, তখনই আলবদরের খুনী বাহিনী ঐ দুই ফ্ল্যাটে তাঁদের সন্ধানে আসে এবং না পেয়ে ছুটে চলে গিয়ে একটু দূরেই ডাক্তারের এ্যাপ্রন পরা ডাঃ আজহারুল ও ডাঃ হুমায়ুন কবিরকে নাম জেনে নিশ্চিত হয়ে ঐ সকালবেলা ধরে নিয়ে যায়। জাতিকে স্মরণ রাখতে হবে- বাংলাদেশের বিজয়ের মুখে বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-টি শুরু হয় এই দিন-১৪ নবেম্বর থেকে। এখন বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালিত হয় ১৪ ডিসেম্বর, যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি থেকে গেস্টাপো খুনীদের মতোই তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল আলবদরের খুনীরা এবং যাঁদের অনেকের মৃতদেহ ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়! সেদিন আনোয়ার পাশার সঙ্গে থাকা ইংরেজী বিভাগের রাশিদুল হাসান, ইতিহাসের গিয়াস উদ্দীন আহমদ, যিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের আওতায় কাজ করছিলেন, সুরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ড. আবুল খায়ের, বাংলার মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আরও কয়েকজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের অনেকেই সম্মাননা লাভ করেননি। সাংবাদিকদের মধ্যে তরুণ সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা, সিরাজউদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ্্ কায়সার, বিবিসির নিজাম উদ্দীন, নিজামুল হক এই দিনে আলবদরদের হাতে নিখোঁজ হন, যাদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, আগে উল্লিখিত তরুণ ডাঃ আজহারুল হক ও ডাঃ হুমায়ুন কবিরের মৃতদেহ ঐ ১৪ নবেম্বর বিকেলে নটরডেম কলেজের সামনের রাস্তার কালভার্টের নিচে পাওয়া যায়। স্বজনরা সেই দেশপ্রেমিক দুই তরুণ ডাক্তারের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। অতি দুঃখের সংবাদ হচ্ছে, সে সময় নববিবাহিত ডাক্তারের স্ত্রী মিসেস সালমা হক গর্ভবর্তী ছিলেন এবং ’৭২ সালের জানুয়ারিতে তাঁদের পুত্র নিশান জন্ম গ্রহণ করে। অথচ ১৪ নবেম্বরের পর সালমা হকের জীবনে যে কালো শোকের পর্দা নেমে আসে, তা নিয়েই তিনি শহীদ পিতার পুত্রের জন্ম দেন। অল্প বয়সী সুন্দরী তরুণী পেয়ে অনেক বিবাহের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এই ভেবে যদি তারা তাঁর প্রিয় স্বামীর পুত্রকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ না করে! কোন কোন শহীদের বিধবা স্ত্রীকে দ্বিতীয় বিয়ে করে একটি সুন্দর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে মাঝে মাঝে ভাবি- তরুণী সালমা, তাঁর পুত্রসহ হয়ত তেমন একটি শান্তিপূর্ণ সংসার জীবন পেতে পারতেন। জানি না কি হতো, সবার ক্ষেত্রে ভাগ্য এক সমান সদয় হয় না। যা হোক আরেকটি ভাবনাও মাথায় আসে। এই যে ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরসহ সব শহরে রাজপথ আছে, এই শহীদদের নামে কোন রাজপথের নাম দেয়া হয় না কেন? তাছাড়া আমাদের দেশের বড় বড় স্থাপনা, ব্রিজ, সেতু, বিদ্যুতকেন্দ্র, সমুদ্র-নদী বন্দর, জেটি, সেনানিবাস- এমনসব দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনার নাম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে দেয়া হলেও তো আমরা জাতি হিসেবে তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারতাম। আমার মনে হয়, রাজধানীর নতুন বিমান বন্দরের নাম হওয়া উচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিমানবন্দর। মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ অনেকের নামেই স্থাপনা থাকা উচিত। চট্টগ্রামের জহুর হোসেন চৌধুরীর নামে স্টেডিয়ামের নামকরণ করা সঠিক হয়েছে। কিন্তু এমন হতে পারে- সব জেলার স্টেডিয়ামগুলো জাতীয় নেতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা। এ ছাড়াও, আমাদের দীর্ঘদিনের জাতীয় রাজনীতিতে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুরদের অবদানকে স্বীকার করে তাদের অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টি সামগ্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা- সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ও তা বাস্তবায়নে জাতির পক্ষে ইতিবাচক রাজনীতি ও রাজনীতিতে কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায়কে মৌলিক লক্ষ্য ও ইস্যুতে পরিণত করে ভারতবর্ষসহ বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনে রাজনীতিকে গণমানুষের কল্যাণের দিকে পরিচালনা করেন। এভাবে তাঁরা রাজনীতির নবায়ন করেছেন। এই দলের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, গেরিলা যুদ্ধে অসীম অবদানকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে এবং জাতীয় নেতা মনি সিংহ, কমরেড মোজাফফর, কমরেড ফরহাদ, সাইফুদ্দীন মানিক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ছাড়াও বহু বাম নেতার অবদানে সফল হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। অন্তত শহীদ এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দের নামে রাজপথ, জেলাওয়ারি স্থাপনা, স্টেডিয়াম, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ইত্যাদির নামকরণ করা মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদ্্যাপনের একটি যথাযোগ্য কার্যক্রম হবে, যা বঙ্গবন্ধু কন্যার শাসনামলে না হলে পরে আর হবে বলে মনে হয় না। এখনই একটি কথা মনে পড়ল, ঢাকার বিমানবন্দরে লালন সাঁইয়ের একটি ভাস্কর্য ছিল, যেটি মৌলবাদীদের হামলা ও প্রতিবাদের ফলে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধপন্থী কোন সরকার আমাদের দেশের মাটি থেকে উঠে আসা জাত-পাত-ধর্মের বিভেদের বিরুদ্ধে বাঙালী সংস্কৃতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য-ভেদাভেদহীন সাম্যের আহ্বানকারী এদেশের বাউল-ফকিরদের মধ্যে অগ্রগণ্য লালন সাঁই, শাহ আবদুল করিমসহ বড় একটি গোষ্ঠী বাঙালীর অহংকার ও গৌরবের পাত্র। তাঁদেরকে স্মরণীয় করে রাখা জাতি হিসেবে আমাদের একটি কর্তব্য এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে একান্তভাবে করণীয়। ঢাকা বিমানবন্দরে বিদেশীরা প্রবেশের সময় যদি লালন সাঁইয়ের একটি ভাস্কর্যের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত বাণী- বাংলা ও ইংরেজীতে খোদাই করা দেখতে ও পড়তে পারে, তাহলে সেটি হবে বাঙালীর গৌরবময় সংস্কৃতির এক মহিমাম-িত রুচিসম্পন্ন সৌন্দর্যবোধের পরিচায়ক। তাছাড়াও, অনেক বিদেশী আমাদের সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট। তাদের অনেকেই লালন সাঁইকে জানেন, অনেকে লালনকে নিয়ে গবেষণাও করছেন। সুতরাং মুজিব শতবর্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আমরা আমাদের শহীদ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের, বিদেশী শিশু দত্তক গ্রহণকারী দম্পতিদের একটি সম্মানে ভূষিত করে নিজেরাও সম্মানিত হতে পারি। লেখক : শিক্ষাবিদ
×