ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্যের শিকলে বাঁধা ওদের সংগ্রামী জীবন

প্রকাশিত: ২৩:০১, ৪ নভেম্বর ২০২০

দারিদ্র্যের শিকলে বাঁধা ওদের সংগ্রামী জীবন

ওয়াজেদ হীরা ॥ বাবার হাত ধরে মাত্র আট বছর বয়সে মাছ ধরতে নদীতে যাওয়া শুরু হয়েছিল মুন্সীগঞ্জের জামাল উদ্দিনের। ৩৮ বছর ধরেই পদ্মা-মেঘনার বুকে মাছ ধরছেন। সংসারে সুখের আশায় এখনও অবিরত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জামাল উদ্দিনের মতো কত জেলেই নদীতে ভেসে কাটান অধিকাংশ সময় আর জীবনের একটা সময় মনে করে জেলে পরিবারে জন্মই যেন অভিশাপ! মাছ ধরা, বিক্রি করা, তবুও কাটে না দুর্দশা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শিকলে বাঁধা তাদের জীবন। সমুদ্রে কখনও দস্যু আবার দুর্যোগের আতঙ্ক কাটিয়ে কিনারে ফিরলে পড়তে হয় দাদনদারদের রোষানলে। হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয় কড়ায়-গ-ায়। দিন আনা দিন খাওয়া জেলে পরিবারের অবস্থা বদলায় না, এক টুকরো সম্পদ গড়তে পারেন না তারা। তাইতো ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অভাবের তাড়নায় ছুটে যান নদীতে। এবার করোনার লডকাউনে আরও বেশি নাজুক জেলেরা। সরকারীভাবে জেলেরা ২০ কেজি চাল পাচ্ছেন তবে তা ‘অপর্যাপ্ত’ বলছেন অনেকেই। প্রতি বছরই সরকারী সহযোগিতা বাড়ানো হচ্ছে। চলছে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২০। ১৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২২ দিন পর আজ শেষ হবে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা। এর আগে জাটকা রক্ষা ও ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে ১ নবেম্বর থেকে ৩০ জুন নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে সরকারের কড়া নজরদারির মধ্যে কোথাও কোথাও প্রশাসনের ওপর হামলাও করছেন জেলেরা। বাংলাদেশে পাঁচ লাখেরও বেশি উপকূলীয় মৎস্যজীবী সরাসরি ইলিশ ধরার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে মাছের বিপণন, পরিবহন ও বাজারজাত করার সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। সরকারের জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা এবং মা ইলিশ সুরক্ষাকালীন সময় কড়াকড়ি আরোপ করার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। সেই সঙ্গে বাজারে বড় আকারের ইলিশও মিলেছে। ভাগ্যের চাকা জেলেদের আর তেমন ঘুরছে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার মৎস্য সেক্টরের সঙ্গে জড়িত সবার জীবনমান উন্নয়নে আন্তরিক। জেলেদের যে সহায়তা দেয়া হচ্ছে বছর বছরই তা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমরা ক্রয়সংক্রান্ত মিটিংয়ে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছি এই সহায়তাকে যেন দুর্যোগ হিসেবে সামনে দেখানো হয়। সরকারের নানা সহযোগিতা আর কাজের পরিধি বৃদ্ধির কারণে ইলিশের উৎপাদনও বাড়ছে। সবাই বড় আকারের ইলিশ পাচ্ছে। আমরা ইলিশের উৎপাদন এমন জায়গায় নিয়ে যাবো যেখানে ধনী গরিব সব শ্রেণীর মানুষ ইলিশের স্বাদ পাবে। রাজধানীতে যেখানে ইলিশের কেজি বিক্রি হয় হাজার টাকা সেখানে ইলিশ ধরার জেলাগুলোতে জেলেদের মাসে কয়েক হাজার টাকার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। অভাব আর একটু বেশি আয়ের আশায় অনেক সময়ই আইন অমান্য করে অনেক জেলে নদীতে জাটক, মা ইলিশ ধরতে যান। অভাবের তাড়নায় অনেক সময় এটি করতে বাধ্য হন বলে একাধিক জেলে জানান। পদ্মা মেঘনা পাড়ের একাধিক জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই সরকারী সুবিধা পাচ্ছেন তবে সবাই নয়। এর জন্য জেলে কার্ড রয়েছে। আর যে সুবিধা পাচ্ছেন সেটিও পর্যাপ্ত নয় বলে মত তাদের। শরীয়তপুরের এক জেলে বলেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে থাকে। কারণ আমাদের কোন কাজ থাকে না। উপার্জনের অন্যান্য রাস্তাও বন্ধ থাকে। মহাজনরাও আমাদের ঋণের টাকা শোধ করার জন্য চাপ দিতে থাকে। মুন্সীগঞ্জের জামাল উদ্দিনের মতো উপকূলের অন্য জেলেরাও ঋণের বোঝায় জর্জরিত। জাল-নৌকা বানাতে, নতুন মৌসুমে বেশি মাছের আশায় মহাজনদের কাছে হাত পাততে হয় এদের। যেটাকে জেলেরা দাদন বলে, সেটাই আসলে মহাজনী ঋণ। এই ঋণের দুষ্টচক্র ওদের পিছু ছাড়ে না। আর এই ঋণের কারণে যুগের পর যুগ ওরা মাহাজনদের কাছেই বন্দী থাকে। বেশি মাছ পেলে জেলেদের মুখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে ঠিকই তবে নদী থেকে মাছ তুলে আড়তে উঠতে না উঠতেই জেলের সে আনন্দ মিলিয়ে যায়। দাম নির্ধারিত হয় মহাজনের ইচ্ছায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাছ ধরতে নামার জন্য অগ্রিম দাদন নেয়ার কারণে জেলেরা প্রতিনিয়ত ঠকছে। মাছের ন্যায্য দাম তারা পায় না। ভোলা বরিশালের কয়েকজন জেলে জানান, এখন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে কেউ কেউ যাচ্ছে তবে মৌসুমেও আমরা সঠিক দাম পাই না। যার কাছ থেকে দাদন নেই, তাকেই মাছে দিতে হয়। ভোলার দৌলতখান, ইলিশা, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, হাতিয়ার বুড়িরচরের অনেক জেলের অভিযোগ, মহাজনেরা একটি সিন্ডিকেট করে মাছের দাম কমিয়ে রাখে। আড়তে মাছ ওঠার পর ডাকের মাধ্যমে দাম হাঁকা হলে সেটাও থাকে লোক দেখানো। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মৎস্যজীবী জেলে সমিতিগুলো। সমিতির নেতাদের মতে, আড়তে মাছ নিয়ে এসে জেলেরা কখনই ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয় না। এখানে দাম হাঁকা হয়। এ বছর ইলিশ মৌসুমে অনেক স্থানেই বেশি মাছ ধরা পরেনি আবার করোনাভাইরাসের কারণেও আয় তেমন হয়নি সে কারণে চলতি বছরে জেলেদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। এসব কারণে এবার বার্ষিক আয় ব্যয়ের চক্রও ভেঙ্গেছে। অক্টোবরে মাছ ধরা বিরতির এই সময়ে সামনের দিনগুলো নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন অনেক জেলে পরিবার। পটুয়াখালীর কালাম শেখের মতে, যদি আমরা একটা সময় ভাল ইলিশ ধরতে পারি, তবে আমরা সারা বছর ধরে ভাল জীবনযাপন করতে পারি, আমরা আমাদের বাড়ি মেরামত করা, ঋণ শোধ করা, আমাদের বাচ্চাদের জন্য বিবাহের ব্যবস্থা করার মতো কাজ করতে পারি। সবই ইলিশ ধরার আয় থেকেই আসে। তবে এ বছর ইলিশের পরিমাণ কম। করোনায় লকডাউনের সময় তার পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে আরও বেশি ধার নিতে হয়েছে বলে পরিশোধ করা নিয়েও দুশ্চিন্তায় কালাম শেখ। মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা ॥ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ধরা ছাড়া অনেক জেলের বিকল্প কর্মসংস্থান নেই। বেশিরভাগ জেলেরই নিজের কোন জাল বা নৌকা নেই। তারা নৌকা ও জালের টাকা জোগাড় করেন স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। তাই জাল, নৌকা ও এমনকি ধৃত মাছের উপরেও মহাজনদের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকে। জেলেদের মতে, যদি আমরা মহাজনের কাছে মাছ বিক্রি না করি তবে দাম আরও অনেক বেশি পাই এবং দ্রুত ভাগ্যের উন্নয়ন করা সম্ভব। তবে এটি কেউ কল্পনাও করেন না। বরিশালের এক জেলে বলেন, সারাবছর টাকা ঋণ হিসেবে তো মহাজনরাই দেয়। তাদের সাথে শর্তও থাকে মাছ তাদেরই দিতে হবে। দামটাও কম পাই। সাধারণত জেলেরা কখনই পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন না। তারা স্থানীয় ঘাটে ব্যাপারীদের কাছে মাছ বিক্রি করেন। চলছে অভিযান, চলছে ইলিশ ধরাও ॥ প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে প্রশাসন। এর মধ্যেও থেমে নেই ইলিশ ধরা। প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন নদীতে ইলিশ শিকারের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছেন না জেলেরা। মাঝে মাঝে কিছু জেলেদের নদীতে ইলিশ শিকারের অপরাধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দিচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কোথাও কোথাও পুলিশ প্রশাসনের ওপর হামলাও করছেন জেলেরা। গত ২৫ অক্টোবর মেঘনায় জেলেদের হামলায় ২৫ নৌ পুলিশ আহত হয়। চাঁদপুর সদর উপজেলার মেঘনা নদীর লক্ষ্মীরচর এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে।
×