ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

বুড়িমারির হত্যাকাণ্ড এবং ইসলামের শিক্ষা

প্রকাশিত: ২১:১৩, ৪ নভেম্বর ২০২০

বুড়িমারির হত্যাকাণ্ড এবং ইসলামের শিক্ষা

বিখ্যাত পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি তো ‘ভলগা টু গঙ্গা’ উপন্যাসে মানব সভ্যতার দু’হাজার বছরের অগ্রগতি দেখিয়েছেন। এই সভ্যতা কতটা এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন? সাংকৃত্যায়ন জবাব দিয়েছিলেন, ‘ধর্মের বাঁধন, আইনের শাসন আমাদের কি সভ্য করতে পেরেছে? আমার তো মনে হয় আমাদের পোশাকি সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। কিন্তু তার হিংসা ও বর্বরতা আরও বেড়েছে। অসভ্য যুগে আমরা তীর-ধনুক দিয়ে পরস্পরকে হত্যা করেছি। এখন আরও ভয়াবহ অস্ত্র দিয়ে আরও ব্যাপকভাবে নিজেদের হত্যা করছি। ধর্মের বিধান এবং আইনের শাসনকেও এখন আমরা মানুষ হত্যার কাজে লাগাচ্ছি। মানুষ হত্যার পারদর্শিতা এবং এই হত্যার জন্য অস্ত্র নির্মাণে আমাদের পারদর্শিতা বেড়েছে। তাকেই আমরা সভ্যতার অগ্রগতি বলছি। বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে মানব সভ্যতার সূচক হিসেবে ধরা যেত। কিন্তু সেই বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীরাও আজ ঘাতক শক্তির কবলে।’ বাংলাদেশের লালমনিরহাটের বুড়িমারিতে ক্ষিপ্ত জনতার এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মারার বর্বর ঘটনায় রাহুল সাংকৃত্যায়নের এই উক্তিটি মনে পড়ল। এই একুশ শতকের বাংলাদেশে অসভ্য যুগের এমন ঘটনা অবিশ্বাস্য। নিহত মোঃ শহিদুন্নবী রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজের গ্রন্থাগার বিভাগে এক সময় চাকরি করেছেন। তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা ছিল বলে জানা যায়। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। নিহত যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সন্ধ্যার নামাজের পর তিনি মোটরসাইকেলে এসে মসজিদে ঢুকেছিলেন। তিনি পবিত্র কোরান অবমাননাকর কাজ করেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে শত শত মানুষ চলে আসে এবং তাকে পেটাতে শুরু করে। এই অবস্থায় সেখানে উপস্থিত কয়েক ব্যক্তি তাকে বাঁচাতে বুড়িমারি ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে নিয়ে যায়। সেখানেও উত্তেজিত জনতা ধাওয়া করে। অফিস ভেঙ্গে তাকে বাইরে নিয়ে আসে এবং বেদম প্রহার চালাতে থাকে। যুবকের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে হতভাগ্য যুবকের গায়ে আগুন ধরিয়ে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়। এই ঘটনাটি হৃদয়বিদারক। পবিত্র কোরানের অবমাননা নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু তার শাস্তি কি পুড়িয়ে মারা? প্রথম কথা, নিহত যুবকের মানসিক ভারসাম্য ছিল না। দ্বিতীয় কথা, তিনি কোরান অবমাননা করেছেন তার কোন অকাট্য প্রমাণ ছিল কি? যুবক মসজিদে ঢুকেছিলেন কোরানের অবমাননা করতে, না নামাজ পড়তে? প্রকাশিত খবরে এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এক বা একাধিক লোক তিনি কোরান অবমাননা করেছেন বলে অভিযোগ তোলে। তার সত্যাসত্য প্রমাণ হওয়ার আগেই শত শত লোক শুধু গুজব শুনে উত্তেজিত হয়ে ছুটে এসে এক ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারল, এটা মেনে নেয়া যায় কি? এই হত্যাকা- এক মিনিটে বা এক ঘণ্টায় ঘটেনি। এই সময় স্থানীয় প্রশাসন কোথায় ছিল? একজন মানুষের (হোক সে অপরাধী) জীবন রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার আসল কারণটা কি? ধরে নেয়া যাক, মোঃ শহিদুন্নবী পবিত্র কোরানের অবমাননা করেছেন। সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা তা সত্য প্রমাণিত হলে অবশ্যই তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে বিচারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। কিন্তু জনতা যতই ক্ষিপ্ত হোক, আইন তাদের নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার নেই। ধর্মও তাকে পুড়িয়ে মারার বিধান দেয়নি। বরং ইসলাম এ ধরনের বিচার ও হত্যাকা-ের ঘোর বিরোধী। রসুলুল্লাহ্্র (স) আমলের একটা উদাহরণ দেই। ইহুদীরা আজ নয়, ইসলামের আবির্ভাবের সময় থেকে ইসলামের অবমাননা ও ক্ষতি করার চেষ্টা করে আসছে। এক সময় তারা ঠিক করল একটা মিথ্যা কারণ দেখিয়ে রসুলুল্লাহ্্র (স) প্রিয় মসজিদ মসজিদে নববীতে ঢুকে মসজিদটির অবমাননা ও ক্ষতি করবে। তারা মুসাফির সেজে রসুলুল্লাহ্্র (স) কাছে উপস্থিত হলো। বলল, তারা বহু দূর দেশে যাচ্ছে। একটা রাত্রির জন্য তারা আশ্রয় চায়। রসুলুল্লাহ (স) তখন তাদের মসজিদে নববীতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সাহাবাদের নির্দেশ দেন। তখন মসজিদে ইহুদী খ্রীস্টান সকল ধর্মের লোকের প্রবেশের অধিকার ছিল। (এখনও বহু দেশে আছে)। সাহাবীরা ইহুদীদের মসজিদে রাতে থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা করে দিয়ে বিদায় নিলেন। পরদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে এসে মহানবী (স) এবং সাহাবাদের চক্ষুস্থির। সারা মসজিদ মলমূত্রে ভরা এবং শাবল দিয়ে মসজিদের মিম্বর ভাঙ্গা হয়েছে। পবিত্র মসজিদের এই অবমাননা দেখে সাহাবীরা রোষে ক্ষোভে কোষে তলোয়ার গ্রহণ করেন এবং ঘোড়ায় চড়ে রসুলুল্লাহকে (স) বলেন, ইয়া রাসুল (স) আমরা মসজিদ অবমাননার প্রতিশোধ অবশ্যই গ্রহণ করব। আমরা ঘোড়া ছুটিয়ে অবশ্যই এই শয়তান ইহুদীদের ধরব এবং বিচারের জন্য আপনার পায়ের তলায় এনে হাজির করব। মহানবী তাদের নিরস্ত করলেন। বললেন, ‘তোমরা একটা কথা জেনে রাখো। মসজিদ তোমাদের কাছে পবিত্র। কিন্তু ইহুদী ও খ্রীস্টানদের কাছে পবিত্র নয়। ইহুদীরা এটাকে সাধারণ ঘর-বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের শাস্তি দেয়ার অধিকার তোমাদের নেই।’ মহানবী তার বিদায় হজের ভাষণে (শেষ ভাষণ) মুসলমানদের উদ্দেশ করে বারবার সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন, ‘তোমরা কখনও ধর্ম লইয়া বাড়াবাড়ি করিও না। তোমাদের আগে বহু জাতি ধর্ম লইয়া বাড়াবাড়ি করিয়া ধ্বংস হইয়া গিয়াছে।’ স্বয়ং রসুলুল্লাহ (স) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বারবার তার উম্মতদের সাবধান করে যাওয়া সত্ত্বেও আজ একশ্রেণীর ওয়াহাবি মোল্লারা সারাবিশ্বে ধর্মের নামে হিংসা ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে এককালের শান্তি ও মানবতার ধর্মকে ‘টেররিস্ট ধর্মে’ পরিণত করেছে এবং একশ্রেণীর মুসলমান যুবককে ইসলামিক টেররিস্ট বানিয়েছে। একসময় ইউরোপের শত শত লোক ইসলামের শান্তি ও মানবতার বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছে। আর এখন সেই ইউরোপের মানুষ টেররিস্ট ইসলামের ভয়ে ভীত। বাংলাদেশের বুড়িমারির ঘটনায় দেখা যায়, নিহত যুবক শহিদুন্নবী একজন ভদ্র ও ধার্মিক লোক ছিলেন বলে তার এক আত্মীয় দাবি করেছেন। তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীনতায়ও ভুগছিলেন। এই অবস্থায় দু’একজন গুজব ছড়ালো তিনি কোরানের অবমাননা করেছেন। আর এই গুজবের সত্যাসত্য যাচাই না করেই শত শত লোক ছুটে এসে যুবকটিকে পেটানোর পর দেহে আগুন ধরিয়ে হত্যা করল, এটা কোন সভ্য দেশের প্রশাসনের সহ্য করা উচিত নয়। স্থানীয় প্রশাসন এই ব্যাপারে যা বলেছে তা ঘটনা নিয়ন্ত্রণে তাদের অনিচ্ছা অথবা অক্ষমতার সাফাই ছাড়া আর কিছু নয়। সন্ধ্যার নামাজের সময় কে বা কারা গুজব রটান আর শত শত লোক ছুটে এসে হঠাৎ তাকে মেরে ফেলল, ঘটনাটা মোটেও তা নয়। তাকে মসজিদ থেকে বের করে প্রথমে পেটানো শুরু হয়। তারপর শত শত লোক এসে জোটে। যুবককে ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে আশ্রয় দেয়া হয়। জনতা অফিস ভেঙ্গে ফেলে। এই অফিস ভাঙতেও সময় লেগেছিল। এই সময় স্থানীয় প্রশাসন ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ছুটে এসেছিল। সম্ভবত জন দশ পনেরো পুলিশ এসেছিলেন। পুলিশের এক ওসি একজন আহতকে নিয়ে ছাদের ওপর দিয়ে পালিয়েছিলেন এবং দশজন পুলিশ আহত হয়েছেন- এই হচ্ছে পুলিশের কার্যক্রম। পুলিশ নাকি জনতার ওপর গুলিও ছুড়েছিলেন। তাতে কেউ হতাহত হয়নি। বোঝাই যায় ফাঁকা গুলি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ঘটনাটি যথেষ্ট সময় নিয়ে ঘটেছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের চোখের সামনে এই হত্যাকা-টি ঘটেছে। কিন্তু তা নিবারণে প্রশাসন পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেনি। তাহলে কি স্থানীয় প্রশাসনের মনেও এই গোপন ইচ্ছাটাই কাজ করেছে। ধর্মান্ধ শক্তিকে লোক দেখানো ছাড়া শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে না। কারণ, তাতে ক্ষমতাসীনরা ভোট হারাবেন। এই ভয় যদি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মনেও ঢুকে থাকে এবং এই ভয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারা দেশ পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করে থাকেন, তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবেন। ফ্রান্সে মহানবীর অবমাননা ঘটেছে অভিযোগ তুলে হেফাজত দলের উদ্যোগে ঢাকায় মাদ্রাসা ছাত্রদের যে বিশাল সমাবেশ হয়েছে, তাতে আপত্তি নেই। এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হওয়াতে হেফাজতকে ধন্যবাদ। কিন্তু ওই মিছিল থেকে ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সরকারকে যে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে, তার পেছনে রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ইসলামবিরোধী মন্তব্যের জন্য সউদি আরব থেকে তুরস্কÑ সকল মুসলমান রাষ্ট্র তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু কোন দেশই ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্জনের দাবি তোলেনি, সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। তাহলে একা বাংলাদেশকে কেন ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে? ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ তো ইসলামবিরোধী কোন ভূমিকা নেয়নি। হেফাজতীদের যদি ক্ষমতা ও ইচ্ছা থাকে তাহলে মহানবীর অবমাননার জন্য সারা মুসলিম বিশ্বে ফরাসী পণ্য বর্জনের যে দাবি উঠেছে, সেই দাবি পূর্ণ করার জন্য তারা বাংলাদেশেও ফরাসী পণ্য বর্জনের আন্দোলন সফল করে তাদের প্রকৃত ইসলাম প্রীতি প্রমাণ করেন না কেন? লন্ডন, ৩ নবেম্বর, মঙ্গলবার, ২০২০।
×