ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ আগস্ট ৩ নবেম্বর ও ২১ আগস্ট হত্যার জন্য প্রয়োজন জাতীয় তদন্ত কমিশন

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ৩ নভেম্বর ২০২০

১৫ আগস্ট ৩ নবেম্বর ও ২১ আগস্ট হত্যার জন্য প্রয়োজন জাতীয় তদন্ত কমিশন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মানব ইতিহাসে আরও একটি নিষ্ঠুর ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বাংলাদেশে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট। সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ চলছিল। তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ভাষণ দিচ্ছিলেন। সভার একেবারে শেষ পর্যায়ে এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডৈ ঘটিয়েছিল তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। তাদের পরিকল্পনায় ছিল আওয়ামী লীগের প্রথম সারির সকল নেতাসহ শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। বিধাতার অশেষ ও বিশেষ রহমতে শেখ হাসিনা সেদিন বেঁচে যান। মহান আল্লাহ তায়ালাই সেদিন শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়েছেন। নইলে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। এই হত্যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নবেম্বর ১৯৭৫ জেল হত্যারই ধারাবাহিকতা ও একই সূত্রে গাঁথা। সেদিন জাতির পিতা সপরিবারে হত্যার শিকার হয়েছিলেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক নিজ বাসভবনে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে না থাকায় বেঁচে যান। আর ২০০৪-এর ২১ আগস্ট জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন টার্গেট। উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে চিরতরে ধ্বংস করা। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও সেদিন ২৪ জনকে তারা হত্যা করে। গ্রেনেড হামলায় সেদিন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী নারী নেত্রী আইভি রহমান নিহত হন। প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ সেদিন গুরুতর আহত হন। শরীরে অসংখ্য স্পিন্টার নিয়ে এখনও শত শত নেতাকর্মী ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। এ এক নৃশংস ঘটনা, হৃদয়বিদারক দৃশ্য। এর নজির ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ছাড়া ইতিহাসে আর নেই। বিএনপি-জামায়াত ছিল একটি অশুভ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী ভয়ঙ্কর দানব সরকার। এরা জাতির পিতার হত্যাকারী ইতিহাসের মীরজাফরদ্বয় বেঈমান মোশতাক ও কিলার জিয়ার প্রেতাত্মা। ২১ আগস্ট ২০০৪ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ইতিহাসের জঘন্য চরিত্র খালেদার কুলাঙ্গার সন্তান তারেক জিয়া। জিয়া ও খালেদা জিয়া দুইজনই যথাক্রমে ১৫ ও ২১ আগস্ট এই দুই হত্যার বিচার আইন করে অনেক বছর বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু পাপ বাপকেও ছাড়ে না। বর্তমান সরকার দুই হত্যারই বিচার করেছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ১৫ ও ২১ আগস্ট উভয় হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। জিয়া ১৯৮১ সালে নিহত হওয়ায় তার বিচার করা যায়নি। জীবিত থাকলে অবশ্যই ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যার জন্য তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। বেঈমান, অকৃতজ্ঞ মোশতাকেরও একই অবস্থা হতো। ২১ আগস্ট ২০০৪ হত্যাকাণ্ডের জন্যও তারেক জিয়াসহ প্রায় সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। কিন্তু মূল হোতা তারেক জিয়ার মৃত্যুদ- হয়নি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তারেকেরও মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। কেননা এই কুলাঙ্গারই ২১ আগস্ট হত্যার মূল নায়ক। তার হাওয়া ভবনে বসেই সকল পরিকল্পনা ও চক্রান্ত হয়। তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের মৃত্যুদ- হয়েছে। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। দেশবাসীর প্রশ্ন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর শান্তি হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কেন বিচার হবে না? তিনি তো মৃত্যুবরণ করেননি। সকল তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই ঘটনা খালেদা জিয়ার জ্ঞাতসারেই হয়েছে। পবিত্র সংসদে এই হত্যাকা- নিয়ে আলোচনা করতে দেয়া হয়নি। কোন নিন্দা প্রস্তাবও করতে দেয়া হয়নি। তখনকার নটরিয়াস স্পীকার জমির উদ্দিন সরকার খালেদার নির্দেশে সব ধামাচাপা দেন। খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘উনাকে আবার কে মারতে যাবে? ভ্যানিটি ব্যাগে করে তিনিই গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন।’ আজ যখন সব সত্য প্রকাশিত হয়েছে তখন ম্যাডাম খালেদা জিয়া কি জবাব দেবেন? এই উক্তির জন্যই খালেদা জিয়া যে সেই ঘটনায় জড়িত আছেন তা প্রমাণিত হয়। অবিলম্বে এহেন যাবতীয় দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সকল চরিত্রকে আইনের আওতায় আনা হোক। ইতোমধ্যে এতিমের টাকা আত্মসাতের জন্য খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। উচ্চ আদালত অপরাধের গুরুত্ব বুঝে খালেদা জিয়ার সাজা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলেই বুঝুন কত বড় দুর্নীতিবাজ ও অপরাধী তিনি। প্রকৃতপক্ষে খালেদার ভাইবোন, ছেলেদ্বয়, নিকট আত্মীয়স্বজন প্রায় সকলেই এই দোষে দোষী। এখন সরকারের বিশেষ ক্ষমতায়; প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কৃপায় জামিনে মুক্ত হয়ে জেল হতে ছাড়া পেয়ে নিজ বাসায় বিশ্রামে আছেন। তিনি এমন এক অপরাধী যে, উচ্চ আদালত আইনের কোন ধারাতেই তাকে জামিন দিতে পারেনি। তবে ২১ আগস্ট ২০০৪ গ্রেনেড হামলার বিচারিক কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। এই হত্যার পলাতক আসামিদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এই ঘটনার জন্য তথ্য-প্রমাণাদির আলোকে খালেদা জিয়ারও উপযুক্ত বিচার হতে হবে। আইনের চোখে সবাই সমান। আশা করি বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হত্যা ঘটনায় বিচারপতি জয়নুল আবেদীন যে প্রতিবেদন দিয়েছেন তাও তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। এহেন প্রতিবেদন একজন বিচারপতির পক্ষে কি করে দেয়া সম্ভব? এই প্রতিবেদন অসততা, নীচতা ও মানহীনতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। বিচারক পদের অবমাননার জন্য তারও বিচার হওয়া উচিত। এই হত্যা নিয়ে জজ মিয়া নাটক সৃষ্টি, বিভিন্ন আলামত নষ্ট করা ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতের এক অশুভ চক্রান্ত। বিভিন্ন টকশো, সভা-সমাবেশে কতিপয় পুরুষ ও মহিলা, কতিপয রাজাকার আলবদর দালালের সন্তানরা যেভাবে উচ্চৈঃস্বরে বক্তব্য উদগীরণ করেন তাতে সন্দেহ হয় এরা কি বাঙালী না পাকিস্তানী? এহেন চরিত্রগুলো সভ্য না অসভ্য বুঝতে কষ্ট হয়। রাজাকার চখা মিয়ার সন্তান, স্বাধীনতাবিরোধী এহেন বিভিন্ন চরিত্রের সন্তানেরা ফ্রি স্টাইলে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার মূল্যবোধ, জয় বাংলার অমিততেজ স্লোগান ইত্যাদি চিন্তা করলে মনে হয় আওয়াজ তুলি একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। খতম করি সব দালাল, আলবদর, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারকে। বিচারক পদটি একটি ন্যায়দ-, ন্যায়পরায়ণতা ও সততার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান। এই পদে নিয়োগের জন্য সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, দেশপ্রেম ও শিক্ষাগতযোগ্যতা অত্যন্ত মানসম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়, একান্ত অপরিহার্য। এজন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার একটি উপযুক্ত মাপকাঠি নির্ধারণ। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সততা, নিষ্ঠা ও অন্যান্য যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি তার অসততার জন্য একসঙ্গে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তিনি এখন বিদেশে পলাতক। এহেন অপবাদ অতীতে আর কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠেনি। তার ১৯৭১ সালের ভূমিকা কি ছিল তাও তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। তাই বিচারপতি নিয়োগে আরও যতœবান হতে হবে। এ পদে নিয়োগের জন্য উপযুক্ত নিয়োগবিধি সময়ের দাবি। উচ্চমানসম্পন্ন সর্বোচ্চ শিক্ষাগতযোগ্যতা, নীতি-নৈতিকতা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। দশ বছরের ওকালতির অভিজ্ঞতা যথার্থ হতে পারে না। বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের বিধিমালা, শর্তাবলী এখানেও পূরণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। তার ওপর অন্য গুণাবলী সন্নিবেশ আবশ্যক। এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের গভীর মনোনিবেশ প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোন জয়নুল আবেদীন বা এস কে সিনহার মতো চরিত্র এই পদের ধারে কাছেও আসতে না পারে। অতএব সকলকে সজাগ হতে হবে। বিচার বিভাগকে কলুষমুক্ত রাখতে হবে। ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে আইনের শাসন ও সুশাসন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধে উদ্ভাসিত হোক প্রশাসন। আগামী প্রজন্মের প্রতি আবেদন, তোমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে অনুধাবন কর। স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিকে, জোটকে বর্জন কর। এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, বন্ধুত্ব করা, আত্মীয়তা করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাহলে রক্ত দূষিত হতে বাধ্য। এই অপশক্তি ও তাদের দোসরদের স্তব্ধ করতে পারলেই ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। আবহমান বাংলার প্রবহমান গতিধারায় রচিত হবে এক স্বপ্নসুখের বাংলাদেশ। জাতির পিতার আজীবনের স্বপ্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়নও সম্ভব হবে। সরকারের কাছে আবেদন, অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট ও ৩ নবেম্বর জেল হত্যার জানা-অজানা সকল কুশীলবকে আইনের আওতায় আনা হোক। তদন্ত কমিশন সকল হত্যার নেপথ্য কারিগরদের বের করে আনবে এবং সকল ষড়যন্ত্র উন্মোচন করবে। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ চিরঞ্জীব হবে। তাই প্রস্তাব করতে চাই উচ্চ আদালতের স্বাধীনতার সপক্ষের ন্যায়নিষ্ঠ কোন বিচারপতিকে প্রধান করে একটি শক্তিশালী জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। আশা করি সরকার এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সচিব
×