ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ জেলহত্যা ॥ ১৯৭৫

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ৩ নভেম্বর ২০২০

বাংলাদেশ জেলহত্যা ॥ ১৯৭৫

‘আর্মিরা যা চায় সেটা কর’-জেলারকে রাষ্ট্রপতি মোশতাক। জেলখানায় কলঙ্কজনক অধ্যায়। পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়া গৃহবন্দী। ২৪ ঘণ্টা পর এনএসআই প্রধান মন্ত্রিসভায় জেলহত্যার ঘটনা জানান। ক্ষুব্ধ শাফায়াত জামিল তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম ও ওবায়দুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যেমন করে সমগ্র জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের ঘাতকেরা, একইভাবে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বর রাতে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর আক্রমণ করে তাদের এদেশীয় দোসররা। এর মধ্য দিয়ে তারা হত্যা করার চেষ্টা করেছিল স্বাধীন স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাকা-ের মধ্য দিয়েই সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়টি জেলখানায় রচনা করল ঘাতকরা। ১৯৭৫ সালের ২ নবেম্বর মধ্যরাতে অর্থাৎ, ৩ নবেম্বর প্রথম ভাগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে জলপাই রঙের একটি পিকআপ এসে থামে। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা। ঢাকা তখন এক অস্থির নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। রাত পৌনে দুইটার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার আমিনুর রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে আসতে বলেন। দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে আমিনুর রহমান দেখতে পান, একটি সামরিক পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছে। জিপ থেকে নেমে আসেন সেনাবাহিনীর সশস্ত্র চার সদস্য। এদের একজন রিসালদার মোসলেম কারাগারের জেলারকে জানান, ফারুক ও রশিদ তাদের পাঠিয়েছেন। তারা জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে নিয়ে যেতে চান। এসময় মূল ফটকের সামনে সেনা সদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন। কাগজে রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে জাতীয় চার নেতাকে জেলখানা থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে জেলার আমিনুর রহমান খুব ভয় পেয়ে যান। এটা জেল কোডের পরিপন্থী বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু রিসালদার মোসলেম নাছোড়বান্দা। তিনি বঙ্গভবনে ফোন করতে চান। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। সেখান থেকে রিসালদার মোসলেম বঙ্গভবনে ফোন করেন। ফোন ধরেন কর্নেল রশীদ। তিনি জেলারকে ফোনটি দিতে বলেন। আমিনুর রহমান যখন টেলিফোনের কানে তুললেন, ‘তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন আইজি সাহেবের সঙ্গে।’ রশীদ সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি মোশতাককে দেন। তখন আমিনুর রহমান দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দেন। আইজি দৌড়ে এসে ফোন ধরেন। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।’ এই হুকুমের ফলে কারাগারে প্রবেশের অধিকার পেয়ে যায় চার ঘাতক। এবার ঘাতকরা তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার নেতাকে একত্রিত করার আদেশ দেয়। এ আদেশ শুনে কারা মহাপরিদর্শন ও জেলার একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। একপর্যায়ে কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন। সে চারজন হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের নিউ জেলের ১ নম্বর সেলে ছিলেন। পরবর্তী সেলে ছিলেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে তাজউদ্দীনের সেলে আনা হলো। তাজউদ্দীন আহমেদ তখন কুরআন শরীফ পড়ছিলেন। সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হাত-মুখ ধুলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আনার সময় ওনারা কেউ জেলারকে জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেয়া হচ্ছে? জেলার শুধু তাদের বললেন, ‘আর্মি আসছে।’ চারজনকে যখন একটি কক্ষে একত্রিত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগছিল, তখন সেনা সদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছিল। এ প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনুর রহমান বলছিলেন, ‘যতদূর আমার মনে পড়ে, মনসুর আলী সাহেব বসা ছিল সর্ব দক্ষিণে। আমি মনসুর আলীর ‘ম’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই, সঙ্গে সঙ্গে গুলি।’ খুব কাছ থেকে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান। তাজউদ্দীনের পেটে ও হাঁটুতে গুলি লাগে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের পরও দীর্ঘ সময় তিনি বেঁচে ছিলেন। তাজউদ্দীন বেঁচে আছেন বিষয়টি এক বিহারী কারারক্ষী দেখতে পায়। সে দৌড়ে গিয়ে ঘাতকদের এ কথা জানালে ঘাতকরা পুনরায় এসে সেলের মধ্যে প্রবেশ করে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে চার নেতার। চার নেতা হত্যা মামলার চার্জশিটে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে- ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর রাত ৪টা থেকে ৫টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়। এ সময় হত্যাকারীরা দুবার কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। একবার ভেতরে গিয়ে গুলি করে চলে আসে। দ্বিতীয়বার কারা অভ্যন্তরে গিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে। অর্থাৎ তারা গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে চার জাতীয় নেতাকে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ঘাতকরা কারাগারে প্রবেশ করে রাত ৪টায় আর বের হয়ে যায় ৫টা ৩৫ মিনিটে। এই দীর্ঘ সময়ে নির্বিঘেœ হত্যাকা- সংঘটিত করে এবং পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে যায় কোন প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই। মধ্যরাতে কারাভ্যন্তরে এমন নৃশংস এক হত্যাকা- সংঘটিত হলেও বাইরের পৃথিবীর কেউ তা জানল না। এমনকি সেলের মধ্যেই সকাল ১০টা পর্যন্ত লাশগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। ১০টার পর কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসকরা সেলে প্রবেশ করেন। সেখানেই লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করেন ম্যাজিস্ট্রেট আজমল হোসেন চৌধুরী ও মিজানুর রহমান। এরপর ময়না তদন্ত সম্পন্ন করেন সিভিল সার্জন ডা. ফয়েজউদ্দিন মিয়া ও কারা ডাক্তার রফিক উদ্দিন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ডা. পোদ্দার ও ডা. মনোয়ার উল্লাহ। তাদের ময়না তদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্টেও বলা হয়, গুলিবর্ষণ করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। কারাগারের ভেতর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেননি। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার কারাগারের খোঁজ নেয়ার জন্য সারাদিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। পরের দিন অর্থাৎ, ৪ নবেম্বর পুরনো ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে জানান যে, তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন। প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি ২০১০ সালে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘৪ নবেম্বর বিকেল চারটার দিকে খবর আসতে শুরু করল তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যার ঘটনার সঙ্গে জেল হত্যাকাণ্ডের একটি যোগসূত্র আছে। তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লে. কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে ২০১০ সালে তিনি বলেছেন, তখন সেনাবাহিনীতে নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পরিণতি ছিল জেলখানার হত্যাকা-। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছিল ৩ নবেম্বর। সেটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ। আমিন আহমেদ চৌধুরীর মতে, ৩ নবেম্বরের অভ্যুত্থানটি ছিল অনিবার্য। কারণ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা তখন বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পরিচালনা করছিলেন। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কম্যান্ডের আওতায় আনার জন্য ৩ নবেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন জেনারেল চৌধুরী। তা ছাড়া শেখ মুজিব হত্যাকা-কেও তারা মেনে নিতে পারছিলেন না বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর ভেতরে আবারও চেন অব কমান্ড ভাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। খালেদ মোশাররফের অনুগত সৈন্যরা বন্দী করে সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে। ঢাকা সেনানিবাসে যখন এ অবস্থা চলছিল, সে সময় পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে জেলখানায় আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতাকে হত্যা করা হয়। চার জাতীয় নেতা হত্যা মামলার চার্জশীট থেকে হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা থেকে এ কথা পরিস্কার যে, হত্যাকারীরা জাতিকে অসহায় করার জন্য খুব দ্রুতই হত্যাকা-টি সংঘটিত করে। ভোরের অন্ধকারে নির্জনে ঘাতকরা নেতাদের হত্যা করে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যে রকম সমগ্র জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘাতকরা, পঁচাত্তরেও একইভাবে ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বর রাতে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও গণতন্ত্রিক চেতনার ওপর আক্রমণ করে। সে সময় তারা প্রকৃত পক্ষে হত্যা করার চেষ্টা করেছে স্বাধীন স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটি। পার্টিও পেলেন না, সংসদ পেলেন না মোশতাক- অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পরই এই নেতৃবৃন্দকে দলে ভেড়াতে টোপ দিয়েছিলেন মোশতাক। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের খুঁজে বের করে তাদের কাছে দূত পাঠাতে লাগলেন। কেবল চিরশক্র তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া তিন নেতাকেই মোশতাক মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলেন। মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের আহ্বান জানালেন। মোশতাকের ধারণা ছিল শান্ত প্রকৃতির সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং নরম মানুষ কামারুজ্জামান হয়ত তার কথা শুনবেন। জাতীয় চার নেতা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে কীভাবে টোপ দেয়া হয় তার একটি বিবরণ অধ্যাপক আবু সাইয়িদের ‘জেল হত্যাকাণ্ড’ গ্রন্থে বর্ণনা করা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেই মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করেন তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের সঙ্গে। তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহবুবুল আলম চাষীসহ আরও কতিপয় উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বৈঠকেই ঠিক করা হলো যে, মোশতাক সরকারকে অবশ্যই আওয়ামী লীগ দলীয় বিশিষ্ট প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও সংসদ সদস্যদের আনুগত্য লাভ করতে হবে। আলোচনার এক পর্যায়ে তাহের ঠাকুর বললেন, ‘আমার মনে হয় প্রেসিডেন্ট সাহেবই ঠিক করবেন কাকে কাকে নিয়ে তিনি একটি বেস্ট টিম গঠন করতে পারবেন।’ ঠাকুরের এ কথায় কর্নেল ফারুক রহমান বলে উঠল, ‘স্যার, লিস্টটা চূড়ান্ত করার আগে আমরা যেন একটু দেখতে পাই।’ এ কথায় সবাই ফারুকের দিকে একবার তাকালেন। মোশতাক চকিত হেসে জবাব দিলেন, ‘তা তো অবশ্যই।’ খোন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের খুঁজে বের করে তাদের কাছে দূত পাঠাতে লাগলেন। অবশ্য যাদের তিনি মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, এদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছাড়া আর কারও কাছ থেকে তিনি তেমন কোন উদ্যোগ পাননি। সবাই যেন কেমন নিষ্প্রাণ, যন্ত্রচালিত। কেবল অতিউৎসাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ উল্লাহ। এ অবস্থায় ১৭ আগস্ট ওবায়দুর রহমান মনসুর আলীকে মোশতাকের কাছে নিয়ে গেলেন। মোশতাক তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের আহ্বান জানালেন। মনসুর আলী তার কোন জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মোশতাকের মুখের দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থাকলেন। মোশতাক তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী দেখছেন অমন করে?’ মনসুর আলী বললেন, ‘দেখছি তোমাকে, আর ভাবছি বঙ্গবন্ধুকে। মোশতাক, তুমি শেখ মুজিবকে হত্যা করলে, করতে পারলে’, আবেগে-উদ্বেগ-কান্নায়-ঘৃণায় বুজে এলো তার কণ্ঠ। খোন্দকার মোশতাক আহমদ এম মনসুর আলীকে ১৭ আগস্ট দেখা করিয়ে সে ছবি ও সংবাদ ১৮ আগস্ট পত্রিকায় প্রকাশ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করারও অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন কোনদিন মোশতাককে মেনে নেবেন না, এটা তিনি জানতেন। মোশতাক বুঝলেন, মনসুর আলীকেও পাওয়া যাবে না। তার ইঙ্গিতে ওবায়দুর রহমান মনসুর আলীকে নিয়ে গেলেন। ওবায়েদ তাকে বলেছিলেন, ‘মনসুর ভাই, আপনি সব প- করে দিলেন। রাজনীতিতে আবেগের স্থান নেই, এটা আপনার জানা কথা। আপনি প্রেসিডেন্টের কথায় রাজি হলে ভাল হতো।’ মনসুর আলী সেদিন ওবায়েদকে আর কোন জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ২২ আগস্ট গ্রেফতার হয়ে ঢাকা জেলে যাওয়া পর্যন্ত মনসুর আলী ছিলেন বেইলি রোডের বাড়িতে নজরবন্দী। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মোশতাকের চিরশত্রু। ১৯৭৪ সালের নবেম্বরে তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে সরানো এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ ছাড়া করার পেছনে মোশতাকের ষড়যন্ত্র সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর মোশতাক তাজউদ্দীনের বাড়িতে সশস্ত্র প্রহরা মোতায়েন করে নজরবন্দী করে রেখেছিলেন তাকে। তাজউদ্দীন কোনদিন মোশতাককে মেনে নেবেন না, এটা তিনি জানতেন। তাই তার কাছে যাননি বা কাউকে পাঠাননি। মোশতাকের ধারণা ছিল শান্ত প্রকৃতির সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং নরম মানুষ কামারুজ্জামান হয়ত তার কথা মানবেন। তাদের কাছে যখন তাহের ঠাকুর ও শাহ মোয়াজ্জেমকে পাঠানো হলো নূরে আলম সিদ্দিকীসহ তখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আমার আর কোন সরকারী পদের দরকার নেই। মোশতাককে বল আমাকে ছেড়ে দিতে। আমি ময়মনসিংহ চলে যাব। আর ক’দিনই বাঁচব। একটু অবসর জীবন কাটাতে চাই।’ আর কামারুজ্জামানের জবাব ছিল, ‘পার্টির আর সব লোক না গেলে আমিই বা যাই কী করে? তার চেয়ে বাকি কটা দিন এমনি থাকি।’ মোশতাক দেখলেন এখানেও ব্যর্থ। তাই তিনি ক্ষেপে গেলেন। ১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট তাদের চার জন এবং কোরবান আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ মোট ১৯ জনকে তিনি জেলে পাঠালেন। তারপর চেষ্টা চালালেন পার্টির অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদকে দলে টানার। কিন্তু তারাও ছিলেন অনমনীয়। জিল্লুর রহমান জানালেন, ‘এটা হতে পারে না।’ আবদুর রাজ্জাকের জবাব ছিল, ‘আমি যাব না। আমাকে বিরক্ত করবেন না। যা খুশি করতে পারেন।’ তোফায়েল আহমদ জানালেন, ‘আমি যাব না। আমার কথা বাদ দিন। আমার আর দরকার নেই।’ ফলস্বরূপ ৯ সেপ্টেম্বর তাদের তিনজনকে গ্রেফতার করে নেয়া হলো পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। সেখানে তোফায়েলের কাছ থেকে মোশতাকের প্রতি সমর্থনসূচক বিবৃতি লাভের জন্য মারধর করা হলো। কিন্তু কেউ বিবৃতি দিলেন না। পরে জিল্লুর-রাজ্জাককে কুমিল্লা এবং তোফায়েলকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ ‘যে বেদনা চিরদিন বইতে হবে’ শীর্ষক এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ২৩ আগস্ট আমাকে এবং জিল্লুর রহমানকে (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) বঙ্গভবনে খুনী মোশতাকের কাছে ই এ চৌধুরী নিয়ে যান। ই এ চৌধুরী তখন ডিআইজি এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান। সেখানে আমাদের ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং খুনি খোন্দকার মোশতাক সরকারকে সমর্থনের জন্য প্রচ- চাপ সৃষ্টি করা হয়। আমরা যখন কিছুতেই রাজি হইনি, তখন খুনি মোশতাক ভীতি প্রদর্শন করে ইংরেজীতে বলেন, You are walking on grave. If somebody enter your house and killed you, nobody will take responsibility. খুনী সরকারের সপক্ষে সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে আমাদের বাসভবনে ফিরিয়ে দেয়। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে ৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। আমি, জিল্লুর ভাই, রাজ্জাক ভাই (প্রয়াত শ্রদ্ধেয় নেতা) ও আবিদুর রহমান (তৎকালীন ‘দ্য পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক)-এই চার জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রাখে। সেখানে প্রায় ৩০ জন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা পুলিশ কন্ট্রোল রুম ঘিরে রাখে। প্রত্যেক দিন আমার ওপর সেনা সদস্যরা দুর্ব্যবহার করে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের বন্দীদশা থেকেই একদিন খুনীচক্র আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেদিন রাতে আমি এবং রাজ্জাক ভাই একটি কক্ষে একসঙ্গে ঘুমাচ্ছিলাম। জিল্লুর রহমান ও আবিদুর রহমান আরেকটি কক্ষে ছিলেন। হঠাৎ একদিন রাত তিনটার দিকে মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার আমাদের কক্ষে ঢুকেই চিৎকার করে বলে, ‘হু ইজ তোফায়েল’, ‘হু ইজ তোফায়েল’। রাজ্জাক ভাই আমার আগে জেগে ওঠেন এবং আমাকে দেখিয়ে দেন। আমাকে দেখেই তারা আমার বুকে স্টেনগান চেপে ধরে। খুনীরা চোখ এবং দু’হাত পিছমোড়া করে বেঁধে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কোথাও নিয়ে যায়। অনুমান করি এটি রেডিও স্টেশন। পরে জেনেছি স্থানটি রেডিও স্টেশনই ছিল। সেখানে নিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। চোখবাঁধা থাকায় ইন্টারোগেশনকালে কারা প্রশ্ন করেছিল বুঝতে না পারলেও খুনী ডালিমের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট চিনতে পেরেছি। ডালিম বলছিল, ‘শেখ মুজিব মেজর ডালিমকে ভালবাসত। কিন্তু শেখ মুজিব আমাকে আর্মি থেকে ডিসমিস করেছে।’ ‘Sheikh Mujib he is to loved Dalim very much, but he has been dismissed me from the army and Mr. Tofail you.’ বলেই সে বাঁ হাত দিয়ে আমাকে ঘুষি মারতে থাকে। তার ডান হাত নষ্ট ছিল। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। সে যে বাঁ হাত দিয়ে ঘুষি মেরেছে আমি তা অনুমান করি। বেহুঁশ অবস্থায় আমাকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে দিয়ে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করতে থাকি। তখন রাজ্জাক ভাই, জিল্লুর ভাই আমার শুশ্রƒষা করেন। সন্ধ্যার দিকে আমাকে, আবিদুর রহমান, রাজ্জাক ভাই এবং জিল্লুর ভাই-এই চারজনকে সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নাম-ধাম লিপিবদ্ধ করে সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ আমাদের চার জনকে জেলগেটে নিয়ে আবিদুর রহমান এবং আমাকে ময়মনসিংহ এবং রাজ্জাক ভাই ও জিল্লুর ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে প্রেরণ করে। পার্টির নেতাদের না পেয়ে মোশতাক তখন দলীয় সংসদ সদস্যদের পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। হুইপ আবদুর রউফকে নির্দেশ দেয়া হলো শেরেবাংলা নগর ও নাখালপাড়ার সংসদ সদস্য ভবনের সদস্যদের সংগঠিত করার জন্য। বলা হলো, ১৬ অক্টোবর বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের একটি বৈঠক আহ্বান করেছেন প্রেসিডেন্ট। সদস্যরা যেন তাতে যোগদান করেন। এদিকে দিনাজপুরের সিরাজ, পাবনার অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সিরাজগঞ্জের সৈয়দ হায়দার আলী, বগুড়ার হাসান আলী ও মোজাফফর, মোস্তাফিজ পটল, রাজবাড়ীর ডা. এসএ মালেক, নোয়াখালীর হানিফ ও বেলায়েত, মানিকগঞ্জের কামাল, মাগুরার আসাদুজ্জামান, এখলাছ, নওগাঁর জলিল, ফেনীর তালেব আলী, কুমিল্লার কামাল মজুমদার ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালালেন যেন সংসদ সদস্যরা না যান। বেগম সাজেদা চৌধুরী বৈঠকে না যাবার পক্ষে ছাত্র-যুব নেতাদের উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে দেখা গেল ১৬ অক্টোবর মোশতাক আহূত বঙ্গভবনের বৈঠকে যে সংখ্যক সদস্য উপস্থিত হয়েছেন তার মধ্যেও মোশতাকের রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে বৈধতা তোলা হয়েছে। সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে এ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সরকার নিযুক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) নেতৃত্বে সংসদ সদস্যরা খোন্দকার মোশতাকের প্রেসিডেন্ট পদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করে তাকে খুনী হিসেবে অখ্যায়িত করেছিলেন। সেদিন মোশতাক বুঝলেন তার পায়ের তলায় মাটি নেই। জাতীয় চার নেতার ৩ জনই তার প্রস্তুাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। এমনকি জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদকে দলে টানতে ব্যর্থ হলেন। বঙ্গভবনের গুটি কয়েক সংসদ সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে উল্টো তার রাষ্ট্রপতির পদের বৈধতা প্রশ্নের মুখোমুখি হলো। মোশতাক বুঝলেন তার পায়ের তলায় মাটি নেই। পার্টি পেলেন না, সংসদও নেই। ফলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে জেলহত্যার মতো কলঙ্কজনক সিদ্ধান্তের দিকে গেলেন। পাল্টা অভ্যুত্থানের সূচনা- পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় ছিল। সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ। তখন ঢাকা সেনানিবাসে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এসব ঘটনাপ্রবাহ বেশ কাছ থেকে দেখেছেন। তার সে অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় : ১৯৭৫-৮১’ শিরোনামে। ওই বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন, শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা তখন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে পরিচালনা করছিলেন। তখন বঙ্গভবনের থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটা সংঘাত চলছিল সেনানিবাসের উর্ধতন কিছু সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে। খন্দকার মোশতাক যে বেশি দিন টিকবেন না, তা নিয়েও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছিল। তখন আবার সিনিয়র অফিসারদের মধ্যেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল। চলবে... লেখক : সাংবাদিক
×