ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শুরু হলো জাদুঘর ও চিড়িয়াখানায় বেড়ানো

সব যেন নতুনের মতো কৌতূহলী চোখে দেখা জয় করার আনন্দ

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২ নভেম্বর ২০২০

সব যেন নতুনের মতো কৌতূহলী চোখে দেখা জয় করার আনন্দ

মোরসালিন মিজান ॥ না, শঙ্কা এখনও কাটেনি বরং শীত আসছে। আঘাত হানতে পারে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। তবু নিউ নর্মাল সময়ে থেমে থাকার আর সুযোগ কোথায়? বাস্তব বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। অনেক কিছুই বেশ আগেভাগে খুলে দেয়া হয়েছিল। তবে বাকি রয়ে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ দু’টি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। একটি জাদুঘর। অন্যটি চিড়িয়াখানা। সাধারণ সময়ে উভয় প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। করোনাকালে সেটা আর সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে রবিবার থেকে খুলে দেয়া হলো জাতীয় জাদুঘর ও জাতীয় চিড়িয়াখানা। উন্মুক্ত করে দেয়া হলো দর্শনার্থীদের জন্য। এগুলো খুলে দেয়ার সঙ্গে দর্শনার্থীদের পেটের ক্ষুধার বিশেষ যোগ নেই। নেই বটে। ঘরে বসে থেকে থেকে ক্লান্ত সাধারণ মানুষের মানসিক অবসাদ দূর করতে ঠিকই ভূমিকা রাখছে। এর আগে দেশে করোনা সংক্রমণের একেবারে গোড়ার দিকে গত ২০ মার্চ বন্ধ ঘোষণা করা হয় শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর। ৬৬ দিন পর দাপ্তরিক কাজের জন্য অফিস খুলে দেয়া হলেও, দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ ছিল জাদুঘরের দরজা। সেখানে গিয়ে জনশূন্য এক বিরান ভূমি দেখা গেছে শুধু। ভাবলে অবাক হতে হয়, এভাবে কেটে গেছে ২২০ দিন! আর তার পর সীমিত পরিসরে খুলে দেয়া। দর্শনার্থী সংখ্যা খুব বেশি বাড়তে দেয়া হয়নি। এর পরও কৌতূহলী মানুষের পদচারণায় যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল জাদুঘরের গ্যালারিগুলো। প্রথম দিন জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, একেবারেই নতুন ছবি। রাস্তার ধারে যে টিকেট কাউন্টার, সেটি বন্ধ। আগের মতো টিকেটের জন্য কেউ সেখানে ঝুঁকে নেই। আগে থেকে অনলাইনে টিকেট সংগ্রহ করে এসেছিলেন সবাই। জাদুঘর ক্যাম্পাসে ঢুকতেই প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছিল। মুখে মাস্ক পরা আছে কিনা, লক্ষ্য করা হচ্ছিল। তার পর স্বয়ংক্রিয় জীবাণুনাশক টানেল। মূল ভবনের গেটে দুটি টানেল স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো হয়ে গ্যালারিতে প্রবেশ করছিলেন দর্শনার্থীরা। মোট ৪৫টি গ্যালারি। সবই খুলে দেয়া হয়েছিল। নিদর্শন বা গ্লাসশোকেসের সামনের মেঝেতে তিন ফিট পর পর সদ্য রং করা বর্গাকার টাইলস। দেড় ফিট বাই দেড় ফিট টাইলসে পা রেখে দাঁড়ানো ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নির্দেশনা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে এ নির্দেশনা মেনে চলছিলেন দর্শনার্থীরা। শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতিই বেশি চোখে পড়েছে। এদিন নয় বছরের স্কুলপড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে জাদুঘর পরিদর্শনে এসেছিলেন জুঁই। তরুণী মাতা বলছিলেন, আমার মেয়ের স্কুল সেই কবে বন্ধ হয়েছে আর খুলছেই না। প্রথম প্রথম মেয়েও খুশিই ছিল। এখন টায়ার্ড। বাইরে বের হতে চায়। তাই জাদুঘর দেখাতে নিয়ে এসেছি। জাদুঘরের উঁচু কারুকাজ করা খাট-পালঙ্ক মেয়ের খুব পছন্দ হয়েছে বলে জানান তিনি। বড়দের কৌতূহলও কম মনে হয়নি। জাদুঘরের অস্ত্রশস্ত্র গ্যালারিতে অনেকেই লম্বা সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের একজন রুবেল। মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা যুবক বললেন, জাদুঘর দেখার শখ ছিল। চিন্তা করে আসি। হয় না। এবার করোনার মধ্যে হাতে সময় ছিল। তাই দেখলাম। এত বড় আর ভারি তরবারি কী করে আগেকার মানুষ চালাত তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করছিলেন তিনি। পাথর কেটে বানানো প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিও কৌতূহল নিয়ে দেখছিলেন অনেকে। প্রস্থর, টেরাকোটা ও ব্রোঞ্জে তৈরি মূর্তিগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগৃহীত। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শতকের ভাস্কর্য বঙ্গদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দর্শনার্থীদের অবশ্য ইতিহাসে অত মন ছিল না। দৃশ্যমান সৌন্দর্য দেখেই খুশি তারা। আগে একাধিকবার জাদুঘর ঘুরে দেখেছেন নিজ গ্রামে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা ফজলে রাব্বি। আগে ঢাকায় থাকতেন। এখন বাইরে। স্ত্রী ও দুই সন্তান সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। বললেন, সব ঠিক আছে। তবে মাস্ক পরে এত লম্বা গ্যালারি হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। এর পরও জাদুঘর খুলে দেয়ার পক্ষে মত দিলেন তিনি। বললেন, করোনা কবে যাবে তা তো কেউ বলতে পারছে না। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু সচল রাখার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। জাদুঘরের কীপার শিহাব শাহরিয়া জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন জাদুঘর পরিদর্শনে আসতেন ৩ থেকে ৪ হাজার দর্শনার্থী। তবে করোনাকালে সংখ্যাটি অত হবে না বলেই ধারণা। তদুপরি জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সংখ্যাটি ৫০০ থেকে ৮০০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। প্রথম দিনে সেটা সম্ভব হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের চাপ বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত দেবে বলে জানান তিনি। নতুন সময় অনুযায়ী, বন্ধের দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে জাদুঘর। একই দিনে দর্শনার্থীদের জন্য জাতীয় চিড়িয়াখানা খুলে দেয়া হলে সেখানেও মোটামুটি উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন বয়সী মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। দেখেই বোঝা যায় এ দিনটির জন্য প্রতীক্ষা করে ছিলেন তারা। ৮ মাস পর খোলা চিড়িয়খানার পরিবেশও অনেকখানি বদলে গেছে। ভেতরটাকে নতুন বাগানের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গাছের গোড়ায় রং করা হয়েছে। ওয়াকওয়েতেও নতুন রঙের কাঁচা গন্ধ। জায়গায় জায়গায় বেসিন। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। বন্ধের সময় খাঁচাগুলোরও যত্ন নেয়া হয়েছে। ফলে ঠিকঠাক চেহারা। যথেষ্ট দূরে থেকে পছন্দের প্রাণী দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অধিক উপস্থিতি ছিল জিরাফ, জেব্রা, বানর, হরিণ, বাঘ ও সিংহের খাঁচার সামনে। এখানে ছোটদের সংখ্যা অনেক বেশি। অরিত্রী নামের এক কিশোরী এসেছিল শ্যামলী থেকে। বাবা-মায়ের সঙ্গে আসা। বলল, আমাকে ঘর থেকে বের হতেই দেয় না। আজকে চিড়িয়াখানায় এসে অনেক হরিণ আর বানর দেখেছি। ওর কথায় নয়, চোখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করা যাচ্ছিল আনন্দটা। এ যেন করোনার বাধাকে জয় করার আনন্দ! হারিস নামের মাঝবয়সী এক দর্শনার্থী এসেছিলেন একাই। বললেন, মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। চিড়িয়খানা খোলা শুনে দেখতে চলে এলাম। বাঘটাগ দেখলাম। করোনার ভয় কাজ করে না? জানতে চাইলে তার জবাবÑ করোনাকে আগে ভয় পেতাম। এখন আর পাই না! এদিকে, দারুণ খবর দিলেন চিড়িয়াখানার দায়িত্বশীলরা। জানালেন, করোনাকালে চিড়িয়াখানায় জন্ম নিয়েছে ১১৬ নতুন প্রাণী। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৮টি চিত্রা হরিণ, একটি মায়া হরিণ, একটি জিরাফ, দু’টি জলহস্তি, দু’টি ইম্পালা, দুটি গাধা। জেনে আরও ভাল লাগল যে, এই ক’দিনে ২৩টি ময়ূরের জন্ম হয়েছে। অন্য অতিথিদের মধ্যে রয়েছে ১৩টি ইমু, ৩০টি বক, সাতটি ঘুঘু ও ১৫টি কবুতর। চিড়িয়াখানার কিউরেটর আবদুল লতিফ বলছিলেন, বন্ধের সময়টাতে প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণেই এত শাবক উপহার পাওয়া গেছে। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছিলাম আমরা। বেশিরভাগ দর্শনার্থী তা মেনেই পরিদর্শন করেছেন। এটা আশার কথা। তবে আগের মতো খুব বেশি দর্শনার্থী আপাতত ঢোকানো যাবে না। আগে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ আসতেন। এখন সংখ্যাটি ২ হাজারের মধ্যে রাখা হবে। বয়স্কদের আমরা নিরুৎসাহিত করছি। তিনি উল্লেখ করেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকছে বিশেষ ছাড়। প্রতিমাসের প্রথম রবিবার বিনামূল্যে জাতীয় চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করতে পারবেন আগ্রহীরা। সব মিলিয়ে নিউ নর্মাল শুরুটা মন্দ হয়নি বরং আশা জাগিয়েছে। এভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে- বার্তা দিচ্ছে জাতীয় জাদুঘর ও চিড়িয়াখানা।
×