ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংক থেকে বের হওয়ার সময় ডিবি পরিচয়ে হামলা

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ১ নভেম্বর ২০২০

ব্যাংক থেকে বের হওয়ার সময় ডিবি পরিচয়ে হামলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্যাংকে ডাকাতি চক্রের সদস্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ রকমই একটি চক্রের হোতারা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক পরিচালক এস এম কামরুজ্জামানকে মারধর করে ৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। তিনি ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা তুলে বের হবার সময় এই চক্রের সদস্যদের হামলা ও ছিনতাইয়ের শিকার হন। ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওরা একটি প্রাইভেটকারে তুলে নেন সাবেক ওই সরকারী কর্মকর্তাকে। এর পর প্রাইভেটকারের ভেতর কৃষি অধিদফতরের সাবেক ওই কর্মকর্তাকে মারধর করে ব্যাংক থেকে তোলা পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ধামরাইয়ের রাস্তায় ফেলে দিয়ে পালিয়ে যান ডিবি পুলিশ পরিচয় দেয়া চার ছিনতাইকারী। পরে কামরুজ্জামান মোহাম্মদপুর থানায় এসে মামলা করেন। পুলিশের তদন্তে নেমে নকল ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাত-ছিনতাইকারী চক্রের তিন সদস্য প্রতীক খান, আহমেদ শিকদার উজ্জ্বল ও সুলতানুল মাহীদ পিয়াসকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে দু’জন ৫ অক্টোবর ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। পরে আদালতে প্রতিবেদনে পুলিশ জানায়, ভুয়া ডিবি ও র‌্যাব পরিচয় দিয়ে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যাংকের সামনে অবস্থান করেন। এমনকি ব্যাংকের ভেতরে তাদের সদস্য থাকে। সেখান থেকে মোবাইলের মাধ্যমে তাদের সদস্যদের জানিয়ে দেয়। পরে কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বের হবার পরই ছিনতাই চক্রের শিকার হন। পরে ডিবি-র‌্যাব পরিচয়ে ভুক্তভোগীদের তুলে নিয়ে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোঃ সাহিদুল ইসলাম জানান, গত ১৬ সেপ্টেম্বর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক পরিচালক কামরুজ্জামানকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ইতোমধ্যে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা ভয়ঙ্কর সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী-ডাকাত দলের সদস্য। তাদের মধ্যে কয়েকজন ২০ বছর ধরে ছিনতাই-ডাকাতি করে আসছে। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে খুন, ডাকাতিসহ নানা অভিযোগে ডিএমপিতে মামলা রয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় এই চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই চক্রের বাকিদের গ্রেফতারে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মামলার তদন্তকারী এই কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকের ভেতর ছিল ছিনতাইকারীদের একজন। একটি ফ্ল্যাটের কিস্তির টাকার জন্য কামরুজ্জামান গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে মোহাম্মদপুর পূবালী ব্যাংকে ৫ লাখ টাকা তোলার জন্য লাইনে দাঁড়ান। টাকা তোলার সেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের সদস্য সুলতানুল মাহীদ ওরফে পিয়াস। এসআই সাহিদুল ইসলাম জানান, চক্রের সদস্য পিয়াস সেদিন ব্যাংকের টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। একই লাইনে ছিলেন ভুক্তভোগী কামরুজ্জামান। তিনি যখন পাঁচ লাখ টাকা তোলেন তখন পেছনে এসে পিয়াস চক্রের অন্য সদস্যদের ফোন দেন। সাবেক সরকারী কর্মকর্তা কামরুজ্জামানের পরনে কী আছে, সে তথ্য তার সহযোগীদের জানিয়ে দেন ব্যাংকের ভেতরে থাকা ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য পিয়াস। টাকা তোলার পর কামরুজ্জামান যখন ব্যাংক থেকে বের হন তখন ছিনতাইকারী চক্রের বাকি সদস্যরা তাকে একটি প্রাইভেটকারে তোলেন। ডিবি পুলিশের পোশাক পরে ছিনতাইকারী সেদিন কামরুজ্জামানকে ধাক্কা দিয়ে একটি প্রাইভেটকারে তুলে নেন। ভুক্তভোগী কামরুজ্জামান পুলিশকে জানায়, ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা তুলে বের হবার সময় অদূরে ডিবির পোশাকে চারজন আমাকে ঘিরে ধরে। তখন তারা আমাকে বলে, আপনার নামে মামলা আছে? আমি বললাম, কিসের মামলা। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। তখন আমাকে ধাক্কা দিয়ে সোজা গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে এবং আমার চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর গাড়ির পেছনের অংশে উপুড় করে ফেলে রাখে। আমাকে মারধর করে। আমার কাছে থাকা পাঁচ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক পরিচালক সাহিদুল ইসলাম জানান, আমার কপাল ভাল, আমি এই ভয়ঙ্কর অপরাধীদের হাত থেকে বেঁচে এসেছি। তিনি জানান, গাড়িতে তোলার পর আমি হাত-পায়ে ধরে ভুয়া ডিবির সদস্যদের বলেছিলাম, আমাকে তোমরা মেরে ফেলো না। আমার কাছে যে টাকা আছে, তা আমি দিয়ে দিচ্ছি। যে এক ঘণ্টা আমি এই অপরাধীদের হাতে বন্দী ছিলাম, তখন খুব ভয় হচ্ছিল। ওরা আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল। আমার পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এরপর আমাকে ধামরাইয়ের একটি রাস্তায় ফেলে দেয়ার পর আমি স্বস্তি পাই। আমি প্রাণে বেঁেচ গেছি। তিনি জানান, সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক হিসেবে অবসরে যান। রাজধানীর আসাদগেট এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি । একটি ফ্ল্যাটের কিস্তি দেয়ার জন্য সেদিন তিনি ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা তোলেন। কাছে থাকা ব্যাগের ভেতর চার লাখ টাকা রেখেছিলেন। বাকি এক লাখ টাকা রেখেছিলেন প্যান্টের ভেতর। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোঃ সাহিদুল ইসলাম জানান, ভুক্তভোগী কামরুজ্জামানের ঘটনা জানার পর প্রথমে পূবালী ব্যাংকের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ফুটেজ দেখে একজনের গতিবিধি সন্দেহ হয়। পরে ওই ব্যক্তির ছবি সংগ্রহ করে তাঁর ঠিকানা খোঁজা শুরু করি। পরে কামরুজ্জামানের দেয়া তথ্য ভিত্তিতে মোহাম্মদপুর থেকে ধামরাই পর্যন্ত ২৪০টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেটকারের নম্বর জোগাড় করা হয়। সেই সূত্র ধরে প্রথমে একজন গাড়িচালককে আটক করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সাহিদুল ইসলাম জানান, ওসব সিসিটিভি ফুটেজ দেখে প্রথমে ব্যাংকের সন্দেহভাজন ব্যক্তির ঠিকানা বের করি। আর গাড়িচালকের তথ্যের সূত্র ধরে ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রতীক খান ও আহমেদ শিকদার উজ্জ্বলকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ধরা হয় সুলতানুল মাহীদ পিয়াসকে। গ্রেফতারকৃত ডাকাত ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য প্রতীক খানের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার নতুন কাহেলা গ্রামে। পরিবার নিয়ে তিনি মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরি রোডে বসবাস করেন। চার বছর আগে প্রতীকের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় অস্ত্র মামলা হয়। এর আগের বছর ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা হয়। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা আছে। আর গ্রেফতারকৃত আহম্মেদ শিকদার উজ্জ্বলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ দুটি মামলা রয়েছে। অপর আসামি পিয়াসের বিরুদ্ধেও মাদক মামলা আছে। মামলা তদন্তকারী পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত প্রতীক, শিকদার ও পিয়াসের ঢাকায় নিজেদের বাড়ি রয়েছে। প্রতীক ১০ বছর ধরে ছিনতাই-ডাকাতি করে আসছেন। এই চক্রের প্রধান মামুনসহ তিনজন পলাতক। প্রত্যেকে ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত। আদালতে প্রতিবেদনে জমা দিয়ে পুলিশ বলছে, ভুয়া ডিবি ও র‌্যাব পরিচয় দিয়ে চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন থেকে ছিনতাই ও ডাকাতি করে আসছেন। ভুয়া ডিবি ও র‌্যাব পরিচয় দিয়ে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যাংকের সামনে অবস্থান করেন। এমনকি ব্যাংকের ভেতরে তাদের সদস্য থাকে। সেখান থেকে মোবাইলের মাধ্যমে তাদের সদস্যদের জানিয়ে দেয়। পরে কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বের হবার পরেই ছিনতাই চক্রের শিকার হন। পরে ডিবি-র‌্যাব পরিচয়ে ভুক্তভোগীদের তুলে নিয়ে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেন।
×