ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৈরী সময়ের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানো থিয়েটার

কঠিনতর নাট্যযুদ্ধ, চ্যালেঞ্জ করেই সামনে চলা

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১ নভেম্বর ২০২০

কঠিনতর নাট্যযুদ্ধ, চ্যালেঞ্জ করেই সামনে চলা

মোরসালিন মিজান ॥ সময়টা কী যে বৈরী! কোভিডের ঘায়ে জীবন প্রায় তছনছ। একই কারণে আলো নিভে গিয়েছিল মঞ্চের। অভিনয়ের ক্ষুধা নিয়ে শিল্পীরা একরকম ছটফট করছিলেন। থিয়েটার এমনিতেই কঠিন। সাম্প্রতিককালে আরও কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাতে কী? প্রতিকূল সময়ের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল নাটক। ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল হল। এগিয়ে এলেন নাট্যপ্রেমী দর্শকও। তাতেই দেখা মিলল প্রাথমিক সাফল্যের। বর্তমানে নিউ নর্মাল চর্চা নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। ক্রমে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে মঞ্চগুলো। বহু আগে সেই মার্চে হানা দিয়েছিল করোনা। তখন থেকেই ছন্দপতন। দ্রুতই সবকিছু বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। জীবনের শঙ্কা। তাই বন্ধ রাখতে হয় নাটকও। শিল্পকলা একাডেমির তিন তিনটি হলের আলো একসঙ্গে নিভে যায়। যে হল পেতে দলগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি চলে, সেই হল শূন্য পড়ে থাকে মাসের পর মাস। একাডেমির মূল ফটকে বড় তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এমনকি খোলা চত্বরের ঘাস লম্বা হতে থাকে। এমন পরিত্যক্ত চেহারার শিল্পকলা একাডেমি আগে কেউ কোনদিন দেখেনি। তবে ৬৬ দিন পর সরকার সাধারণ ছুটি বাতিল করলে বিভিন্ন সেক্টর ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে। প্রস্তুতি নিতে থাকেন নাট্যকর্মীরাও। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চর্চা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়। সবাই নয়, কোন কোন দল এ চিন্তা থেকে মাঠে নামতে শুরু করে। আগস্ট থেকে শুরু হয় নিউ নর্মাল নাট্যচর্চা। করোনাকালের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নাট্যকর্মীদের পাশে ছিল মহিলা সমিতি। উর্বর এ মঞ্চই নিউ নর্মাল সময়ে নাট্যচর্চার নতুন সুযোগ করে দেয়। সত্তরের দশকে ঢাকার থিয়েটার যখন হাঁটি হাঁটি পা পা তখন এ মঞ্চ কতভাবে যে নাট্যকর্মীদের সহযোগিতা করেছে! কোভিডের কালেও অভিন্ন ভূমিকায় পাওয়া গেল মহিলা সমিতিকে। এখানে গত ২৮ আগস্ট মঞ্চস্থ হয় ‘লাল জমিন’ নাটকটি। একক অভিনয়ের নাটক দিয়ে নব সূচনা করেন মোমেনা চৌধুরী। শূন্যন রেপার্টরি দলের নাটক। মান্নান হীরা রচিত নাটকের নির্দেশনা দেন সুদীপ চক্রবর্তী। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নেই একক নাটক বেছে নেয়া। মঞ্চে এদিন আর কেউ ছিলেন না, মোমেনা চৌধুরী ছাড়া। দর্শকের আসন বিন্যাসেও দেখা যায় বড় পরিবর্তন। মাঝখানে দুটি আসন ফাঁকা রেখে বসার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে আগতদের সবাই নাটক উপভোগের সুযোগ পাননি। মোমেনা চৌধুরী বলছিলেন, আমরা তো দর্শকের জন্যই নাটক করি। তাদের উপস্থিতি যত বেশি হয় ততই ভাললাগে আমাদের। কিন্তু করোনার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তাই একই নাটকের একাধিক শো করছি আমরা। এর ফলে যারা একটি শো মিস করছেন তারা পরেরটি দেখতে পারছেন। একক অভিনযের পর ১১ সেপ্টেম্বর মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় জাগরণী থিয়েটারের নাটক ‘রাজার চিঠি’। একই মঞ্চে ১৮ সেপ্টেম্বর নাটক নিয়ে আসে প্রাঙ্গণেমোর। ‘আওরঙ্গজেব’ মঞ্চস্থ করে তারা। প্রায় একই সময় অভিনব নাট্যমেলার আয়োজন করে প্রাচ্যনাট। স্বীকৃত কোন মঞ্চে নয়, দলটি নিজেদের মহড়া কক্ষেই নাট্য প্রদর্শনীর আয়োজন করে। অভিনব আয়োজনের নাম দেয়া হয় মহলা মগন উঠান নাটকের মেলা। ৪ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া মেলা চলে মাসজুড়েই। মোট পাঁচটি নাটক মঞ্চস্থ হয় এ সময়। নাটকগুলোর মধ্যে ছিল ‘দ্য জু স্টোরি’, ‘দ্য ডাম্প ওয়েটার’, ‘হানড্রেড বাই হানড্রেড’, ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ ও ‘ফাউস্ট অথবা অন্য কেউ’। ৩ অক্টোবর শেষ হয় নাট্যমেলা। এখানেও দুই সিট ফাঁকা রেখে আসনবিন্যাস করা হয়। মাত্র ২০ জন দর্শক সামনে রেখে পুরো নাটক অভিননীত হতে দেখা যায়। এই ২০ জনের একজন হয়ে উপস্থিত ছিলেন নাট্যদল সুবচনের অভিনেতা ও পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহাম্মদ গিয়াস। তিনি বলছিলেন, সময় যতই চোখ রাঙাক, এর বিরুদ্ধে ফাইটটাও তো শুরু করতে হবে। আমাদের দল এখনও নাটকে ফিরতে পারেনি। প্রাচ্যনাট পেরেছে। তাদের উৎসাহ দেয়া জরুরী। পাশাপাশি অন্য দলগুলোকেও নাটকে ফেরার পথ খুঁজে বের করতে হবে। প্রদর্শনীতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সে পথ খুঁজেছেন বলে জানান তিনি। বাইরে থেকে শুরু হয়ে যাওয়ায় চাপ অনুভব করে শিল্পকলা একাডেমিও। সরকারী প্রতিষ্ঠানে তিন তিনটি হল। গত ২৩ অক্টোবর হলগুলো নাটকের জন্য খুলে দেয়া হয়। এদিন সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় পালাকারের নাটক ‘উজানে মৃত্যু’। পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ছিল জাগরণী থিয়েটারের নাটক ‘রাজার চিঠি’। বাদ যায়নি স্টুডিও থিয়েটারও। এর পর থেকে চলমান আছে প্রদর্শনী। এখানেই শেষ নয়, করোনাকালে ঢাকার মঞ্চে এসেছে নতুন প্রযোজনাও। চ্যালেঞ্জের দ্বিতীয় ধাপটি অতিক্রম করে দেখিয়েছে ঢাকা থিয়েটার। সদ্যজাত নাটকের নাম ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার।’ নাটকটি রচনা করেছেন আনন জামান। নিদের্শনা দিয়েছেন শহিদুজ্জামান সেলিম। শুক্র ও শনিবার জাতীয় নাট্যশালায় নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে দেখা যায়, টিকেট কাউন্টারের সামনে সেই পুরনো লাইন। আগের মতো অতো দীর্ঘ নয়। তবে দর্শক কম ছিল ভাবলেও ভুল হবে। সীমিত উপস্থিতি পরিবেশটিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে গড়ে নিয়েছিল। মঞ্চের চেনা মুখগুলো একে অন্যকে দেখে পরস্পরের পানে ছুটে যাচ্ছিল। কত গল্প জমা হয়েছে! জাতীয় নাট্যশালার সামনের খোলা চত্বরে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বসে সেসব গল্প হচ্ছিল। নাটক শুরুর বেলটি বাজার আগে খুলে দেয়া হয় দ্বার। অপেক্ষায় থাকা দর্শক একে একে প্রবেশ করতে থাকেন। গেটে প্রত্যেকের তাপমাত্রা মাপা হয়। হাতে স্প্রে করা হয় জীবাণুনাশক। ভেতরে দুটি করে আসন ফিতা দিয়ে প্যাঁচিয়ে নেয়া হয়েছে। সেগুলো বাদ দিয়ে বসার ব্যবস্থা। সেভাবেই বিক্রি করা হয়েছিল টিকেট। কিন্তু বড় দলের নতুন নাটক যেহেতু, আমন্ত্রিত অতিথিরাও উপভোগ করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তাই দুই আসনের দূরত্ব কমে এক আসনের হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট ধরে চলে মঞ্চায়ান। নাটক শুরুর আগে রচয়িতা আনন জামান জানিয়েছিলেন, বেশ আগে এটি লেখা হয়েছিল। অথচ দেখে মনে হলো ঠিক এই মুহূর্তের সৃষ্টি! মহামারী এবং মহামারী কালের আত্মোপলব্ধি নাট্যভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। এদিন নাটক দেখতে এসেছিলন বর্ষীয়ান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। এমন দুর্যোগের দিনে কেন বাইরে এলেন? জানতে চাইলে তার জবাব : নাটক তো শুধু নাটক নয়। নাটক জীবনের কথা বলে। মহামারীকালে যে নবনাট্য আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে যোগ দিতে এসেছি বলতে পারেন। প্রবীণ অভিনেতা দুহাতে গ্লাভস পরে এসেছিলেন। মুখে ছিল ডাবল মাস্ক। সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সবকিছু করতে হবে। নাটকও। এদিকে তারও আগে থেকে নাটক শুরুর আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ঢাকা থিয়েটার প্রধানের যুক্তি ছিল, সবই তো চলছে। তাহলে নাটক কেন হবে না? আর তার পর শনিবার জানা গেল, তিনি নিজেও করোনা আক্রান্ত! হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার মানে, কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোতে হবে থিয়েটারকে। নাসির উদ্দীন ইউসুফের ভাষায় : মৃত্যু জরা ব্যাধি অতিক্রম করে সহ¯্র বৎসরের মানুষের নির্ভীক যাত্রায় আমাদের নাট্য প্রয়াস জীবনেরই জয়গান। হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে।
×