ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়

চুরির পর বদলে যাচ্ছে গাড়ির রং ও ব্র্যান্ড

প্রকাশিত: ২২:৪২, ১ নভেম্বর ২০২০

চুরির পর বদলে যাচ্ছে গাড়ির রং ও ব্র্যান্ড

আজাদ সুলায়মান ॥ চুরির পর গাড়ি বিক্রি করাটাও নিরাপদ নয় চোরের কাছে। তাই চোরাই গাড়ির ব্র্যান্ড ও রং পরিবর্তন করে অনায়াসে বিক্রি করা সম্ভব। এছাড়া পুড়ে যাওয়া কিংবা দীর্ঘদিনের পুরনো গাড়ি সস্তায় কেনার পরও একইভাবে বদলে ফেলা হচ্ছে ব্র্যান্ড। কম দামীর গাড়িকে বেশি দামে বিক্রির জন্য এভাবে ব্র্যান্ড বদলে দিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সম্প্রতি কামাল (৪৫) নামের এক দুর্ধর্ষ গাড়ি চোরকে ধরার পর এ ধরনের অবিশ্বাস্য কাহিনী বেরিয়ে আসে। বিআরটিএর একশ্রেণীর অসাধু কর্মচারী ও কর্মকর্তার যোগসাজশে বেরিয়ে আসে চক্রের উত্থান কাহিনী। ওই অফিসের একটি ক্যান্টিন মালিক থেকে কামাল পরিণত হয়েছে ভয়ঙ্কর গাড়ি চোরে। তবে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার তা খ-ন করে বলেন, সিআইডি মামলার তদন্ত করছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করবও। তবে এ ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। যদি বিআরটিএর কেউ জড়িত থাকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ জানিয়েছে-গাড়ি চুরি যেমন বেড়েছে উদ্ধারও বেড়েছে সমানতালে। চোরাই গাড়ি উদ্ধার করাটা খুবই জটিল বিষয়। তুবও বিভিন্ন গ্যারেজে অবৈধ মডিফিকেশন ও সহজে কাগজপত্র জালিয়াতি করার সুবাদে গাড়ি চুরির ঘটনাটা ঘটছে। গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে চুরি একটি প্রাইভেটকার নাটোর থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। বর্তমানে আগের চেয়ে গাড়ি চুরির ঘটনা কিছুটা কমে এসেছে। চুরি হওয়া প্রচুর গাড়ি উদ্ধার করেছে ডিবি। এজন্য আলাদা টিম কাজ করছে। জানা গেছে- গাড়ি চুরির পর এ কায়দায় বদলে ফেলার সঙ্গে জড়িত এমন কজনের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। একটি চোরাই গাড়ির উদ্ধারের পর সিআইডির একটি জানতে পারে ব্র্যান্ড বদলানোর কৌশল। এ বিষয়ে বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান বলেন- চক্রটি পুরনো মডেলের গাড়ি নিলামে কিনে বা চুরি করে তা মডিফাই করে চট্টগ্রামের একটি গ্যারেজে। এরপর কাগজপত্র বানিয়ে সেটা বিক্রি করে। আমরা গত সপ্তাহে রাজধানীর শাহ আলী থেকে একটি চক্রকে গ্রেফতার করি। এসময় একটি টয়োটা এলিয়ন ব্র্যান্ডের গাড়ি জব্দ করা হয়। কিন্তু ওটার ভেতর ছিল মূলত টয়োটা প্রবক্সের চেসিস। আগের গাড়ির চেসিসের ওপর এলিয়ন ব্র্যান্ডের বডি বসানো হয়েছে। গাড়িটির মাঝ বরাবর কাটা আছে। যা খালিচোখে ধরা পড়বে না। আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি এ ধরনের কাহিনী।। এলিয়ন গাড়িটি প্রবক্সের চেসিস নম্বর ও কাগজপত্র দিয়ে চলছিল। বিআরটিএ থেকে চক্রটি গাড়ির কাগজপত্র তৈরি করেছে। মালিকানাও বদলেছে একাধিকবার। জানাা গেছে- এ চক্রের মূল কামাল হোসেন বিআরটিএ চত্বরে পরিচালিত একটি ক্যান্টিনের পরিচালক। ওখানকার কজন দালাল ও কর্মচারীর মাধ্যমে অবৈধ গাড়ির কাগজপত্র তৈরির সুযোগ পায়। যাদের কাজই হচ্ছে অবৈধ গাড়ির বৈধ কাগজ তৈরি করে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন দেয়া। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক একটি গাড়ির ব্র্যান্ড বদলানোর কাহিনী সম্পর্কে কামাল সিআইডিকে জানিয়েছে মতিঝিলের এ কে খান এ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের গাড়ি পুড়ে গেলে সেটা নিলামে বিক্রি করা হয়। গাড়িটি কিনে নেয় কামাল। তারপর একটি চোরাই গাড়িতে প্রতিস্থাপন করা হয় ওই গাড়ির চেসিস। ওই কোম্পানি থেকে বছর সাতেক আগে একটি টয়োটা প্রবক্স ব্র্যান্ডের সাদা রঙের পুড়ে যাওয়া গাড়ি বিক্রি করা হয়। যার চেসিস নম্বর-এনসিপি৫১-০৭১৩০ ও ইঞ্জিন নম্বর-আইএনজেড-সি৯০৯৭৪৫। কিন্তু ওই গাড়ির চেসিস ও অপর একটি চোরাই গাড়ির বডি ব্যবহার করে কামাল হোসেন টয়োটা এলিয়ন করে ফেলে। কিভাবে এত সহজে ব্র্যান্ড বদল করা সম্ভব হয় জানতে চাইলে সিআইডির এক কমর্ককর্তা জানান- কামাল বিআরটিএর বেশ প্রভাবশালী। সেখানে তার একটি ক্যান্টিন থাকায় সবাই তার ওখানে খাওয়া দাওয়া করেন। দালাল থেকে কর্তাব্যক্তি সবাই তার ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারাই পথ বাতলে দেন। মূলত তারাই চোরাই গাড়ি মডিফাই করার ক্ষেত্রে সহায়তায় করেন। এই কামালের বিরুদ্ধে আগেও গাড়ির কাগজপত্র জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। থানায় দুটি মামলাও রয়েছে। কিছুদিন আগে মোবাইল কোর্ট তাকে দুই মাসের সাজাও দিয়েছিল। সিআইডি জানতে পেরেছে- জালিয়াতি করে কামাল হোসেন অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। তার সম্পদের খোঁজখবর নিচ্ছি। তার আরও যত গাড়ি আছে সেগুলোর কাগজপত্র যাচাই করা হচ্ছে। এছাড়া নিজের কটা গাড়ি রেন্ট এ কার হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়। এ বিষয়ে সিআইডি ও চুরি ডিবির একাধিক সূত্র জানিয়েছে প্রতি বছর শুধু রাজধানীতে গড়পড়তায় ৪ থেকে ৫শ’ গাড়ি চোরাই হয়। এর কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বেশিরভাগই থেকে যায় অজানা। গাড়ির চেসিস, রং ও ব্র্যান্ড এত নিখুঁতভাবে বদলে দেয়া হয়- মালিকের সামনে দিয়ে ঘুরলেও ধরা সম্ভব নয় এটা তার গাড়ি। গ্রেফতারের পর কামাল অপকটে স্বীকার করেছে-চুরির পর গাড়িটা চলে যায় নির্ধারিত গ্যারেজে। সেখানে খুলে ঠিকঠাক করা হয় চেসিস। ঝালাই করে অস্পষ্ট করে দেয়া হয় সিরিয়াল নম্বর। তারপর অপেক্ষায় থাকে- কখন মিলবে একটা চোরাই গাড়ি। পাওয়া গেলেই শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের কাজ। পুরনো ভাঙাচোরা গাড়ির কাগজপত্র অনুযায়ী নতুন গাড়ির ভোল বদলানো হয়। প্রয়োজনে কেটেকুটে আবার জোড়াতালিও দেয়া হয়। বদলানো হয় রং। বসানো হয় পুরনো গাড়ির চেসিস। খালি চোখে ধরার সাধ্য থাকে না যে ওটা ছিল চোরাই গাড়ি। এখানেই শেষ নয়। এরপর ক্রেতা ঠিক হলে কাগজপত্র ও মালিকানা পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকে। বিআরটিএর সঙ্গে সম্পর্কের জোরে সেটাও হয়ে যায় রাতারাতি। অর্থাৎ কয়েকদিনের ব্যবধানে পুরনো গাড়ি ও চোরাই গাড়ি মিলেমিশে হয়ে যায় নতুন গাড়ি। এতদিন পর কেন তাকে ধরা হলে জানতে চাইলে সিআইডি সূত্র জানায়- অপর এক গাড়ি চোরকে ধরতে গিয়ে সন্ধান মিলে কামালের। প্রথমে রমনা থানার একটি গাড়ি চুরির মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এক মলম পার্টির সদস্যকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে শাহ আলী থানার নবাবের বাগে একটি চোরাই গাড়ির সন্ধান পায় সিআইডি। গত ২১ সেপ্টেম্বর গাড়িটি জব্দ করা হয়। এরপর বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করালে গাড়িটি চোরাই বলে নিশ্চিত হয় সিআইডি। চোরাই গাড়ি জেনেও গাড়িটি কেনেন আবু কালাম নামের এক ব্যক্তি। তাকেও গ্রেফতার করে সিআইডি। তার সূত্র ধরেই গ্রেফতার হন কামাল হোসেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে যাবতীয় তথ্য।
×