ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানির জ্বালানি তেল সরাসরি খালাসে নির্মাণ হচ্ছে ভাসমান টার্মিনাল ও ডাবল পাইপ লাইন

সমুদ্রবক্ষে চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ৩০ অক্টোবর ২০২০

সমুদ্রবক্ষে চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প ছাড়াও এবার গভীর সমুদ্রে এবং সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে চ্যালেঞ্জিং একটি প্রকল্প। আমদানির জ্বালানি তেল নিয়ে আর নয় লাইটারিং। জাহাজ থেকে পাইপ লাইন দিয়ে সরাসরি তেল খালাস হবে দেশের একমাত্র তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) এবং তিন তেল বিপণন কোম্পানির ডিপোসমূহে। বিপিসি সূত্রে জানানো হয়েছে, সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয়ে আমদানির জ্বালানি তেল খালাসে নির্মিত হচ্ছে ভাসমান তেল টার্মিনাল ও ২২০ কিলোমিটারব্যাপী ডাবল পাইপ লাইন। যুগ যুগ ধরে আমদানির জ্বালানি তেল বহির্নোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে ব্যয়বহুল লাইটারিং প্রক্রিয়ার অবসান ঘটাতে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে বিদেশী অর্থঋণ সহায়তায় আগামী ২০২২ সাল নাগাদ এ প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) বছরে ৮শ’ কোটি টাকারও বেশি অর্থের সাশ্রয় হবে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের ৫৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিশ^জুড়ে করোনা আতঙ্ক নিয়ে কয়েকমাস এ কাজ ধীরগতি থাকলেও বর্তমানে পুরোদমে আবারও শুরু হয়েছে। শুরুর দিকে ২০২১ সাল নাগাদ এ প্রকল্প চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা পিছিয়ে ২০২২ সালকে টার্গেটে আনা হয়েছে। দেশে চাহিদার জ্বালানি তেলের পুরোটাই আমদানি নির্ভর। প্রতিবছর আমদানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিদেশ থেকে বিশেষ করে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল মাদার ভেসেলযোগে গভীর সমুদ্রে (কুতুবদিয়ার অদূরে) পৌঁছানোর পর তা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) লাইটার জাহাজযোগে খালাস করা হয়ে থাকে। কখনও এক লাখ আবার কখনও এক লাখ টনেরও বেশি তেল নিয়ে আসা মাদার ভেসেলগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর এলাকার অনেকটা শেষপ্রান্তে অর্থাৎ কুতুবদিয়ার অদূরে নোঙ্গর করতে হয়। কারণ প্রয়োজনীয় গভীরতা না থাকার কারণে এসব মাদার ভেসেল চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় প্রবেশ করতে পারে না। ফলে কুতুবদিয়ার অদূরে নোঙ্গরকৃত মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজযোগে প্রতিনিয়ত তেল খালাস করে তা চট্টগ্রামের পতেঙ্গার অয়েল ডিপোতে পৌঁছানো হয়। এসব ডিপো থেকে পরবর্তীতে নৌ ও সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তেল পৌঁছে যায়। প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল হওয়ায় ২০১১ সালের দিকে বিপিসির উদ্যোগে এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আমদানির জ্বালানি তেল খালাসে বিপুল অর্থের ব্যয় সাশ্রয়ে ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একনেকে এ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। বিপিসি সূত্রে জানানো হয়, দেশে আমদানির অপরিশোধিত ও পরিশোধিত জ্বালানি তেলের কার্যক্রম আরও সহজতর ও গতিশীল করার লক্ষ্যেই সমুদ্রবক্ষে ভাসমান টার্মিনাল ফ্যাসিলিটিজ বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আবার সে টার্মিনাল থেকে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে ডাবল পাইপ লাইন নির্মাণেরও প্রস্তাব করা হয়। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সরকার এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। ডাবল পাইপ লাইনের একটিতে আসবে ডিজেল ও অপরটিতে আসবে ক্রুড অয়েল। ডাবল পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি (ইআরএল) ও তিনটি তেল বিপণন কোম্পানি, যথাক্রমে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার প্রধান ডিপোসমূহে এ তেল পৌঁছে যাবে। এ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময়ের লাইটারিং কাজের অবসান ঘটবে এবং এতে করে বিপিসির বছরে ৮শ’ কোটি টাকারও বেশি অর্থের সাশ্রয় ঘটবে। এছাড়া বর্তমানে ১ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েলের একটি মাদার ভেসেল থেকে খালাস কার্যক্রমে সময় নেয় ৯ থেকে ১১ দিন। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দু’দিনে এক লাখ টন এবং ২৮ থেকে ৩০ ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন তেল খালাস হয়ে যায়। বিপিসি সূত্র মতে এতে অপারেশনাল দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬০ লাখ টনেরও বেশি। এর পুরোটাই আমদানি নির্ভর। একদিকে এ তেল আমদানিতে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার অর্থ চলে যায়। তেমনিভাবে খালাস কার্যক্রমেও বিপুল অর্থ ব্যয় হয়ে আসছে। প্রতিটি মাদার ভেসেলের ভাড়া ছাড়াও লাইটার জাহাজের ভাড়া খাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় বিপিসিকে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে বিপিসিকে ভর্তুকি দিতে হয়। আর কমলে বিপিসির মুনাফা হয়। এভাবে বছরের পর বছর বিপিসির কার্যক্রম চলে আসছে। সারাদেশে সরকার তেলের বিক্রয়মূল্যে ফিক্সড প্রাইজ রেখেছে। গভীর সমুদ্রে ভাসমান টার্মিনাল থেকে পাইপ লাইনযোগে প্রথমে তেল আসবে মহেশখালীতে নির্মিতব্য ইনস্টলেশনে। সেখান থেকে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে আনোয়ারা উপজেলার কোরিয়ান ইপিজেড হয়ে পরবর্তীতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপ লাইন সংযুক্ত হবে ইআরএল ও তিন তেল কোম্পানির পতেঙ্গার ডিপোতে। বর্তমানে এ প্রকল্পের ৫৪ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে বুধবার বিপিসি সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। গভীর সমুদ্রের সি বেড (তলদেশ) থেকে দুই মিটার এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশ থেকে ৯ মিটার নিচে ডাবল পাইপ লাইন বসানোর কাজ চলছে। এ কাজে বিদেশী অর্থঋণ ছাড়াও সরকার এবং বিপিসির কোষাগার থেকে প্রকল্প ব্যয় মেটানো হচ্ছে। চীনের কারিগরি একটি সংস্থা এ প্রকল্প কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সূত্র জানায়, এ প্রকল্পটি সরকারের মেগা প্রকল্পের আওতায় না থাকলেও এটি একটি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। কেননা, উত্তাল সমুদ্রের মাঝে ভাসমান তেল টার্মিনাল নির্মাণ এবং সেখান থেকে সমুদ্র ও নদীর তলদেশ দিয়ে ডাবল পাইপ লাইন দিয়ে আমদানির জ্বালানি তেল খালাস কার্যক্রম সহজ কোন বিষয় নয়। কিন্তু বিপুল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি বাস্তবায়ন শুরু করা যায়নি। পরবর্তীতে চীন সরকারের আগ্রহে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ খুলে দেয়। ২২০ কিলোমিটারের ডাবল পাইপ লাইন ও মহেশখালীতে ইনস্টলেশন পয়েন্ট প্রতিষ্ঠার কারণে দেশে আরও প্রায় পনেরো দিনের তেলের মজুদ রাখার ব্যবস্থায় বৃদ্ধি ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
×