ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পবিত্র মুখোপাধ্যায়

কবিতার বরপুত্র

প্রকাশিত: ২১:২১, ৩০ অক্টোবর ২০২০

কবিতার বরপুত্র

‘প্রকৃত কবিতা কিছু সুবাতাস এনে দেয় শস্যের উপরে’ ‘প্রকৃত কবিতা থাকে শুভ কামনার মতো জন্মে ও বিদায়ে।’ খুব গভীরভাবে অনুভব করলে কবিতাকে তো এভাবেই দেখি ও পাই আমরা। আমার কবিতা থেকে পঙ্ক্তি দুটি উদ্ধার করলাম ভাল, প্রকৃত কবিতা পড়ার আনন্দ বা বিষাদকে উপভোগ করবার পর যে অনুভব হলো, তা বুঝিয়ে দেয়ার প্রয়োজনে। কাকে বোঝাব, আর কেনই-বা বোঝাব? আদৌ কি প্রকৃত কবিতা পড়ার স্বাদ অন্যকে প্রবন্ধ লিখে বোঝানো সম্ভব? এ তো অনুভবের বিষয়, একা একা, নিজের মতো করে বুঝে নেয়া। বিমল গুহর কবিতা পড়ার পর খুব মনে পড়ল ‘প্রকৃত কবিতা’ শীর্ষক তিনটি আমার কবিতার কথা। জন্মে ও বিদায়ে কবিতা যদি সঙ্গী হতে না পারে, তবে তার সার্থকতা কি? নিবিড় ভাব ও ভাবনাকে শব্দাবিষ্ট করে রাখার ক্ষমতা অর্জন করতে হয় কবিকে। তাই, বার বার অমোঘ সত্য বলে মনে হয়- ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ বিমল গুহর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছিল এই সেদিন, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। কিন্তু মানুষটি সর্বাঙ্গীণ কবি, মনে হয়েছিল আমার। আজকাল এ বাংলা অনেকের পদ্য পড়ি, উত্তর আধুনিক পদ্য পড়ছি। কেন এসব লেখা, কার জন্য, বোঝা কঠিন। প্রতিভা না থাকলে প্রগল্ভতা আসতে বাধ্য। তাকেই কবিতা বলে চালাতে চাওয়াই স্বাভাবিক। ওসব পড়ে তা-ই মনে হয়। ‘বাতাস পাহাড়কে নাড়াতে পারে না প্রেম পাহাড়কে নাড়ায় আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখে রক্ত গোলাপ ফুটে আছে’ এ হলো কবির অন্তর্গত অনুভবের ভাষা। ‘মেঘের আড়াল ভেঙ্গে মাঝে মধ্যে তোমার চোখের মতো উজ্জ্বলতর জ্যোৎস্ন্য নেমে আসে’, এ রকম নিবিড় অনুভবের কবিতা বিমল গুহকে চিহ্নিত করে একজন প্রকৃত কবি বলে। ভাষা যেমন সহজ, অনুভব তেমনি গভীর; সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়, পাঠককে আবেশগ্রস্ত করে। চমক নেই, সাংবাদিকতার এক মাত্রিকতা নেই। দ্বিমাত্রিক কবিতা বিমল অনায়াসে লিখতে পারেন। বাংলাদেশের কবিতায় প্রকৃতির উপস্থিতি সংরক্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। নদ-নদী, মুক্ত আকাশ, গাছপালা, পশুপাখি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নানা চিত্রধর্মিতায় উপস্থিত হয় স্বাভাবিকভাবেই। বিমলের কবিতায়ও বাংলার মাটি সোঁদা গন্ধ টের পাই। ‘এখন বসন্তকাল বারান্দায় নুয়ে আছে সকালের রোদ আলোর শিশুরা এসে খেলা করে পাতার আড়ালে। শীতের আমেজ কেটে বিদায়ী সন্ধ্যায় শরীরের মোড়া ভাঙে নগর পালের পোষা চাঁদ দীর্ঘ গ্রীবা তুলে উঁকি দেয় জ্যোৎস্নার ভঙ্গিতে।’ বিমল গুহর কবিতা থেকে এ রকম অনেক উদ্ধৃতি দেয়া যায়। বাংলার মাটি ও মানুষ চমৎকার সহজিয়া অনুভবে উঠে এসেছে নানা কবিতায়, নানা ভঙ্গিতে। বিমল আরও লিখুন। কারও কারও কাছে এ রকম দাবি করার ইচ্ছে হয়, আপনি লিখুন। আপনারই তো লেখার কথা। একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎই। একবার কলকাতার বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের কর্নারে কবিপত্র-এর স্টলের সামনে পার্থদার সঙ্গে দেখা। স্বভাবলাজুক পার্থ বসু, আনন্দবাজার-এ টুকরো খবরের জনপ্রিয় কলমের লেখক পার্থদা, আমার দিকে চেয়ে, ডাকলেন। বললাম, কিছু বলবেন? পার্থদা খুব কম কথা বলেন। বললেন- ‘তুমি লেখো। কী পেলে, কী পেলে না, নিয়ে ভেবো না। তোমাকে ওরকম হা-হুতাশ মানায় না’Ñ বলে চলে গেলেন। আমি অনুপ্রেরণা পেলাম। যারা, প্রতিষ্ঠানের ঢক্কানিনাদের বাইরে দশকের পর দশক পাগল হয়ে লিখছি, তাদের ভবিষ্যত কী? পৌঁছোতে কি পারব কোনদিন প্রিয় পাঠকদের কাছে? পার্থদা লাখ করেছেন আমার লেখালেখির গুরুত্ব কতটা, সেদিকে? কিন্তু, বিমলকেও বলছিÑ লিখে যান। ওটাই আপনার কাজ, আপনার নিয়তি।
×