ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অণুগল্প ॥ হাঁটা

প্রকাশিত: ২১:১৫, ৩০ অক্টোবর ২০২০

অণুগল্প ॥ হাঁটা

দুহাতে প্রটেকশন গ্লাভস পরতে পরতে মেয়েলি পারফিউমের অদ্ভুত একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পায় রিহান। আধখোলা জানালায় একটা ছায়াকে চলে যেতে দেখা যায়। পাশের ইউনিটের বিনীতা বৌদির এইটুকু হেঁটে যাওয়া ওদিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে রিহান। অন্য সময় হলে অনুভূতিটাও অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু এখন রিহানের মন-মগজ চূড়ান্ত এলোমেলো। আজ বাজারে না গেলেই নয়। ঘরে খাবার নেই, গত এক-দেড় মাসে জমানো টাকাও শেষ হয়েছে। তাছাড়া বাইরে যাবার কথা ভাবলেই মনে হয়- যমদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে বোধহয়। ঘুমন্ত স্ত্রীর নিটোল মুখের দিকে তাকায়, ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে পাপিয়া। নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে রিহানের। ফুটপাত থেকে কেনা সস্তা পিপিই, মাস্ক আর গ্লাভস পরে বাজারের ব্যাগটা হাতে নেয়। করোনা-আক্রান্ত পৃথিবীর কোথাও কোনো আশার বাণী নেই। দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় রিহান। পাপিয়ার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। গলির মুখে পা রেখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। নিজের গলার চেন আর কানের দুলজোড়া খুলে দিয়েছে পাপিয়া। বিয়ের সময় আম্মা দিয়েছিলো পাপিয়াকে। হাতের মুঠ খুলে একবার দেখে রিহান, হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলে। মহল্লার বড় মসজিদকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোলে শুধু কয়েকটা মুদির দোকান আর বাচ্চুর ফার্মেসিটা খোলা। রাস্তার ওপাশে তিনটা ভ্যানগাড়ি; অল্পস্বল্প সবজি আর ফলমূল বিক্রি করছে। বাকি সব সুনসান। এই দুর্দিনে কোনদিকে যাবে রিহান? সব বন্ধ। কে কিনবে সোনার চেন আর দুল? পা দুটো চলতে চায় না। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। আশেপাশে লোকজনের সমাগম কম। গন্তব্যহীনের মতো কোর্ট বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে। ঘুরপথে না গিয়ে পন্তা পীরের গলিতে ঢুকে পড়ে। এদিকে শর্টকাট। গলিতেও লোকজন কম, ওদিক থেকে দুজন যুবককে হেঁটে আসতে দেখা যায়। দিশেহারা রিহানও নিজের মতো হাঁটে। ভাবে- জীবন কতো কঠিন, বাঁচার যুদ্ধ আরো কঠিন। সে আর পাপিয়া। শেষ পর্যন্ত দুজনে খেয়ে বাঁচতে পারবে তো! আচমকা পেছন থেকে প্রচ- আঘাত লাগে মাথায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে রিহান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনের যুবক দুজন দৌড়ে আসে। শেষবারের মতো চোখ বোঁজার আগে তিনজন দুর্বৃত্তকে নিজের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিতে দেখে রিহান। তিন ঘণ্টা ধরে অনবরত ফোনে ট্রাই করেই যাচ্ছে পাপিয়া। এতোক্ষণে বাজার নিয়ে রিহানের ফিরে আসার কথা। সে পাতিল ভর্তি পানি গরম করে রেখেছে। ফিরেই ডেটল-পানিতে গোসল করবে রিহান। কিন্তু ফেরার নাম নেই, ফোনটাও বন্ধ। পাশের গলিতে অভুক্ত কুকুরগুলোর আর্তনাদ। পাপিয়ার মনের ভেতরে কেবলই কু ডাকতে থাকে। মসজিদে আসরের আজান হচ্ছে। আধময়লা বোরকা গায়ে চাপিয়ে রুমের দরজায় তালা দেয় পাপিয়া। উদভ্রান্তের মতো সিঁড়ি বেয়ে নামে। মহল্লার গলি পার হয়ে মেইন রোডের পাশে থমকে দাঁড়ায়। কোন দিকে যাবে? কোন পথে হাঁটবে? যেন সমস্তটা পৃথিবীই আজ হাঁটতে হবে তাকে।
×