ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মেধার প্রকাশ ॥ কার কোন বয়সে

প্রকাশিত: ২১:১৩, ৩০ অক্টোবর ২০২০

মেধার প্রকাশ ॥ কার কোন বয়সে

বিভিন্ন বই পড়ে আমার মনে হয়েছে, মানুষ বিভিন্ন মাত্রার মেধা এবং বুদ্ধি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। যথেষ্ট মেধা এবং বুদ্ধি নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে অনেকের ক্ষেত্রে তা বিকশিত হয় বয়স বৃদ্ধি হলে। তারপরও অনেক বিখ্যাত মানুষ তাদের অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন অতি অল্প বয়সে। বিশ্বে অসাধারণ মেধাবী লোকের সংখ্যা সহস্র সহস্র। আমি এমন ছোট লেখায় হয়ত বিশ-পঁচিশ জনের নামোল্লেখ করব। তাছাড়া আমি জানিই বা কজনের নাম! যেসব ব্যক্তির নাম আমরা জানি তাদের কথাই কেবল উল্লেখ করব। বিখ্যাত চিত্রকর তুলুস লুত্রেক সুস্পষ্টভাবে কথা বলতে শিখেছেন দু’বছর বয়সে। ওই বয়সেই তিনি ক্রিস্টমাসের ক্যারল সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে এক লাইনের একটি গানের কলি রচনা করেছিলেন। ‘এঙঙউ ঘওএঐঞ খওঞঞখঊ ঔঊঝটঝ, ও এওঠঊ ণঙট গণ খওঞঞখঊ ঐঊঅজঞ’. তিন বছর বয়সে তিনি খুব সুন্দরভাবে ছবির স্কেচে চিত্র আঁকতে পারতেন। জন স্টুয়ার্ট মিল তিন বছর বয়সে গ্রীক ভাষা শিখতে শুরু করেন। মোজার্ট চার বছর বয়সে কনসার্টো (ঈঙঘঈঊজঞঙ) কম্পোজ করেন। বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে র বয়স যখন চার তখন তিনি পাউরুটির সঙ্গে জ্যাম এবং জ্যামের ওপর লবণ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন, স্বাদ কেমন হয়? ১৯৬৫ সালে সহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হয়। তবে তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এর আগে ফরাসী সরকার তাকে ‘লিজিয়ন অব অনার’ পুরস্কার দিতে চেয়েছিল। তিনি সে পুরস্কার গ্রহণ করতেও অস্বীকার করেছিলেন। তিনি জীবনে কোন পুরস্কারই গ্রহণ করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, লোকে আমাকে জানবে আমার লেখা পড়ে। জাঁ পল সার্ত্রের আগে-পরে অনেকে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমরা কি তাদের সবার নাম জানি? টলস্টয়, দস্তয়ভাস্কি, পারস্য দেশের কবি রুমী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম তারা নোবেল পুরস্কার না পেয়েও পুরস্কারপ্রাপ্তদের বেশি খ্যাতিমান। তাই বলতে হবে নোবেল পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারই না। পাবলো পিকাসোর পিতা ভাল একজন চিত্রকর ছিলেন। ছেলে পিকাসো পাঁচ বছর বয়সে এমন সুন্দর স্কেচ ছবি আঁকলেন। পিতা ঘোষণা করলেন, ছেলে তার চেয়ে সুন্দর ছবি আঁকেন। এখন তার আর এ বিদ্যাচর্চা না করলেও চলবে। ছেলের কাছে হেরে যাওয়ার জন্য তিনি গর্ব অনুভব করতেন। ইহুদী মেসুহিন সাত বছর বয়সে পরিপক্ব একজন বেহালাবাদক বলে পরিচিতি লাভ করেন। জন স্টুয়ার্ট মিল আট বছর বয়সে গ্রীক ইতিহাসবিদ ইরোদেতাস, জেনোফেন অন্যান্য বিখ্যাত গ্রীক লেখকদের বই অরিজিনাল গ্রীক ভাষায় পড়ে শেষ করেন। মোজার্ট আট বছর বয়সে তার রচিত প্রথম সিম্পনি কম্পোজ করেন। জর্জ লুইস বোর্জেজ নয় বছর বয়সে অস্কার ওয়াইল্ডের বই ‘ঞঐঊ ঐঅচচণ চজওঈঊ’ বই স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন। ইংরেজী সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের বয়স যখন বারো বছর, তখন তিনি একটি কারখানায় কাজ করতেন। ওখানে সপ্তাহ ছয় শিলিং মাইনের বিনিময়ে তিনি জুতার কালির কৌটায় আঠা দিয়ে লেবেল লাগাতেন। আলফ্রেড টেনিসন বারো বছর বয়সে ছয় হাজার লাইনের একখানা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। ওই কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধের বর্ণনা, সমুদ্রপথে পলায়ন ইত্যাদি। জর্জিও ভাসারির বইয়ে পড়েছি, মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর বয়স যখন এগারো তখন তাকে ডমিনিকো গিরলান্ডিও নামের খ্যাতিমান একজন চিত্রশিল্পীর কাছে ছবি আঁকার শিক্ষানবিস করতে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর চিত্রশিল্পী গিরল্যানন্ডিও তার আঁকা কিছু চিত্র নকল করে চিত্রাঙ্কন শেখার জন্য মাইকেল এ্যাঞ্জেলোকে দেন। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো এমনই নকল করলেন যে কোন্ ছবিখানা আসল আর কোনটা নকল তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো তাঁর গুরুর আঁকা ছবিগুলো নিজের কাছে রেখে দিয়ে নিজের আঁকা ছবিগুলো গুরুকে দিলেন। ডোমিনিকো গিরলান্ডিও কোন দিন তাঁর আঁকা ছবির সঙ্গে শিক্ষানবিস মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর ছবির পার্থক্য ধরতে পারেননি। লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চির বয়স তখন চৌদ্দ বছর। আন্দ্রেয়া দেল ভেরোসিও তখন যথেষ্ট খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী লিওনার্দোকে তাঁর শিষ্য করা হলো ছবি আঁকার ব্যাপারে। ভেরাসিও তখন ইঅচঞওঝগ ঙঋঈজওঝঞ ইণ ঝঞঔঙঘ’ নামের বড় একখানা চিত্র অঙ্কন করছিল। ওই ছবির জন্য একজন দেবতা বা এ্যাঞ্জেল যিশুর কাপড় ধরে আছে এই দৃশ্য আঁকতে দেয়া হলো। লিওনার্দো ওই এ্যাঞ্জেলের ছবি এত সুন্দর করে আঁকলেন যে আন্দ্রেয়া দেল ভেরাসিও নিজেও অমন সুন্দর চিত্র আঁকতে পারতেন না। একজন কিশোর তাঁর চেয়ে ভাল ছবি আঁকে দেখতে পেয়ে আন্দ্রেয়া দেল ভেরাসিও আর কোন দিন রং তুলি হাতে তুলে নেননি। জন ডোনে (ঔঙঐঘ উঙঘঊ) বারো বছর বয়সে ইংরেজী, ফরাসী, লাতিন ভাষার ওপর প্রচুর দক্ষতা নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অসুস্তে রোদ্যার বয়স যখন তেরো তখন তিনি পোর্সেলন দিয়ে তৈরি তৈজসপত্রের ওপর ডেকোরেটিভ ছবি আঁকতে শুরু করেন। জর্জ হ্যারিসনের বয়স যখন মাত্র চৌদ্দ বছর তখন তিনি পল ম্যাকারটিনির সঙ্গীত দলে যোগদান করেন। ॥ দুই ॥ জীবনের মধ্য গগনে মানুষের প্রতিভার পূর্ণতা লাভ করে। তাই পনেরো বছর থেকে আশি বছর বয়সের মধ্যকার কারও জীবনের কথা আমি বলতে চাই না, তা যদি করি তবে, সহস্র সহস্র প্রতিভাবান মানুষকে নিয়ে লিখতে হয়। তা করব না আরও একটি কারণে, আমি তো সব বিখ্যাত লোকের সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছু জানি না। তাই আশি থেকে একশ’ বছর পর্যন্ত সময় খ্যাতিমান অল্পকিছু সংখ্যক মানুষ কি কি করেছেন, সেসব সম্পর্কে একটু উল্লেখ করতে চাই। মধ্য বয়সই মনে হয় মানুষের শ্রেষ্ঠ সময়। মাইকেল এ্যাঞ্জেলে পৃথিবীর ভাস্কর্য ‘ডেভিডের’ মূর্তি নির্মাণ শেষ করেন যখন, তখন তাঁর বয়স ছিল ঊনত্রিশ বছর। এর আগে তিনি সৃষ্টি করেন ‘পিয়েতা’ নামের ভাস্কর্য। ‘ডেভিড ্এবং পিয়েতা’ কোনটা শ্রেষ্ঠতর এমন প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন। তবে বিশুদ্ধতার মনে হয় ‘পিয়েতাই’ শ্রেষ্ঠতর। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে ‘মোনালিসা’ ছবিখানা আঁকতে শুরু করেন। মধ্যবয়সটাও মানুষের শ্রেষ্ঠ সময়, তবে ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ আছেন, শেষ বয়সটাই তাঁদের শ্রেষ্ঠ সময়, এই ব্যতিক্রমী মাত্র কয়েকজন মানুষ সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু কথা লিখতে চাই। আমি কিন্তু আমার লেখায় কোন বিজ্ঞানীদের কথা উল্লেখ করছি না। কেবল শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের কথাই উল্লেখ করছি। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রেনোয়ার বয়স তখন ৮০ বছরের মতো, রিউমাটয়েড (জঐঊটগঙঞউওউ) বাত বেদনার কারণে তিনি তখন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। তখনও তিনি অসাধারণ সুন্দর সুন্দর চিত্র অঙ্কন করেছেন। ফরাসী দার্শনিক ভলটেয়ার শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। শেষ বয়সে তিনি রিয়াল স্টেটের ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর যখন বয়স ৮০ বছর তখন ৪০টি ব্যাঙ্গাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন এবং ১০০ খানার মতো বাড়ি দেখাশোনা করতেন। টেনিসনের বয়স যখন ৮০ বছর, তখন তিনি তাঁর বেস্টসেলার ‘ডিসিটিয়ার এবং আদার পোয়েমস’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। ক্লদ মনের বয়স যখন ৮০ বছর। দুই চোখেই ক্যাটার‌্যাক্টের (ঈধঃধৎধপঃ) কারণে তিনি চোখে ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেন না। ওই সময় তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম ওয়াটার লিলিজ (ডধঃবৎ খরষরবং) সিরিজের বেশ বড় বারোখানা ছবি আঁকেন। ওই ছবিগুলো তার জীবনেরই শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম নয়। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের মধ্যে ওসব চিত্রসমূহকেও বিবেচনা করা হয়। জার্মান প-িত গোয়েথে তার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা (ঋঅটঝঞ) গ্রন্থখানা লেখা সম্পন্ন করেন ৮০ বছর বয়সে। সমারসেট মমের যখন বয়স ৯১ বছর সেদিন সকাল বেলা একজন তাকে হ্যাপী বার্থ ডে বলে সম্বোধন করেন। মম, বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘ঙঐ, ঐঊখখ, অহড়ঃযবৎ ইরৎঃযফধু!’ সমারসেট মমের ইচ্ছা ছিল, সুস্থ শরীরে থাকতে থাকতেই তিনি মারা যাবেন। বৃদ্ধ বয়সে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু তিনি প্রায় সুস্থ শরীরে ৯৬ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এবং যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন লিখে গেছেন। জর্জ বার্নান্ড-স ৯২ বছর বয়সে তাঁর বিখ্যাত লেখা দঅঞঙগওঈ ঋঅঘঞঅঝণ’ নিয়ে ‘ঋঅজঋঊঞঈঐঊউ ঋঅইখঊঝ’ বইখানা লেখেন। তখনও তিনি দৈনিক ছয় মাইল হাঁটতেন। বার্টান্ড রাসেল ৯৬ বছর বয়সে অসাধারণ সব ছবি এঁকেছেন এবং তার ব্যবসায়িক বিষয়ও দেখাশোনা করতেন। সিদ্ধার্থ উপন্যাসের জার্মান লেখক হেরমাল হেস ৮৫ বছর বয়সে তার লেখা একটি কবির পুনর্লিখন করেন। তারপর মোজার্টের একটি সনোটা বাজিয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যান এবং ঘুমের মধ্যে মারা যান। হেনরী মুর ৮৫ বছর বয়সে নিউইয়র্কে মেট্রোপলিটান পলিটান আর্ট মিউজিয়ামে তার ভাস্কর্য শিল্পের একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। অনেকের মতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার ছিলেন গ্রীসের সফোক্লয়াস। তার বয়স যখন ৮৫ বছর তখন তিনি এক পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। তার বয়স যখন ৯০ বছর তখন গ্রীসের অন্য একজন প্রখ্যাত নাট্যকার ইউরিপিদাস মারা যান। সফোক্লিয়াস তার বন্ধুর মৃত্যুতে শোক জানাতে নিজ দলের কোরাসদের (ঈঐঙজটঝ) নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের বয়স যখন ৯৫ বছর তখন সুইজারল্যান্ডের একটি হেলথ সেন্টারে গিয়ে আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছায় বিশেষ রকমের প্রস্তুত করা ইঞ্জেকশন পশ্চাতদেশে নিয়েছিলেন। তিনি ৯৭ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। বার্টান্ড রাসেল তার পশ্চাতদেশে অমন ইনজেকশন না নিয়েও ৯৮ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। বার্টান্ড রাসেল মৃত্যুর সাতদিন আগেও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে খুব জোরালো বক্তব্য দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মানুষ যে শেষ বয়স পর্যন্ত অনেক চিন্তাশীল এবং ক্রিয়েটিভ কাজ করতে সক্ষম সেটা বোঝানোর জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটি লিখেছি। এতজন অসাধারণ ব্যক্তির কথাই যখন লিখলাম, তখন নিজের ছোটবেলার কথাও একটু উল্লেখ করছি। আমার মামা বাড়ি বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলায় সন্ধ্যা নদীর পাড়ে। আমার ছোট নানার খুব ইলিশ মাছ ধরার উৎসাহ ছিল। আমার বয়স তখন চৌদ্দ বছর। একদিন ছোট নানার সঙ্গে ভরদুপুরে, সন্ধ্যা নদীতে মাছ ধরতে গেলাম। নানাই মাছ ধরার চেষ্টা করছিলেন। একসময় তাকে একটু বিশ্রাম নিতে বলে মাছ ধরার জালের দড়িটা আমার হাতে দিতে অনুরোধ করলাম। নানা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার হাতে জালের দড়িটা দিলেন। আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে আমি ভাগ্যক্রমে একটা রুপালি ইলিশ ধরে ফেললাম। আমার ছোটবেলায় জীবনের ওই উপলক্ষটাই সবচেয়ে স্মরণীয় এবং আনন্দময়। আমার নানার কাছ থেকে বেশ বাহাবা পেয়েছিলাম।
×