ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাশুড়ির শত কোটি টাকা আত্মসাত কাহিনী

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ২৮ অক্টোবর ২০২০

শাশুড়ির শত কোটি টাকা আত্মসাত কাহিনী

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ছলাকলার মাধ্যমে শতবর্ষী শাশুড়ি দেলোয়ারা বেগমের কাছে থেকে শুধু শত কোটি নয়, কয়েক শ’ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে জামাই। সায় দিয়েছে তারই বড় মেয়ে (জামাতার দ্বিতীয় স্ত্রী) আকিলা শরিফা সুলতানা। তিনি দেলোয়ারা-হাজী শরিফ দম্পতির ৫ মেয়ের মধ্যে বড়। জামাতার বিরুদ্ধে শাশুড়ির মামলার বিষয়টি এখন বগুড়ার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। শাশুড়ির দায়ের করা শত কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় রানা দম্পতি আদালতে হাজিয়া দিতে গিয়ে জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় এখন জেল হাজতে। কে এই রানা! তারও ঠিকুজি বের হচ্ছে। যা শুনে সাধারণের চোখ উঠছে চড়ক গাছে। এর আগে জানা যাক যে পরিবারে কৌশলে রানার প্রবেশ তার পূর্ব কথা। হাজী শরিফ উদ্দিন গত হয়েছেন ১৯৮৬ সালে। তারপর স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম তার বিড়ি ফ্যাক্টরি, তামাক পাতা ক্রয় কেন্দ্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তিনি বগুড়ার নবাব পরিবারের (তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী) জায়াগায় গড়ে ওঠা বহুতল মার্কেট কিনে নেন। মার্কেটের নামকরণ হয় দেলোয়ারা শরিফ উদ্দিন সুপার মার্কেট লিমিটেড। বিড়ি ফ্যাক্টরি ও এই মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখাশোনায় সহযোগিতা করতেন দেলোয়ারা বেগমের জামাইগণ। বড় জামাই সাইফুল ইসলাম ব্যবসার এক পর্যায়ে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলা পত্রিকা স্বত্ব কিনে নিয়ে সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় কর্মচারী হয়ে যোগদান করেন আনোয়ার হোসেন রানা। সাইফুল ইসলামের কাজে সাহায্য করেন। বাড়ি থেকে খাবার এনে দেয়া থেকে শুরু করে বাড়ির কাজও করে দেন। ২০০৬ সালে সাইফুল ইসলামের মৃত্যু হয়। এরপর স্ত্রী ও এক ছেলের জনক রানার দৃষ্টি পড়ে সাইফুলের বিধবা স্ত্রী আকিলা শরিফা সুলতানার ওপর। বছর তিনেক পর ২০০৯ সালে তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। বছর দেড়েক দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ফাইভ স্টার হোটেলে থেকে বগুড়ার ফিরে আসেন রানা দম্পতি। শাশুড়ি দেলোয়ারা বেগমের কাছে ক্ষমা চেয়ে সেই বাড়িতে আশ্রিত হন। এমন অভিযোগ রয়েছে, আনোয়ার হোসেন রানা কৌশলে শাশুড়িকে নানা ভাবে ভুল বুঝিয়ে এতটাই নিজের দিকে টেনে নেন যে দেলোয়ারা বেগম অন্য জামাইয়ের চেয়ে অন্ধ বিশ^াসে তার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। অভিযোগে বলা হয়। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে গিয়ে বসেন নবাববাড়ি সড়ক ধারে বহুতল সুপার মার্কেটে। এই মার্কেটে প্রতিটি তলায় ১৪০টি করে দোকান। পঞ্চম তলায় অডিটোরিয়াম নির্মাণ শুরু করেন। তার পাশে গড়ে তোলেন বিলাসবহুল কক্ষ। চলেন ডিভি লটারির মতো। কোমরে থাকে পিস্তল। সঙ্গে থাকে তিন দেহরক্ষী। তাদের একজনের কাছে ল্যাপটপ ব্যাগ। বিড়ি ফ্যাক্টরি, সিএনজি ফিলিং স্টেশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারদের হাত করেন। সুপার মার্কেটের কয়েকজনকে তার কাছে টেনে নেন। প্রচুর অর্থ বিতরণ করেন। সুপার মার্কেটের পেছনে করতোয়া নদীভূমি দখল করে নির্মাণ করেন স্ত্রীর নামে একটি কমপ্লেক্স। কথা ছিল ওই স্থানে নদীর ওপর একটি সেতু নির্মিত হবে। সেই সেতু নির্মাণের জয়াগায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। মার্কেটের সামনের সরকারী জায়গা দখল করে স্টিলের সিঁড়ি সরিয়ে নেন। তারপর শুরু হয় বিভিন্ন ব্যাংকে কত টাকা আছে তার হিসাব নেয়া। এই পর্যায়ে শাশুড়ি দেলোয়ারা বেগমের কাছে থেকে প্রতারণা করে কৌশলে চেকের পাতা সই করে নেন। একটি সূত্র জানায়, দেলোয়ারা বেগমের কাছে থেকে একটি দলিলে কৌশলে সই করে নিয়েছেন রানা। এই দলিলে সম্পত্তি লেখার বিষয় আছে। ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনসহ নানাভাবে প্রায় এক শ’ কোটি টাকা আত্মসাত করার পর রানা রংপুরের তামাক পাতার গোডাউনে গিয়ে খবরদারি করার সময় গোডউনের ম্যানেজার বুঝতে পেরে খবর দেন দেলোয়ারা বেগমের বাকি জামাইদের। খবরগুলো জেনে অসুস্থ হয়ে পড়েন দেলোয়ারা বেগম। বাকি চার কন্যা চলে আসেন তার বাড়িতে। সেবা শুশ্রƒষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। দেলোয়ারা বেগম ১ অক্টোবর রানা তার মেয়েসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। ৫ অক্টোবর তা রেকর্ড করা হয়। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির। ১১ অক্টোবর রানা দম্পতি উচ্চ আদালতে জামিন প্রার্থনা করলে চার সপ্তাহের মধ্যে তাদের নি¤œ আদালতে হাজিরা দিতে বলা হয়। রবিবার আদালতে হাজিয়া দিলে জামিন নামঞ্জুর করে তাদের জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। কে এই আনোয়ার হোসেন রানা ॥ তার বাড়ি বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে নন্দীগ্রাম উপজেলার পানাপুর গ্রামে। তার শিক্ষক বাবা নদী ভাঙ্গন এলাকা ধুনট থেকে প্রথমে মাটিহাস গ্রাম ও পরে পানাপুর গ্রামে বসতি গড়েন। আনোয়ার নন্দীগ্রামের একটি সিনেমা হলে গেট কিপার ও পরে টিকেট কাউন্টারের চাকরি করেন। এক সময় মোটর গাড়ির চেন মাস্টারি করেন। দুর্জয় বাংলা পত্রিকা থেকে উত্থানের পর প্রথমে তিনি জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। জাতীয় পার্টির তৎকালীন নেতা সাবেক মন্ত্রী মামদুদুর রহমান চৌধুরীর সান্নিধ্য পান। ২০০৮ সালে রানা মামদুদুর রহমান চৌধুরীর এলডিপিতে যোগদান করেন। ২০১২ সালে তাকে বিএনপির রিজভী পরিবারের সদস্যের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা যায়। এরপর ২০১৪ সালে নাটকীয়ভাবে যোগদান করেন আওয়ামী লীগে। নন্দীগ্রামে তিনি বিড়ি ফ্যাক্টরি দিয়েছেন। শরিফা রিড়ি নামে একটি বিড়ি বাজারজাত করেন। আরও প্রতিষ্ঠান গড়ছেন। মুক্তজমিন নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রতারণার বিষয়টি জানাজানি হলে রানা ও তার স্ত্রী গত ২১ সেপ্টেম্বর বাড়ি ছেড়ে সুপার মার্কেটের ওপর তলায় গিয়ে ওঠেন। তার নিয়োজিত নিরাপত্তা রক্ষীরা চার দিকে পাহাড়ায় থাকে। তিনি নিজে তার কামরার চারপাশে কয়েকটি সিসি ক্যামেরায় লোকজনের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। জেল হাজতে যাওয়ার পর দেলোয়ারা বেগম সোমবার দুপুরে সুপার মার্কেটে গিয়েছিলেন। দোকানের মালিকরা তাকে স্বাগত জানিয়েছে। এ পর্যায়ে ওপরে উঠে দেখেন রানার সবগুলো কক্ষ তালা দেয়া। দেলোয়ারা বেগম দোকানিদের জানান এখন কিছুই করবেন না। আইনগত ভাবেই তিনি ওই তালা খুলে বসবেন।
×