ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বরগুনায় রিফাত হত্যা মামলা

১১ অপ্রাপ্ত বয়স্ক আসামির সাজা, ৩ জন খালাস

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ২৮ অক্টোবর ২০২০

১১ অপ্রাপ্ত বয়স্ক আসামির সাজা, ৩ জন খালাস

মোস্তফা কাদের, বরগুনা থেকে ॥ বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির মধ্যে ছয় জনকে ১০ বছর করে, চার জনকে পাঁচ বছর করে এবং একজনকে তিন বছরের দ-াদেশ দেয়া হয়েছে। অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় তিনজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। বরগুনা শিশু আদালতের বিচারক হাফিজুর রহমান মঙ্গলবার বেলা ১টায় এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতে এ সময় উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবীরা এবং প্রভেশন অফিসার। এছাড়াও হাজতে থাকা ৬ কিশোর অপরাধী এবং জামিনে থাকা ৮ কিশোর অপরাধী এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে দণ্ডপ্রাপ্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হলো রাশিদুল হাসান রিশান ওরফে রিশান ফরাজী (১৭) ১০ বছর, রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার (১৫) ১০ বছর, আবু আবদুল্লাহ্ ওরফে রায়হান (১৬) ১০ বছর, ওলিউল্লাহ্ ওরফে অলি (১৬) ১০ বছর, নাইম (১৭) ১০ বছর, তানভীর হোসেন (১৭) ১০ বছর, জয় চন্দ্র সরকার ওরফে চন্দন (১৭) পাঁচ বছর, নাজমুল হাসান (১৪) পাঁচ বছর, রাকিবুল হাসান নিয়ামত (১৫) পাঁচ বছর, সাইয়েদ মারুফ বিল্লাহ ওরফে মহিবুল্লাহ (১৭) পাঁচ বছর, প্রিন্স মোল্লা (১৫) তিন বছর। এ মামলার শিশু আসামি রাতুল শিকদার জয় (১৬), আরিয়ান হোসেন শ্রাবণ (১৬) ও মারুফ মল্লিকের (১৭) বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, নিহত শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ এর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির বেপরোয়া চলাফেরা ও অনৈতিক কর্মকা-ের কারণে এ হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। বয়স্ক আসামিদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করেছে দ-প্রাপ্ত কিশোর অপরাধীরা। পারিবারিক শিক্ষার অভাব, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবের কারণে এসব কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। শিশু আইনে শাস্তি কম থাকার কারণে অনেক শিশুই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আদালত সাক্ষ্য প্রমাণে প্রমাণিত অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা না দিলে দেশে কিশোর অপরাধ এবং কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এ বিবেচনায় ছয় জনকে শিশু আইনে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির বিষয় আদালত বলেছে শিশু অপরাধীদের গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে বয়স প্রমাণ করার যে আইন রয়েছে তদন্তকারী কর্মকর্তা তা পালন করেননি। এছাড়াও দ-প্রাপ্ত কিশোর আসামিদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠালে সেখানে অবস্থানরত শিশু কিশোররা আতঙ্কিত হতে পারে, এ বিবেচনায় তাদের কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন, শিশু আদালতের পিপি এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান, অপরদিকে আসামিপক্ষের ছিলেন এ্যাডভোকেট শাহজাহান, এ্যাডভোকেট সোহরাফ হোসেন, এ্যাডভোকেট নুরুল আমিন, এ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির, এ্যাডভোকেট বিমান কান্তি গুহ, এ্যাডভোকেট মোস্তফা কাদেও, এ্যাডভোকেট নারগিস পারভীন সুরমা প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষ এবং নিহত রিফাতের পরিবার ও বরগুনার সচেতন মহল এ রায়ে সন্তষ প্রকাশ করেছে। অপরদিকে আসামিপক্ষের পরিবার ও আইনজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চ আদালতে আপীল করার কথা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, ৮ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনার শিশু আদালত। ৭৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর মোট ৬৩ কার্যদিবসে বিচারিক কার্যক্রম শেষে ১৪ অক্টোবর বরগুনা শিশু আদালত এ মামলার রায়ের দিন ধার্য করেন। মামলা ১৪ আসামির মধ্যে সাত জনে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দী দিয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ১৪ অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে জন্য ৭৪ জন সাক্ষী ভিডিও ফুটেজসহ বিভিন্ন প্রমাণাদি আদালতে উপস্থাপন করে। এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণে সমর্থ হয়েছে এমনটা দাবি করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এদিকে দ-প্রাপ্ত আসামির আইনজীবীরা মনে করেন, তারা ন্যায় বিচার পায়নি উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। এ মামলার বয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণা করা হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। মিন্নিসহ ৬ প্রাপ্তবয়স্ক আসামিকে মৃত্যুদ- দেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ আছাদুজ্জামান। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৬ জুন সকাল সোয়া দশটায় বরগুনা সরকারী কলেজের গেটের সামনে দিনের বেলা কয়েকজন যুবক রিফাত শরীফের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। রিফাত শরীফের সঙ্গে সে সময় তার স্ত্রী মিন্নিও ছিল। মিন্নি তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। গুরুতর আহত অবস্থায় রিফাত শরীফকে প্রথমে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয় পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে বিকেল সাড়ে তিনটায় সে মারা যায়। রিফাত শরীফের ওপর হামলা এবং তার স্ত্রীর বাঁচানোর চেষ্টার এ ঘটনার ভিডিও দেশ-বিদেশে ভাইরাল হলে মিন্নির প্রতি সর্বমহলে সহমর্মিতা তৈরি হয়। রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফের দায়ের করা মামলায় মিন্নি ছিল এক নম্বর সাক্ষী। পরবর্তী তদন্তে বেরিয়ে আসে মিন্নিই এ হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড ছিল। হত্যাকা-ের দুই মাস ছয় দিন পর ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকালে বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে বিভক্ত করে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশীট) দাখিল করেন পুলিশ। এদের মধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামি এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ মামলার এক নম্বর আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
×