ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাজী সেলিমের ছেলের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ২৮ অক্টোবর ২০২০

হাজী সেলিমের ছেলের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের আলোচিত ঘটনায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবি সিদ্দিকী দিপুকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ধানমন্ডি মডেল থানা পুলিশ। এই নিয়ে চারজন গ্রেফতার হলো। সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে কাউন্সিলর পদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এদিকে মঙ্গলবার রাতেই ইরফানকে কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তে কেউ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সরকার কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে। ঘটনার পরপরই হাজী সেলিমের ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিম, তার বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদ ও গাড়ি চালক মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃত তিনজনের মধ্যে হাজী সেলিমের ছেলে ও তার বডিগার্ড জাহিদকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়ে রবিবার রাতেই তাদের ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। হাজী সেলিমের ছেলের বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। পলাতক বাকি আসামিদের গ্রেফতারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। হাজী সেলিমের বাসায় অভিযানে পাওয়া অবৈধ মালামালের বিষয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। মঙ্গলবার সাড়ে ৬টা নাগাদ মামলা হয়নি। গত ২৫ অক্টোবর রবিবার রাতে রাজধানীর কলাবাগান সিগন্যালের পাশে ঢাকা-৭ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ‘সংসদ সদস্য’ লেখা স্টিকারযুক্ত সরকারী গাড়ি নৌবাহিনীর কর্মকর্তার একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিলে ঘটনার সূত্রপাত হয়। ধানমন্ডি মডেল থানা পুলিশ মামলার এজাহারে উল্লেখ করা অভিযোগের বরাত দিয়ে জানায়, ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খান নীলক্ষেত থেকে বই কিনে মোটরসাইকেলে করে মোহাম্মদপুরের নিজ বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। বেসরকারী ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬ নম্বরের কালো ল্যান্ড রোভার গাড়ি পেছন থেকে মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয়। ওয়াসিফ আহমেদ নিজের পরিচয় দিয়ে অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে বলেন, মোটরসাইকেলে তার স্ত্রী ছিলেন। যদি গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যেতেন। তাহলে হয়তো অন্য কোন গাড়ি বা তাদের গাড়িও তার স্ত্রীকে পিষে মেরে যেতে পারতো। এ সময় গাড়ি থেকে বের হয়ে জাহিদ ওই কর্মকর্তাকে গালিগালাজ করতে থাকে। এতে চরম অপমানিত বোধ করে তিনিও কালো গাড়িটির পেছনে কলাবাগান পর্যন্ত যান। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটি থামলে ওয়াসিফ আহমেদও থামেন। এ সময় গাড়ি থেকে জাহিদ, দিপু ও অজ্ঞাত আরও ২/৩ জন অত্যন্ত নোংরা ভাষায় ওই কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে গালিগালাজ করতে থাকে। কাছে গিয়েই কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই কর্মকর্তাকে মারধর শুরু করে। মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলে। মারার সময় স্ত্রী তাদের আটকানোর চেষ্টা করেন। তারা ওই কর্মকর্তার স্ত্রীর গায়েও হাত তুলে। এ সময় স্ত্রীর চিৎকারে জনতা ও অদূরে থাকা ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। পরে তাদের ওই পুলিশ কর্মকর্তা আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ ব্যাপারে ওই রাতেই ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি হয়। পরদিন সোমবার ২৬ অক্টোবর ধানমন্ডি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন নৌবাহিনীর ওই কর্মকর্তা। মামলায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম, হাজী সেলিমের প্রোটকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু, মোহাম্মদ জাহিদ ও মিজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর ওই কর্মকর্তাকে প্রাণনাশের হুমকিসহ ফৌজদারি আইনের পাঁচটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ধানমণ্ডি মডেল থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া জানান, মামলা দায়েরের পরপরই গাড়ি চালক মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে একদিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত করছে ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আশফাক রাজীব হাসান। আদালতে চালক মিজান দাবি করেন, তিনি মারধর করেননি। মারধর করেছে বডিগার্ড জাহিদ। গত সোমবার ২৬ অক্টোবর দুপুরে হাজী সেলিমের চকবাজারের দেবী দাস লেনের বহুতল দাদা চাঁন মিয়া ম্যানশনে অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে হাজী সেলিমের ছেলে ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ও বডিগার্ড জাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে বাড়ি থেকে ৩৮টি ওয়াকিটকি, ৫টি ভিপিএস সেট, তাজা বুলেটসহ একটি পিস্তল, একটি একনলা বন্দুক, একটি ব্রিফকেস, একটি হ্যান্ডকাফ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমদানি নিষিদ্ধ একটি ড্রোন (মনুষ্যবিহীন আকাশে উড়ার ছোট আকারের ক্যামেরা বহনকারী যান), ৭ বোতল বিদেশী মদ ও বিয়ার পাওয়া যায়। নিষিদ্ধ বিদেশী মদ ও অনুমোদনহীন ওয়াকিটকি সেট রাখায় ইরফান সেলিম ও তার বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদকে এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদ- দিয়ে রাতেই জেল হাজতে পাঠায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। এদিকে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিদের গ্রেফতারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ অক্টোবর দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার আজিমুল হকের নেতৃত্বে ডিবির একটি বিশেষ দল টাঙ্গাইল জেলায় অভিযান চালায়। অভিযানে মামলার অন্যতম আসামি হাজী সেলিমের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মদীনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিকী দিপু গ্রেফতার হয়। ঘটনার পরপরই এবি সিদ্দিকী আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। সে পরিচয় গোপন করে স্থল সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে। মামলার আসামি হিসেবে দিপুকে ধানমন্ডি থানায় হস্তান্তর করা হয়। ধানমন্ডি মডেল থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, হস্তান্তর করার পর মঙ্গলবারই দিপুকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হয়। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দিপুকে রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার একই মামলায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত ইরফান সেলিম ও জাহিদের সাতদিনের রিমান্ডের শুনানির দিন ধার্য ছিল। আসামিরা আদালতে উপস্থিত না থাকায় রিমান্ডের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। বুধবার আসামিদের উপস্থিতিতে রিমান্ডের শুনানির দিন ধার্য করেন ঢাকার অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূর। এদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম জানান, আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ইরফান সেলিমকে স্থায়ীভাবে কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার রাতেই ইরফান সেলিমকে কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কারণ আইন মোতাবেক কোন জনপ্রতিনিধি আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরই তিনি সাময়িকভাবে বরখাস্ত হবেন। সেই আইনে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। ইরফান সেলিম ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের পুত্র। ইরফান সেলিম নোয়াখালীর সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর জামাতা। অন্যদিকে মঙ্গলবার দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে র‌্যাব মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের জানান, ইরফানের বাসায় অবৈধ অস্ত্র, মাদক, ইলেকট্রিক ডিভাইসসহ বিভিন্ন মালামাল পাওয়া যায়। এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধে আরও মামলা দায়ের করা হবে। তবে কতটি মামলা দায়ের হবে তা তিনি নিশ্চিত করেননি। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করেই আইন মোতাবেক মামলা দায়ের করা হবে। এদিকে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম তেজগাঁও থানা কমপ্লেক্সে ভিকটিম রেসপন্স ও হটলাইন নম্বর উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় কারও প্রভাব খাটানোর ন্যূনতম কোন সুযোগ নেই। কেউ চাইলেও প্রভাব খাটাতে পারবে না। দ্রুততার সঙ্গে মামলার তদন্ত করে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হবে। মামলাটি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে তদন্ত করানো হবে। ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি বলেছেন, জনপ্রতিনিধি হোক আর সে যেই হোক, কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তাকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে। র‌্যাবের মুখপাত্র লেঃ কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, হাজী সেলিমের বাসায় যে ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে বাড়িতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছিল। চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করতে বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছিল আধুনিক রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি। কন্ট্রোল রুমে আধুনিক ভিপিএস (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার) বসানো হয়েছিল। কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে ওয়াকিটকি বা ড্রোন সংযুক্ত ছিল। এসব ওয়াকিটকির চার কিলোমিটার পর্যন্ত ফ্রিকোয়েন্সি ছিল। এ ধরনের ওয়াকিটকি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) অনুমোদন ছাড়া ব্যবহার করা নিষেধ। নেটওয়ার্কে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে না পারে। সাধারণত ভিপিএস ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থাকে। হাজী সেলিম এসব জিনিসপত্র স্থাপন বা আমদানি করতে কোন অনুমোদন নেননি। চকবাজারে হাজী সেলিমের মালিকানাধীন ১৬তলা মদিনা আশিক টাওয়ার ভবনের ছাদের একটি রুমে মানুষের হাড়, হ্যান্ডকাফ, দড়ি, চাকুসহ আরও বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়া গেছে। তবে মানুষের হাড় সেখানে কিভাবে গেল তা নিশ্চিত নয়। ওই রুমটি টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
×