ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

মুক্তির মহানায়কের অধীত জবানবন্দী

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২৮ অক্টোবর ২০২০

মুক্তির মহানায়কের অধীত জবানবন্দী

মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে ২০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দু’শ’ বছর পরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছুটা আন্দোলনও করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে ও আমার সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরও কতকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে?’ ছাত্রজীবনে রাজনীতির সূচনাপাঠ থেকে সভ্যতার ইতিহাসে সপরিবারে বর্বরতম নৃশংস মহাপ্রয়াণ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে বারংবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘৃণ্য চক্রান্তের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বর্ণিত কারাবন্দী জীবনের পিছনে ছিল সুগভীর ও সুপরিকল্পিত কুৎসিত ষড়যন্ত্রের নীলনক্সার বাস্তবায়ন। একই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার পরবর্তী এবং সাম্প্রতিককালে এসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের কুশীলব এবং তাদের বশংবদদের নানামুখী সহিংস অপতৎপরতা প্রতিনিয়ত দেশবাসীকে অবলোকন করতে হচ্ছে। ¯্রষ্টার অপার কৃপায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া তাঁর অন্যতম সুযোগ্য তনয়া দেশরতœ শেখ হাসিনার সরকার-দল-উন্নয়ন অগ্রগতির অদম্য অভিযাত্রার বিরুদ্ধে অহেতুক অরাজকতা সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল-বিপর্যস্ত ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার হীন অপকৌশল অব্যাহত রেখেছে। অতীতের এমন এক নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলার জবানবন্দী পর্যালোচনায় আমরা এক বিশ্বশীর্ষ মানবিক-তীক্ষèমেধা-দলের নেতাকর্মীদের মামলার আসামিভুক্তি উদ্ধারে ঋদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করতে পেরেছি। এই ক্ষেত্রে অবিনস্বর বঙ্গবন্ধু-কীর্তি বিশ্ব পরিম-লে বিরল ও বিস্ময়কর অধ্যায় রচনা করেছে - নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। আমরা সম্যক অবগত আছি যে, ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলসমূহের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাঙালী মুক্তির ম্যাগনাকার্টা খ্যাত ছয় দফা কর্মসূচী পেশ করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিকদের ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আমার প্রস্তাবিত ছয় দফা দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি শোষিত, বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।’ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে পাকিস্তানী হিং¯্র শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবেই চিহ্নিত করে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক সকল ক্ষেত্রে প্রচ- অমানবিক শোষণ-দমন ও নিপীড়নের পন্থা বেছে নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ অঞ্চলে পরিণত করার অপ্রকৃতিস্থ কৌশল অবলম্বন করে। বাঙালী জাতীয়তাবাদের অভিনব বিকাশমানতায় পূর্ণাঙ্গ পরিপুষ্ট এই ছয় দফা ছিল দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক বৈতরণী। ছয় দফার পক্ষে অদমনীয় বাঙালীর প্রগাঢ় সমর্থনে তীব্র গণআন্দোলন ও দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে শহীদ মনু মিয়া-শফিক-শামসুল হকসহ ১০ জন বাঙালীর প্রাণ বিসর্জন আন্দোলনের বারব্রত তৈরি করে। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ছয় দফা আন্দোলনকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ হিসেবে কলুষিত করার অযৌক্তিক কূটচালে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মামলা দায়ের করে ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাঁকে গ্রেফতার করা হলে ৬ জুন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে হরতাল আহ্বান করা হয়। ৭ জুন ১৪৪ ধারা জারি করে কঠোর গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কারণে ৮ জুনের পত্রিকায় এ সম্পর্কিত কোন সংবাদই প্রকাশ হয়নি। ১৫ জুন ইত্তেফাক সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার ও ইত্তেফাক পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এই ছয় দফা আন্দোলনকে ঘিরে অভূতপূর্ব সংগ্রামের দাবানল পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ভীতকে কঠিন নির্বীজ নড়বড়ে করে তুলে। ভীতসন্ত্রস্ত শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি সাজিয়ে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ নামে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দায়ের এবং বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এর বিরুদ্ধে পাপিষ্ঠ স্বৈরশাসকের নরপশুতুল্য বাহিনীদের সমস্ত রক্তচক্ষু-বীভৎস আক্রমণ-গুলি বর্ষণের ভয়কে জয় করে হাজার হাজার ছাত্র জনতা আন্দোলনকে বেগবান করার বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করে। ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব। তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ স্লোগানের প্রতিপ্রভায় উজ্জীবিত আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। ছাত্রনেতা আসাদ, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. সামসুজ্জোহা, স্কুলছাত্র মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হকের রক্তে রঞ্জিত আন্দোলনের তীব্রতা অনুভব করে শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বিশাল ছাত্র জনতার অকুণ্ঠ সমর্থনে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। কথিত এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ‘জবানবন্দী’ ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সর্বোচ্চ নন্দিত অসাধারণ নিবেশিত দলিল। ১৯৪৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫৪ সালে প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদ ও পরে জাতীয় বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত এবং দুবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারে মন্ত্রিত্ব লাভের কথাও উল্লেখ করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সাল থেকে পাকিস্তানের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরোধী দলের অঙ্গ দল হিসেবে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট পদে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন, ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে গভীর নিন্দা প্রকাশ এবং সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপনের কথা বঙ্গবন্ধু অকপটে উক্ত জবানবন্দীতে সুস্পষ্ট করেন, যুদ্ধাবসানে অন্যান্য রাজনীতিকদের সঙ্গে আমন্ত্রিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণে আসা আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আবেদন জানান। সকল আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হওয়া উচিত বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর দল ‘তাসখন্দ ঘোষণা’ সমর্থন করেন। অত্যন্ত সুনিপুণ বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই জবানবন্দীতে ছয় দফা কর্মসূচী প্রণয়ন-উপস্থাপন এবং এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের বক্তব্যে অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথায় নিজেকে অভিষিক্ত করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এবং দলের কর্মীদের নিপীড়ন-নির্যাতন- গ্রেফতারী পরোয়ানা-কারাবরণ ইত্যাদির দুঃসহ দিনলিপিও তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর জবানবন্দীতে গ্রেফতারকৃত দলের বহুসংখ্যক নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখ করেন। তাঁরা হলেন নেতৃত্বের শীর্ষে থাকা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ, প্রাক্তন সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক আজিজ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম.এন.এ. প্রচার সম্পাদক মোমেন এ্যাডভোকেট ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান। এছাড়াও রয়েছেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামসুল হক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি হাফিজ মোহাম্মদ মূসা, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য মোল্লা জালালউদ্দিন আহমদ এ্যাডভোকেট, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, প্রাক্তন এম.এন.এ. আমজাদ হোসেন, এ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আহমদ, পাবনার এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সভাপতি মুস্তফা সরোয়ার ও সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক মোহাম্মদুল্লাহ, এ্যাডভোকেট শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক সিরাজউদ্দিন আহমদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি হারুনুর রশীদ, তেজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর এই তালিকায় আরও রয়েছেন ঢাকা সদর উত্তর আওয়ামী লীগ সম্পাদক আবদুল হাকিম, ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি রশীদ মোশারফ, শহর আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক সুলতান আহমদ, অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগ অস্থায়ী সম্পাদক আবদুল মান্নান, পাবনার এ্যাডভোকেট হাসনাইন, মোমেনশাহীর অন্যতম আওয়ামী লীগ ছাত্রনেতা ও কর্মী আবদুর রহমান সিদ্দিকী, বঙ্গবন্ধুর দুই ভ্রাতৃষ্পুত্র পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহীদুল ইসলাম, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন সহ-সভাপতি ও অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা ইদ্রিসসহ অন্যান্য বহু আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্রনেতা ও শ্রমিক নেতা। বঙ্গবন্ধু বিচারকার্য শুরুর একদিন পূর্বে ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন, এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষাৎ করে তাঁকে অন্যতম কৌঁসুলি নিয়োগ করেন। অত্যন্ত জ্ঞানাঙ্কুর মেধায় অভিজ্ঞ রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু অন্যান্য নেতা কর্মীদের এই মামলা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে কোন ধরনের সাক্ষাত হয়নি মর্মে জবানবন্দীতে বক্তব্য প্রদান করেন। এদের মধ্যে ছিলেন লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেন, লে. মোজাম্মেল হোসেন, এক্স-কর্পোরাল আমির হোসেন, এল. এস. সুলতান উদ্দিন আহম্মদ, কামালউদ্দিন আহাম্মদ, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজ উল্লাহ্ ও এই মামলায় জড়িত অন্যান্য স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। সরকারী আমলা বিশেষ করে আহম্মদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস ও খান মোহাম্মদ শামসুর রহমানের সঙ্গে কখনো কোন রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা বা ষড়যন্ত্রেও ব্যাপৃত হননি মর্মে জবানবন্দী দেন। চট্টগ্রামের ডাক্তার সাঈদুর রহমান ও মানিক চৌধুরীকে এই কথিত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করতে বলেননি এবং তারা চট্টগ্রামের অন্যান্য সাধারণ কর্মীদের ন্যায় মাত্র উল্লেখ করে অভিযুক্ত সকল নেতা-কর্মীদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদানকল্পে জবানবন্দীতে প্রাণান্তর প্রচেষ্টার যুগান্তকারী নিরীক্ষণ স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রদত্ত জবানবন্দীর শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বর্তমান মামলা নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শোষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্রের জাল বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহারই বিষময় প্রতিক্রিয়া। আমি কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য কোন কিছ্ ুকরি নাই কিংবা কোনদিনও এই উদ্দেশ্যে কোন স্থল, নৌ বা বিমানবাহিনীর কোন কর্মচারীর সংষ্পর্শে কোন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে আত্মনিয়োগ করি নাই। আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণরূপে অজ্ঞ। তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’ স্বল্প পরিসরের এই নিবন্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিস্তারিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারছি না বলে আমি সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। অতিসম্প্রতি দেশের সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় জনগণ অনুধাবন করছে যে, মুখোশধারী অসৎ-দুর্নীতিবাজ-অযোগ্য-অপদার্থ অনুপ্রবেশকারীরা অবৈধ-অনৈতিক পন্থায় তদ্বির-লবিং বাণিজ্যের নষ্ট আশ্রয়ে ছলচাতুরি-মিথ্যাচার-শঠতা-প্রতারণা-নিপুণ অভিনয় শৈলীর অপপ্রয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদ-পদবী দখলে নিয়েছে। কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে কথিত কতিপয় গণ-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নরপশুতুল্য কিছু সিন্ডিকেটেড সাংবাদিকতার নিরাভরণ ও ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রতিবেদনে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করছে। ত্যাগী ও পরীক্ষিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক লড়াকু সৈনিকদের চরিত্রহনন-বশীভূত মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে সত্যনিষ্ঠ মূল্যায়নের পরিবর্তে চরম অবমূল্যায়নে তাঁদের কোণঠাসা করে চলেছে। নির্লোভ-নির্মোহ-সৎ-যোগ্য-দেশপ্রেমিক মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক প্রেরণায় পরিদৃষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত দল এবং তদন্তের তথ্য-উপাত্তের পুনঃবাছাই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে। অন্যথায় অন্ধকারের পরাজিত-মানসিক বিকারগ্রস্ত অশুভ শক্তি তাদের গোপন এজেন্ডা কার্যকরণে অভয়ারণ্য প্রস্তুত করতেই থাকবে। নিষ্ফল নির্দয় সেনা শাসকদের দেশ শাসনকালে সুবিধাভোগী-বাদিরা ‘সরকার ও দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা তাদের অপশক্তির খুঁটি’ অপপ্রচার চালিয়ে সংগোপনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশ ধ্বংসের পরিকল্পনা করে চলছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সকল কদর্য কর্মকৌশল বিনাশ করে বঙ্গবন্ধুর পবিত্র স্বপ্নের দৃশ্যমান সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় সুদৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেই। এই প্রত্যাশায় বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থে রচিত পঙ্ক্তি ‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-/ বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই/ দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হইতেছে ঘরে ঘরে।’ উপস্থাপনে নিবন্ধের ইতি টানছি। লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×