ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুর অঞ্চলে ধানের জমিতে কারেন্ট পোকার আক্রমন

প্রকাশিত: ১৮:০৯, ২৭ অক্টোবর ২০২০

রংপুর অঞ্চলে ধানের জমিতে কারেন্ট পোকার আক্রমন

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ রংপুর অঞ্চলে রোপা আমন ধানের জমিতে বাদামী গাছ ফড়িং (কারেন্ট পোকা) এর আক্রমনে বিপাকে কৃষকরা। কয়েক দফা বন্যায় বেঁচে যাওয়া ধানের জমি আক্রান্ত হওয়ায় তাদের উৎকন্ঠা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষকদের দাবি কীটনাশক ব্যবহার করেও কারেন্ট পোকার আক্রমণ বন্ধ করতে পারছেন না। তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন নিয়ম মেনে কীটনাশক স্প্রে করে কৃষক সহজে তাদের ধানের গাছ রক্ষা করতে পারেন। এ জন্য তাদের লোকজন মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নানা পরামর্শ অব্যাহত রেখেছেন। কৃষিবিভাগ জানায়, ২০২০-২১ আমন মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় মোট রোপা আমনের জমির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬ লাখ ৫ হাজার ১৪০ হেক্টর এবং চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন। ধানের আবাদ হয়েছিলো ৬ লাখ ১২ হাজার ৪৩৫ হেক্টর। যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ৭ হাজার ২৯৫ হেক্টর বেশি। কিন্তু কয়েক দফা বন্যায় ২৪ হাজার ৮৪৭ হেক্টর জমির ধানের গাছ নষ্ঠ হওয়ায় বর্তমানে ধানের জমি দন্ডায়মান আছে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫৮৮ হেক্টর । রংপুর জেলার গংগাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের খামারমোহনা গ্রামের কৃষক সামিউল ইসলাম। তিনি ১৮ বিঘা (২৭ শতকে ১ বিঘা) জমিতে বি আর ১১, ১৪ এবং উচ্চফলনশীল জাতের ধান আবাদ করেছেন। তার জমিতে কারেন্ট পোকার ব্যাপক আক্রমন হয়েছে। কীটনাশক ব্যবহার করেও কোন উপকার পাচ্ছেন না বলে তিনি জানান। এমনকি তার ধানের জমির অনেক স্থানে কারেন্ট পোকার আক্রমনের ফলে ধানের গাছ শুকিয়ে পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। তাই বর্তমানে তার দিন কাটছে উৎকন্ঠায়। বিঘা প্রতি তার এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা। ফসল ঘরে তুলতে আর ১ মাসের মধ্যে সময় লাগবে বলে তিনি জানান। কাউনিয়া উপজেলার নীচ পাড়া এলাকার কৃষক মো. জহির। বন্যায় তাদের পারিবারিকভাবে ৩০ দোন (২৪ শতকে ১ দোন) জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । বর্তমানে বন্যায় রক্ষা পাওয়া প্রায় ১২ দোন ধানের জমিতে কারেন্ট পোকার ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। এমনকি অনেক জমির বেশ কিছু ধান গাছ হলুদ হয়ে গেছে বলে তিনি জানান। মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, তার এলাকায় ধানের জমিতে কমবেশি কারেন্ট পোকার আক্রমণ হয়েছে। অধিকাংশ কৃষক শুরু থেকে কীটনাশক প্রয়োগ করায় পোকা আক্রমণ সহনীয় পর্যায় রয়েছে। তিনি আরো বলেন, স্থানীয় কৃষি অফিসের লোকজন নিয়মিত তাদের জমি পরিদর্শন করে বিভিন্ন পরমর্শ প্রদান করছেন। এবারে ধানের আবাদ ভালো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ফলন ভালো পাওয়া যাবে বলে তার আশা। এ বছর ২০ বিঘা(৩৩ শতকে ১বিঘা) জমিতে স্বর্ণা-৫ এবং বিআর-১১ জাতের ধানের আবাদ করেছেন। এদিকে সচেতন কৃষকেরা জমির ধান রক্ষায় ছুটছেন স্থানীয় হাট বাজারে অবস্থিত কীট নাশক বিক্রেতাদের কাছে। রংপুরের লালবাগ হাটের রনজু এন্টাপ্রাইজের প্রোপাইটার রুহুল আমিন তালুকদার স্বীকার করেন, কৃষকরা কারেন্ট পোকা দমনে বিভিন্ন কোম্পানীর ওষুধ নিতে তার কাছে আসছেন। বৃহস্পতিবার তার দোকানে কীটনাশক নিতে আসা রংপুর সদরের ধাপের হাট এলাকার গুড়াতিপাড়ার কৃষক ফুল মিয়া বলেন, তার ৩২ শতক ধানের জমিতে কারেন্ট পোকার উপস্থিতি দেখা দেয়ার সাথে সাথে কীটনাশক স্প্রে করা শুরু করেছেন। বর্তমানে পোকা নিয়ন্ত্রণে আছে। তবুও নতুন করে প্রয়োগের জন্য কীট নাশক কিনতে এসেছেন। তিনি আরো বলেন, তার এলাকায় কারেন্ট পোকার পাশাপাশি ধানের গাছে পাতা মোড়ানি সহ পচানি রোগ ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ আমন মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় মোট জমির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬ লাখ ৫ হাজার ১৪০ হেক্টর। এর মধ্যে রংপুর জেলার ১ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির বিপরীতে দন্ডায়মান আছে ১ লাখ ৫৬হাজার ৯৭৮ হেক্টর। বন্যায় নষ্ট হয়েছ ৮হাজার ৯৭২ হেক্টর। গাইবান্ধা জেলায় ১ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমির বিপরীতে দন্ডায়মান জমির পরিমান হচ্ছে ১ লাখ ২২হাজার ৬৭৫ হেক্টর।বন্যায় নষ্ট হয়েছে ৫হাজার ৩৭৫ হেক্টর। কুড়িগ্রাম জেলায় ১ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমির বিপরীতে দন্ডায়মান জমির পরিমান হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭১৮ হেক্টর। বন্যায় নষ্ট হয়েছে ৯ হাজার ৮৭ হেক্টর। লালমনিরহাট জেলায় ৮৮ হাজার ২৯০ হেক্টর জমির বিপরীতে দন্ডায়মান জমি হচ্ছে ৮৪ হাজার ৭৪২ হেক্টর। বন্যায় নষ্ট হয়েছে ৮৩৩ হেক্টর জমি এবং নীলফামারী জেলায় ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমির বিপরীতে দন্ডায়মান জমি হচ্ছে ১লাখ ১২হাজার ৪৭৫ হেক্টর। বন্যায় নষ্ট হয়েছে ৫৮০ হেক্টর। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার নূরপুর ব্লক দেখাশুনা করেন উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম । তিনি বলেন, দেখা গেছে আক্রান্ত অধিকাংশ জমি আগের কয়েক বছর ধারাবাহিক ভাবে কারেন্ট পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো বা হচ্ছে। তিনি মনে করেন শুরু থেকে আক্রান্ত জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করলে তা সহজে নিয়ন্ত্রনে আসে। এছাড়া অনেক কৃষককে তার জমির অল্প পরিমাণ কারেন্ট পোকায় আক্রান্ত শুকিয়ে যাওয়া ধান গাছ অপসারণ করে কীটনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হলেও তা পালন করেন না। ফলে পরে আফসোস করা ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকে না। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বন্যা পরবর্তী ধানের জমি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর এলেও এরধ্যে কারেন্ট পোকার আক্রমন বেশি হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কৃষকের নিয়ন্ত্রনে আছে । তিনি বলেন, নীলফামারী জেলার সোনারায় উপজেলার বিএডিসির ভিত্তি আলু বীজ খামারের আবাদকৃত ধানে কারেন্ট পোকার আক্রমন হয়েছে । খামারে মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৫শ একর। তিনি আরো বলেন, কৃষকদের সব সময় তাদের জমি খোঁজ নিতে হবে। যদি ধানের গোছায় কমপক্ষে ৪টি কারেন্ট পোকার উপস্থিতি দেখা যায় তাহলে অবশ্যই গাছের গোড়ায় কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। তবে অনেক কৃষক না জেনে গাছের আগায় কীটনাশক স্প্রে করেন সেখানে গোড়ায় পোকা থেকে যায়। তাই নিয়ম মেনে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। তিনি বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর অনেক জমির ধানের গোড়ায় এখনও স্যাঁতস্যাঁতে ভাব বিরাজ করছে। এই পরিবেশে কারেন্ট পোকা বংশবিস্তার করে। তাই গাছ গুলোকে এক সাইটে হেলিয়ে গোড়ায় আলো ও বাতাস চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য গাছ হেলিয়ে গোড়ায় কীটনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হয়। বন্যায় আমন ধানে অনেক ক্ষতি হয়েছে ঠিকই কিন্তু দন্ডায়মান গাছ গুলো বেশ সবল ও সতেজ হয়ে উঠেছে। তাই বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে ধানের ফলন ভালো পাওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেছেন।
×