ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টাঙ্গাইলের সখীপুরে বনের ভেতর অবৈধ সিসা কারখানা

প্রকাশিত: ১৪:৪৩, ২৭ অক্টোবর ২০২০

টাঙ্গাইলের সখীপুরে বনের ভেতর অবৈধ সিসা কারখানা

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ টাঙ্গাইলের সখীপুরে কালিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে বনের জমি দখল করে আবাসিক এলাকার পাশে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ সিসা কারখানা। আশেপাশে অর্ধশতাধিক পরিবার বসবাস করলেও স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন অসাধু মানুষকে নিয়ে অবৈধ সিসার কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, সিসার রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও মানছেনা কারখানার মালিকপক্ষ। মারা যাচ্ছে গৃহপালিত গরু, ছাগল, হাস-মুরগি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মূল্যবান বৃক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া সীসা কারখানার আশেপাশে বসবাসরত লোকজন নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একইভাবে উপজেলার কাকড়াজান ইউনিয়নের খুংগারচালা এলাকায় সীসা কারখানা গড়ে উঠেছিল। পরে উপজেলা প্রশাসন কারখানাটি গুড়িয়ে দেয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার কালিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে রামখা এলাকার কেবিজি চালায় একটি বনের জমির ভেতর চারদিকে টিনের বেষ্টনী করে প্লটের মালিককে ম্যানেজ করে স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ানম্যান জামাল মিয়া ওরফে চশমা জামালের সহযোগিতায় ওই ভাড়া জমিতে অবৈধ সিসা কারখানা গড়ে তুলেছেন মুন্সিগঞ্জ জেলার ব্যবসায়ী রেজাউল। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে কোনো কারখানা রয়েছে। ভেতরে পাঁচ থেকে সাতজন শ্রমিক পরিত্যক্ত ব্যাটারির খোলস আলাদা করছেন। তাঁদের হাতে গ্লাভস মুখ-পায়ে কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেখা যায়নি। এসিড মিশ্রিত বর্জ্যের ছোট ছোট বেশকয়েকটি স্তুপ দেখা যায়। মাটি গর্ত করে চারটি চুলা বানানো হয়েছে। চুলার পাশে ছোট ছোট সিসার টুকরা ও একটি ধোঁয়াপথ রয়েছে। একটু দূরে রয়েছে ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন। রাত ৮ টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত সিসা তৈরির কাজ করা হয় কারখানাটিতে। ব্যাটারির ভেতরের এসিড মিশ্রিত জমাট বর্জ্য (সিসা) মাটির গর্তে চুলির মধ্যে সাজিয়ে রেখে কাঠ ও কয়লা দিয়ে আগুন ধরিয়ে ডিজেল চালিত যন্ত্র দিয়ে বাতাস দেয়। বর্জ্য আগুনে পুড়ে তরল সিসা হয়। লম্বা চামচ দিয়ে বর্জ্য সরিয়ে সিসা আলাদা করে লোহার কড়াইয়ে রাখা হয়। রাতে সিসা আগুনে পোড়ানোর সময় ধূসর ও কালো ধোঁয়ায় গ্রাম আচ্ছন হয়ে যায়। ধোঁয়ায় আশপাশের গাছপালাগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। কারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্যে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কবলে পড়েছে গ্রামবাসী। এসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে এলাকাবাসী। অসুস্থ হয়ে পড়ছে আশপাশের বাড়ির মানুষ। জমির মালিক কাহার্তা ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সহ সুপার আহাম্মদ আলী বলেন, বনের জমি সংলগ্ন আমার অনাবাদী চালা ভাড়া নিয়ে সিসা কারখানা করছেন মুন্সিগঞ্জ জেলার রেজাউল। আমাদের সাবেক চেয়ারম্যানের অনুরোধে আমি জমি ভাড়া দিতে রাজি হই। তিনি আরোও বলেন, এলাকায় কয়েকটি কৃষকের গরু-ছাগল মারা গেছে একথা সত্য। কারখানার আশপাশের ঘাস খাওয়ার জন্য শুনেছি মারা গেছে। কারখানার ক্ষতির দিক আমার জানা ছিল না। তাই জমি ভাড়া দিছিলাম। যতটুকু জানি আগে কারখানাটি কালিদাস গ্রামে ছিল। নাম প্রকাশ না করে কারখানার পাশের বাড়ির এক নারী বলেন, রাতে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা বের করা হয়। যখন ব্যাটারি পোড়ানো হয়, তখন গোটা এলাকায় ধোঁয়া আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষের কাশি ও শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী মোস্তফা হোসেন জানান, অবৈধভাবে গড়ে ওঠার সিসা কারখানার কারণে আমার দুটি উন্নত জাতের গরু মারা গেছে। যার মূল্য প্রায় ২ লক্ষ টাকা। স্থানীয়রা আরোও জানান, এলাকার আরোও কয়েকজন কৃষকের গরু মারা গেছে। এর মধ্যে লাল মিয়ার ১টি, সোনালী মিয়ার ২টি, হাসুর আলীর ১টি সহআরো কয়েকজনের গরু ছাগল মারা গেছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল রাজ্জাক ওরফে ধলা মিয়া বলেন, অনেক আগে থেকেই এই সিসার কারখানার অভিযোগ শুনে আসছি। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থানা নেয়া হবে। কারখানার মালিক রেজাউলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি এ সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারবেন না বলে ফোন রেখে দেন। বহেড়াতৈল রেঞ্জ অফিসার এরশাদ হোসেন বলেন, সীসা কারখানাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আবার চালু করে থাকলে বন্ধ করে দেয়া হবে। সখীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. আব্দুল জলিল বলেন, রামখা এলাকায় কয়েকজন কৃষকের গরু মরার বিষয় আমরা শুনেছি। পরে আমরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি ওই এলাকায় একটি সিসার কারখানা রয়েছে। সিসার রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কৃষকদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন করতে বলেছি তারপর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবদুস সোবাহান জানান, পরিত্যক্ত ব্যাটারির সিসা পোড়ার ধোঁয়ায় মানুষের কিডনিসহ শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চিত্রা শিকারী বলেন, খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×