ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পর্ন আসক্তি মানুষের জীবনের অন্ধকার দিক

প্রকাশিত: ১৪:০৫, ২৭ অক্টোবর ২০২০

পর্ন আসক্তি মানুষের জীবনের অন্ধকার দিক

অনলাইন ডেস্ক ॥ "সেক্স বা যৌন সম্পর্কের বিষয়ে আমার যেসব ধারণা ছিল পর্নোগ্রাফির কারণে সেসব বিকৃত হয়ে গেছে।" বলছিলেন ২৫ বছর বয়সী নিকি ব্রায়ান্ট। তিনি কার্ডিফে একটি জিমের ম্যানেজার। তিনি জানান, শিশু বয়সেই তার পর্নোগ্রাফি দেখা শুরু হয়েছিল। নিকি বলেছেন, পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে পরবর্তী জীবনে সেক্স সম্পর্কে তার মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। একই সাথে নিজের শরীর সম্পর্কে তার যে অনুভূতি ছিল সেটাও "ধ্বংস" হয়ে গেছে। শুধু নিকি একা নন, তার মতো এরকম আরো অনেকেই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হওয়ার পর তাদের জীবনের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। যুক্তরাজ্যে শিশুদের নিয়ে কাজ করে এরকম একটি দাতব্য সংস্থা প্ল্যান ইউকে এবং ইন্সটিটিউট অফ সাইকোসেক্সুয়াল মেডিসিন শিশুদের ওপর পর্নোগ্রাফির এই প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে পরবর্তীতে কী ধরনের বিপদ হতে পারে সে বিষয়ে স্কুলে পড়ানো উচিত। যুক্তরাজ্যে ওয়েলসের, নিকি ব্রায়ান্ট যে অঞ্চলের, সেখানকার স্থানীয় সরকার বলেছে, কীভাবে পর্নোগ্রাফির মতো বিষয়কে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তারা এখন সেই উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। সারা ব্রিটেনে ২০১৯ সালে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী লোকজনের ওপর চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৭% পুরুষ এবং ৪৭% নারী বলেছে যে জরিপের আগের মাসে তারা পর্নোগ্রাফি দেখেছে। তবে তাদের বেশিরভাগই বলেছে, পর্নোগ্রাফিতে যে সেক্স দেখানো হয় তার সঙ্গে বাস্তব জীবনের সেক্সের কোন সম্পর্ক নেই। তিন চতুর্থাংশ নারী পুরুষ বলেছেন, পর্নে যেভাবে সেক্স দেখানো হয় সেটা একেবারেই ভিন্ন। জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের ৬০ শতাংশ এবং পুরুষদের ৪৯ শতাংশ বলেছেন, পর্নোগ্রাফিতে যা দেখানো হয় সেটা "অসম্ভব।" ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফে জিম ম্যানেজার নিকি ব্রায়ান্ট বলেন, "আমার মনে হতো সেক্স খুব নোংরা, অপ্রীতিকর এবং বাতিকগ্রস্ত বিষয়। কিন্তু পর্নোগ্রাফিতে যেসব সেক্স দেখানো হয় সেটা খুব পরিকল্পিত, সাজানো গোছানো এবং নিখুঁত।" "পর্নোগ্রাফি দেখলে মনে হয় সেক্স যেন শুধু পুরুষের জন্য। আমার যতোটুকু সেক্সের অভিজ্ঞতা হয়েছে, পর্নোগ্রাফির সঙ্গে তার কোন মিল খুঁজে পাইনি। ফলে আমি ভেবেছিলাম যে আমার হয়তো কোন সমস্যা আছে।" এখন বড় হওয়ার পর নিকি বলছেন, সেক্সের বিষয়ে তিনি কখনো কারো কাছ থেকে "স্বাভাবিক ব্যাখ্যা" পাননি বরং "এবিষয়ে তার অনেক লজ্জা ছিল।" যেভাবে আসক্তির শুরু: নিকি ব্রায়ান্ট প্রথম পর্নোগ্রাফি দেখেন যখন তার বয়স ১১। সেটি তিনি দেখেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি সাইটে। কিন্তু সেসময় তিনি বুঝতে পারেননি এই পর্নোগ্রাফি পরে তার জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। "পর্নোগ্রাফিতে নারীকে যেভাবে তুলে ধরা হয় সেটা দেখে মনে হয় নারীরা যেন পুরুষের অনুগত। এটা অত্যন্ত আপত্তিকর।" নিকি বলেন, "আমি দেখলাম পর্নোগ্রাফিতে আমি যা দেখেছি সেসব আমি আমার জীবনেও অনুকরণ করছি। সেগুলো চেষ্টা করে দেখছি। অভিনয় করছি। কারণ আমি ভেবেছিলাম সেটাই হয়তো ঠিক। পুরুষরা হয়তো আসলে এরকমই চায়।" পর্নোগ্রাফিতে তিনি যেসব নারীদের দেখতেন তাদের তুলনায় তার নিজের শরীরকে "অস্বাভাবিক" বলে মনে হতো। এজন্য তিনি তার যোনিতে কসমেটিক সার্জারির কথাও ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত "খুব বেশি ভীত" হয়ে পড়েছিলেন নিকি। এক পর্যায়ে তিনি পর্নোগ্রাফি দেখা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই আসক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য তিনি সেক্সুয়াল থেরাপি, যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশনের আশ্রয় নেন। "শিশু কালে আমি যেসব পর্ন দেখেছি সেটা পরবর্তীতে আমার জীবনে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। নিজের শরীর বা সেক্স সম্পর্কে আমার যেসব ধারণা ছিল, পর্নোগ্রাফির কারণে সেসব ধ্বংস হয়ে যায়।" তিনি বলেন, "পর্নোগ্রাফি আমার মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছিল, যার ফলে সেক্স থেকে যেটুকু আনন্দ উপভোগ করতে পারবো বলে আশা করেছিলাম সেটা আমি করতে পরিনি।" "আমি যদি তখনই সেসব দেখা বন্ধ করে না তাহলে আমার জীবনে আরো অনেক হতে পারতো," বলেন তিনি। শিশুদের মধ্যে পর্ন দেখার অভিজ্ঞতা: এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ বোর্ড অফ ফিল্ম ক্লাসিফিকেশন এবিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় অনলাইন পর্নোগ্রাফি থেকে শিশুসহ অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের রক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। সমীক্ষাটি পরিচালনা করতে গিয়ে ১,১০০ শিশুর সাথে কথা বলা হয় যাদের বয়স ছিল ১১ থেকে ১৭। এই জরিপে যা পাওয়া গেছে: • ১৬ বছরের বেশি বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাদের যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের ১৮% বলেছে পর্নোগ্রাফিতে তারা যা দেখেছে সেসব তারাও তাদের জীবনে করে দেখেছে, কিম্বা তাদের সঙ্গী সেরকম করতে বলেছে। • ১৬ বছরের বেশি ছেলে-মেয়েদের ৩০% বলেছে পর্ন দেখার পর সেক্স সম্পর্কে তাদের মনে যেসব ইচ্ছে তৈরি হয়েছিল, বাস্তব জীবনে সেক্স করার সময় সেগুলো পূরণ হয়নি। • ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ২৯% বলেছে, পর্নোগ্রাফিতে নারী ও পুরুষদের দেখার পর নিজেদের শরীরের বিষয়ে তাদের মনে খারাপ অনুভূতি তৈরি হয়েছে। তারা বলেছেন যে পর্নোগ্রাফি দেখার পর তারা তাদের শরীর অপছন্দ করতে শুরু করে। মালিক নামের (আসল নাম নয়) আরেকজন বলেছেন তার জীবনেও পর্নোগ্রাফির মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল। তিনি বলেন, ১৭ থেকে ২০ বছর বয়সে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে তিনি হয়তো পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। "এক পর্যায়ে পর্নোগ্রাফি দেখে প্রতিদিন সকালে হস্তমৈথুন করতাম যাতে সারাদিন আমার মধ্যে যৌন উত্তেজনা তৈরি না হয়। পরে এটা আমার যৌন জীবনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। ওসব দেখে সেক্সের ব্যাপারে আমার মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল সেটা বাস্তবসম্মত ছিল না," বলেন মালিক। পর্ন আসক্তি আমার জীবনের অন্ধকার দিক: ওয়েনের বয়স এখন ২০। এটা তার আসল নাম নয়। কিশোর বয়সে তিনি পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং এবিষয়ে তিনি এখন অনেক লজ্জিত। তিনি যখন কলেজে পড়েন তখন তার এই আসক্তির শুরু। ওয়েন বলেন, "শুরুটা হয়েছিল সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে দেখা গেল যে এর পেছনে আমার অনেক সময় চলে যাচ্ছে।" "কিছু দিনের জন্য কারো সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। তখন আমার আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেসময় পর্নোগ্রাফি দেখার মাধ্যমে আমি বাস্তব জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিলাম।" একঘেয়েমি জীবন ও আত্মবিশ্বাসের অভাব- এই দুটো মিলিয়ে ওয়েন আক্রান্ত হয়েছিলেন বিষণ্ণতায়। "এর কয়েক বছর পরে, আমার তখন চাকরি হয়েছে, সামাজিক জীবনও বেশ ভাল, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্যকর, তার পরেও এই পর্নোগ্রাফির কারণে আমি উৎফুল্ল হতে পারিনি। এটা আমার জীবনের অন্ধকারময় একটি দিক। আমার আগের সম্পর্কের ওপরেও এর প্রভাব পড়েছিল। এতে আমি আরো বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়ি।" "আমি তখনও আসক্ত ছিলাম। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এটা নিয়ে কথা বলার জন্য কেউ ছিল না। কারণ এনিয়ে কথা বললে লোকেরা নিশ্চয়ই আমাকে অনেক খারাপ ভাববে," বলেন ওয়েন। কার্ডিফের জিম ম্যানেজার নিকি ব্রায়ান্ট বলেন, "আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন আমাদের জীবনের ওপর অনলাইনের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। সেখানে আমরা যা দেখি সেটা আমাদেরকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।" পর্ন অতিরঞ্জিত: কার্ডিফের জিম ম্যানেজার নিকি ব্রায়ান্ট একাই এই সমস্যায় পড়েননি। তার মতো আরো অনেকেই পর্নোগ্রাফিতে এতোটা আসক্ত হয়ে পড়ছেন যে তাদেরকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে। ওয়েলসে সাইকোসেস্কুয়াল ক্লিনিকে রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ এর মতো। যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ এবং ইন্সটিটিউট অফ সাইকোসেক্সুয়াল মেডিসিনের সদস্য ড. কেট হাওয়েলস বলেছেন, "অনেকেই যৌনতার বিষয়ে শিক্ষা নেওয়ার জন্য পর্নোগ্রাফি দেখে থাকেন।" এবিষয়ে ২০১৯ সালে সারা ব্রিটেনে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারী পুরুষের ওপর যে জরিপ চালানো হয়েছিল তাতে দেখা গেছে, ৫৫% পুরুষ এবং ৩৪% নারী বলেছেন যে পর্নোগ্রাফিই ছিল তাদের যৌন শিক্ষার মূল উৎস। তাদের ৫০% নারী মনে করেন এসব পর্নোগ্রাফিতে নারীকে "অমানবিক" করে তোলা হয়েছে। "কিন্তু এটাই তাদের জীবনে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ পর্ন হচ্ছে এমন এক বিষয় যেখানে ভালোবাসা থেকে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। সেখানে সবকিছু অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। স্বাভাবিক সেক্সের চেয়ে এটি একেবারেই আলাদা," বলেন ড. কেট হাওয়েলস। তার মতে এর ফলে তরুণ তরুণীদের ওপর অনেক বেশি চাপ তৈরি হয়। এজন্য তারা শরীরে অনেক রকম সার্জারি করতেও উদ্যোগী হয়। পর্নোগ্রাফি দেখে তাদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয় সেখানে সে যা দেখেছে সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। তিনি বলেন, যৌন স্বাস্থ্য এবং শরীর সম্পর্কে তাদরে যে ধারণা তার ওপরেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। কেট হাওয়েলস বলেন, "বেশিরভাগ পর্নোগ্রাফি পুরুষ-কেন্দ্রিক। পুরুষের আনন্দই সেখানে মুখ্য বিষয়। অনেক সময় যৌন সম্পর্কের বিষয়ে নারীর অনুমতিও নিতে হয় না।" "পর্নোগ্রাফির ব্যাপারে প্রশ্ন করতে গিয়ে ভয় পাওয়া চলবে না। তারা কী দেখে, কতোটুকু দেখে এবং কখন তারা দেখে এসব জানা দরকার। এ বিষয়ে আমাদের অনেক শিক্ষার প্রয়োজন। বিশেষ করে যৌন শিক্ষা এবং সেখানে পর্নোগ্রাফিকেও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সম্পর্ক কিম্বা নারী ও পুরুষের ক্ষমতায়নের ওপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়ে এসব বিষয়ে জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।" বলা হচ্ছে, ২০২২ সাল থেকে ওয়েলসের পাঠ্যসূচিতে এসব বিষয় অনেক গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ইউকের রোজ ক্যাল্ডওয়েল বলেছেন, স্কুলের পাঠ্যসূচিতে পর্নোগ্রাফিকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সেটি হবে বড় ধরনের অগ্রগতি। তিনি বলেন, "স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ যৌনতা ও সম্পর্কের জন্য এই শিক্ষা তাদেরকে প্রস্তুত করবে। শিক্ষকদেরকেও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে।" ওয়েলশ সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, নতুন পাঠ্যসূচিতে সম্পর্ক ও যৌনতার ওপর শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে তাতে পর্নোগ্রাফিকে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে সেটি এখন বিবেচনা করে দেখা হবে। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×