ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে বিশ্ব হার্ট দিবস

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ২৭ অক্টোবর ২০২০

করোনাকালে বিশ্ব হার্ট দিবস

মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে ৩,২৩,৯৭,৪৭৯ জনের মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৯,৮৫,৭৪৮ জন, বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ৩,৫৬,৭৬৭ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫০৯৩ জনের। অজানা এই ভাইরাসটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এমন কঠিন এক বাস্তবতার মধ্যে পালিত হবে বিশ্ব হার্ট দিবস। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দিবসটির গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হার্ট রোগীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। করোনায় হার্ট রোগীদের মৃত্যুহারও বেশি। সুস্থ, স্বাভাবিক ও আনন্দপূর্ণ জীবনের জন্য দরকার একটি সুস্থ হৃদযন্ত্র। কিন্তু এ যন্ত্রটিকে সুস্থ রাখাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক বিশ্বে জীবনযাত্রার নানামুখী পরিবর্তন, কাজের পরিবেশ সব কিছুই যেন প্রতিনিয়ত হৃদযন্ত্রকে প্রতিকূলতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তার পরও হৃদযন্ত্র ভাল রাখতেই হবে। আর তাই সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের কোন বিকল্প নেই। হার্টের অসুখ বা হৃদরোগই পৃথিবীতে মৃত্যুর প্রধান কারণ। কেবল হৃদরোগের এই পরিসংখ্যানগুলো আগে থেকে জানি না বলে, হৃদরোগ নিয়ে আমাদের মাঝে কোন ভয় কাজ করে না। জানি না বলেই নিজের অজান্তে আমরা ধরে নিয়েছি, আমাদের বোধহয় হৃদরোগ হবে না। যেমনটা আমাদের নিম্নবিত্ত কিংবা অথর্ব বোকা মানুষগুলো করোনার পরিসংখ্যান জানে না বলে তারা ধরে নিয়েছে করোনায় তারা আক্রান্ত হবে না। এ জন্যই যারা জানে আর যারা জানে না তারা সমান না। মানুষ যদি সচেতন না হয়, তবে এটা ছড়াবেই। যারা ক্যান্সার আক্রান্ত, ডায়াবেটিস, হাইপারটেশন, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ এবং কিডনি ডিজিজে ভুগছেন অথবা যাদের ইমিউনিটি কম তারা অবশ্যই বেশি ঝুঁকিতে আছেন। স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে এদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এই মুহূর্তে করোনার ভয়ে হৃদরোগের রোগীরা হাসপাতালমুখী কম হচ্ছেন। এতে করে তার শরীর বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই অন্য সময়ের চেয়ে এই সময়ে হৃদরোগ বেড়ে যাওয়ার খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ যে দুটি রোগে চিকিৎসা করতে গিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হয় তার একটি হলো ক্যান্সার, অন্যটি হলো হৃদরোগ বা হার্ট ডিজিজ। অথচ অন্যান্য জটিল রোগের মতো হৃদরোগের চিকিৎসাতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। বিভিন্ন শ্রেণীর লোক তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে প্রতিহিংসাবসত হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে নানা রকমের বদনাম ছড়ায়, তার মধ্যে একটি বড় অপপ্রচার হলো হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেরিতে কাজ করে। অথচ হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, মাইগ্রেন, হৃদরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস্ট্রিক, আলসারসহ অনেক রোগের জন্য মানুষ ৫০ বছর ও এলোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে পুরোপুরি রোগ মুক্ত হতে পারে না, দুর্ভাগ্যজনক হলে তার পরেও কেউ বলে না যে, এলোপ্যাথি ওষুধ বিলম্বে কাজ করে। হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে প্রচলিত বদনামগুলোর মার্কেট পাওয়ার জন্য একটি মূল কারণ হলো নাম ডাকওয়ালা দক্ষ হোমিও চিকিৎসকের যথেষ্ট অভাব, বলা যায় খুবই অভাব, হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হৃদরোগ চিকিৎসায়, বিবরণী পড়লে হতাশ প্রাণে আশার আলো দেখা দেয়, সাধারণভাবে হৃদরোগ বলতে হৃৎপি-, রক্তবাহী ধমনী ও শিরা, মস্তিষ্ক ও বৃক্ক সম্পর্কিত রোগ বোঝায়। হৃদরোগের অনেক কারণের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ও এ্যাথেরোসক্লোরোসিস প্রধান। সঙ্গে সঙ্গে বয়সের সঙ্গে হৃৎপি- ও ধমনীর গঠনগত পরিবর্তনও হৃদরোগের জন্য অনেকাংশে দায়ী। হৃদরোগ সাধারণত বয়স্কদেরই হয়। মহিলাদের চেয়ে পুরুষরাই হৃদরোগে বেশি আক্রান্ত হন। পুষ্টিকর খাবার, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, তামাক জাতীয় দ্রব্য বর্জনের মাধ্যমে অনেকাংশে হৃদরোগ প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে। হৃদরোগ বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন- জন্মগত হৃদরোগ, করোনারি হৃদরোগ, হার্ট ফেইলর, কার্ডিও-মায়োপ্যাথি, উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ, কোর পালমোনাল (হৃৎপি-ের ডান পাশ অচল হয়ে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়), সেরেব্রোভাস্কুলার রোগ (মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী রক্তবাহিকার অসুখ, যেমন- স্ট্রোক), প্রান্তিক ধমনীর রোগ, রিউম্যাটিক হৃদরোগ (বাতজ্বরের কারণে হৃদপেশী ও ভাল্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া), কার্ডিয়াক ডিসরিদ্মিয়াস ইত্যাদি। হৃদরোগের কারণ : হৃদরোগের জন্য অনেক কারন দায়ী। যেমন-বয়স, লিঙ্গ, ধূমপান, অতিরিক্ত এ্যালকোহল গ্রহণ, পারিবারিক ইতিহাস, স্থূলতা, স্বল্প শারীরিক পরিশ্রম, খাবার দাবারে অসচেতনতা, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ লিপিড, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন, নিয়মিত হাঁটা বা শারীরিক পরিশ্রম, খাবার দাবারে একটু সচেতন হলে এবং উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ লিপিড, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস করা যেতে পারে। কোন বয়সে হতে পারে? হৃদরোগ সব বয়সেই হতে পারে। তবে সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিরাই এ রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণভাবে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সিরাম কোলেস্টেরলের মাত্রাও বাড়ে। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮২ শতাংশই হৃদরোগে মারা যায়। আবার ৫৫ বছর বয়সের পরে স্ট্র্রোক করার সম্ভাবনাও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আবার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়, ফলে করোনারি ধমনী রোগ হয়। কাদের হতে পারে : প্রজননে সক্ষম নারীর তুলনায় পুরুষদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। প্রজননের সময়ের পরে, নারী ও পুরুষের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা সমান। যদি কোন নারীর ডায়াবেটিস থাকে, তার হৃদরোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পুরুষের চেয়ে বেশি। মধ্যবয়সী মানুষের ক্ষেত্রে, করোনারি হৃদরোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা নারীদের তুলনায় পুরুষদের প্রায় ৫ গুণ বেশি। হৃদরোগে লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ মূলত হরমোনগত পার্থক্য। হৃদরোগের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ : বুক, পিঠ, পেট, গলা, বাম বাহুতে ব্যথা, ঘাড় বা চোয়ালে ব্যথা এবং অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। শ্বাসকষ্ট পাকস্থলীর উপররের দিকে অসহনীয় ব্যথা অনুভূত হবে। মাথা হালকা লাগতে পারে। হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় : হৃদরোগ নানা রকমের হতে পারে, যেমন-জন্মগত হৃদরোগ, বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ, হৃৎপি-ে স্বল্প রক্ত চলাচলজনিত হৃদরোগ, হৃৎপি-ে মাংসের দুর্বলতাজনিত হৃদরোগ ইত্যাদি। হৃদরোগ প্রতিরোধে সতর্ক হলে অনেক ভাল ফল পাওয়া যায়। নিম্নে জন্মগত হৃদরোগ এবং অন্যান্য হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় বিষয় সম্বন্ধে বর্ণনা করা হলো। জন্মগত হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় : গর্ভধারণের কমপক্ষে তিন মাস আগে মাকে গগজ ওহলবপঃরড়হ দিতে হবে, গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই চিকিৎসা করতে হবে। ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে সেটা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। গর্ভবতী অবস্থায় যে কোন রকম ওষুধ খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অন্যান্য হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় : কম বয়সী ছেলে বা মেয়ের গলাব্যথাসহ জ্বর হলে, তাকে এক সপ্তাহের জন্য বেলাডোনা দিয়ে চিকিৎসা করলে ভবিষ্যতে হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা অনেকটা হ্রাস পাবে। আবার স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো যায়। হৃৎপি-ে রক্ত চলাচলজনিত কারণে হার্ট এ্যাটাকের মতো মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যা প্রতিরোধে খাবার এবং জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন- প্রতিদিন কমপক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময় হাঁটা বা ব্যায়াম অথবা শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। এটা হৃদরোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। প্রচুর পরিমাণে ফলমূল, শাক-সবজি, তরকারি, টক জাতীয় ফল খেতে হবে। অপরদিকে লবণ ও চিনি কম খেতে হবে। বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার বর্জন করতে হবে। মদ্যপান, জর্দা, তামাক, ধূমপান ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। ধূমপান ছাড়ার পরবর্তী ১০ বছর সময় পর্যন্ত হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে যায়। ফাস্টফুড, টিনজাত ও শুকনো খাবার খাওয়া কমাতে হবে। অতিরিক্ত পরিমাণে চা, কফি এবং কোমল পানীয় বর্জন করতে হবে। ধূমপান, এ্যালকোহল বা যে কোন ধরনের মাদক বর্জন করতে হবে। মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি এবং কিছু কিছু ওষুধ হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শরীরে চর্বি জমতে দেয়া যাবে না। এটা হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণভাবে পুরুষের কোমরের মাপ ৩৭ ইঞ্চির কম ও মহিলাদের ৩২ ইঞ্চির কম হওয়া উচিত। বিএমআই ২৫ এর চেয়ে যত বেশি হবে, সেটা হৃদরোগের জন্য তততাই ঝুঁকিপূর্ণ। ওজন যত কিলোগ্রাম হবে, তাকে উচ্চতা যত মিটার তার বর্গ দিয়ে ভাগ করে বিএমআই নির্ণয় করতে হয়। ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে, সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। প্রাণিজ চর্বি খাওয়া যাবে না, তবে উদ্ভিদ তেল খেতে হবে যেমন-সয়াবিন, সূর্যমুখী, সরিষার তেল ইত্যাদি। সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে। বাদাম হৃদরোগের জন্য উপকারী। বাদামের ভেষজ প্রোটিন, ফলিক এসিড, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফ্লাভোনয়েডস, সেলিনিয়াম ও ভিটামিন-ই হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত উপকারী। দাম্পত্য জীবনে সুখী থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং ধর্ম-কর্মে মনোযোগী হতে হবে। মানসিক চাপ অর্থাৎ অনিদ্রা, টেনশন, ভয়, ক্রোধ, হতাশা, রাগ, প্রতিশোধ প্রবণতা, হিংসা ইত্যাদি বর্জন করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কমপক্ষে সপ্তাহে এক দিন রক্তচাপ পরীক্ষা এবং মাসে একবার করে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। ডাঃ মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি কো-চেয়ারম্যান হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইমেইল : [email protected] মোবাইল : ০১৮২২-৮৬৯৩৮৯
×