ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতিতে নামছে শীত

উত্তরের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে শীতের পদধ্বনি

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২৭ অক্টোবর ২০২০

উত্তরের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে শীতের পদধ্বনি

সমুদ্র হক ॥ ভোরের তেরছা রোদ কুয়াশার আঁচল চিরে ঝিলিক তুলে জানিয়ে দিয়েছে ঋতুচক্রে হেমন্ত। তবে শীতের অতিরিক্ত অনুভবতায় সরাসরি জানিয়ে দিচ্ছে এবার অগ্রহায়ণেই শীত থাবা দেবে। প্রকৃতি বিশারদগণ জানিয়েছিলেন শীতের স্থায়িত্বকাল কমবে। গত ক’বছর তাই-ই ছিল। করোনাকালে এবারের প্রকৃতির মতিগতি এতটাই খেয়ালি যে কোন গবেষণা অভিজ্ঞতা কাজে দিচ্ছে না। হেমন্তের সুপ্রভাতকে গুডবাই জানিয়ে ওয়েলকাম শীত- পালা শুরু হয়েছে এখনই। গত ক’দিনর উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি তাই বলছে। হিমালয় পাদদেশীয় সর্ব উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে বগুড়া ও আশপাশের এলাকায় এখনই হিমেল বাতাসে ঘন কুয়াশায় সকাল শুরু হয়। দিনের তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। শহরের বাসা বাড়িতে বৈদ্যুতিক ফ্যানের সুইচ অন হয় না। বিকেলের আগেই ঘন কুয়াশায় গোধূলীও ঢেকে দেয়। সন্ধ্যার অনেকটা আগেই শুরু হয় শিশির ঝরার পালা। গ্রামে দুপুরের পরই দূর থেকে চোখে পড়ে গাছগাছালি সবুজের আবরণে ঢেকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সোনালি ধানের ম ম গন্ধে ভরে ওঠে কৃষকের মন। এবারের চার দফা বন্যা ব্রহ্মপুত্র যমুনা তিস্তা বাঙালী তীরের মানুষকে কাহিল করে ফেলেছে। সেই কৃষক প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কোমর সোজা করে দাঁড়িয়েছে। দেরিতে হলেও রোপা আমনের আবাদ করে স্বপ্ন দেখছে। বগুড়ার সোনাতলার রানীরপাড়ার কৃষক বাসেত আলী বললেন ‘আল্লায় মুখ তুলে তাকাইছে বা। তরতর করে আমন চারা বাড়্যে উঠিচ্চে।’ কৃষক আবলু বললেন ‘ক্ষেত এ্যানা সোনালি হলেই ধান কাটমো।’ তাদের কথায় এটা পরিষ্কার : হেমন্ত লক্ষ্মী তাদের বিমুখ করবে না। বাংলার ঋতুর নিসর্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ হেমন্তকে লক্ষ্মীর উপমায় টেনে এনছেন। বাঙালীর জীবনে গ্রামের মানুষ অন্নকে লক্ষ্মী বলে। থালা থেকে ভাত পড়ে গেলে বলা হয় লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই। ঋতুচক্রে কার্তিক মাসের কথা উঠলেই মধ্যবয়সীরা স্মৃতির পথ ধরে ফিরে যান মরা কার্তিকের ভয়ঙ্কর উপাখ্যানে। কার্তিকের আরেক পরিচিতি ছিল ‘মঙ্গা’। এর অর্থ তীব্র অভাব। দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় মঙ্গা শব্দটি আজ মুছে গিয়েছে। মঙ্গা তৈল চিত্র হয়ে জাদুঘরের দর্শনীয় স্থানে বসেছে। বর্তমান প্রজন্ম মঙ্গা দিনের কথা ঠাকুমার রূপকথার গল্পের মতো করে শোনে। দেশে এখন খাবারের জন্য কারও কাছে হাত পাততে হয় না। গত ক’বছর ধরে উত্তরাঞ্চলের উদ্বৃত্ত চাল রফতানি শুরু হয়েছে। চলতি বছর বন্যার থাবার পরও বন্যা মুক্ত এলাকায় রোপা আমনের আবাদ ভাল হয়েছে। বন্যা এলাকার কৃষক ইউ টার্নে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলার ঋতু চক্রে হেমন্ত চতুর্থ। বিশ্বের কোথাও এই ঋতু নেই। হেমন্তের বৈশিষ্ট্য- আকাশে সাদা মেঘের ভেলা সরিয়ে হালকা কুয়াশার প্রলেপ দিয়ে ধরণিকুলকে দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলা- এ হেমন্ত না শীত। ওদিকে শিশির ঝরিয়ে শীতও এগিয়ে এসে হেমন্তের আঙিনায় সীমানা অতিক্রম করে। ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলায় ত্রিতালের উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে দেয় ভুবন। নবান্নে কৃষকের উঠান ভরে ওঠে নতুন ধানে। হাঁড়িতে চড়ে নতুন চালের ভাত, ফিরনি পায়েস। বঙ্গীয় ব-দ্বীপের নবান্নের এই দেশে ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা মায়াভরা গ্রামে মিলন তিথির ভরা চাঁদ ওঠে পশ্চিমের মধ্য গগনে। এই সময়ে সকাল ও গোধূলী বেলা বিছিয়ে দেয় কুয়াশার পাতলা চাদর। বইছে মৃদু মন্দ শীতল হাওয়া। কুয়াশা তো মেঘই। কয়েক দিন আগের ভ্যাপসা গরম আর বিরামহীন বারিধারা ভুলে যাচ্ছে মানুষ। গ্রামে চোখে পড়ে চারদিকে আমন ধানের প্রান্তর। ক্ষেতের ভিতরে কৃষক বসে উপরি ঘাস তুলে পরিচর্যা করছে। দিনমান কাজ সেরে আকাশ পানে চেয়ে ধারণা করে কেমন থাকবে আবহাওয়া! অকারণে বিপর্যয় নেমে আসবে না তো! এখন তো কিছুই বলা যায় না। জলবায়ুর পরিবর্তনের পালা শুরু হয়েছে বিশ্বময়। ঋতুর সময় ঠিক থাকছে না। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। সকল ঋতুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। শরতের কাশবন হেমন্তও অতিক্রম করে। ঋতু পরিবর্তনের ধারায় শীত বসন্ত এক হতেই বা কতক্ষণ!
×